১৪২তম অধ্যায়
পাণ্ডবগণের মন্দর-পর্ব্বত যাত্ৰা
লোমশ কহিলেন, “হে পাণ্ডবগণ! আপনারা ভূরি ভূরি পর্ব্বত, নদী, নগর, বন ও মনোরম তীর্থ-সকল সন্দর্শন এবং হস্তদ্বারা সলিল স্পর্শ করিয়াছেন। এক্ষণে এই পথ দ্বারা মন্দর-পর্ব্বতে গমন করিতে হইবে; অতএব সকলে দুর্ভাবনা ও অনবধানতা পরিত্যাগ করুন। আপনাদিগকে এই দেবগণ ও পুণ্যকর্ম্ম ঋষিগণের নিবাসে গমন করিতে হইবে।
এই শিবসলিলশালিনী মহতী তরঙ্গমালিনী প্রবাহিত হইতেছেন, বদরিকাশ্রম ইহার উৎপত্তি-স্থান এবং দেবর্ষিগণ ইহার সেবক। আকাশগামী বালখিল্যগণ ইঁহার অর্চনা এবং মহাত্মা গন্ধর্ব্বগণ ইহাতে স্নানবিধি করিয়া থাকেন। মরীচি, পুলহ ভৃগু, অঙ্গিরাঃ এই স্থানে পবিত্ৰস্বরে সামগান করিয়াছিলেন। দেবরাজ দেবগণের সহিত এই স্থানে প্রাত্যহিক জপক্রিয়া সম্পাদন করেন, তৎকালে সাধ্যগণ ও অশ্বিনীকুমার তাঁহার আনুগত্য করিয়া থাকেন। চন্দ্র, সূৰ্য্য ও গ্ৰহ নক্ষত্ৰ পৰ্য্যায়ক্রমে দিবারাত্র ইঁহার সেবা করিয়া থাকেন। ভগবান গঙ্গাধর গঙ্গাদ্বারে ইঁহারই সলিল শিরোদেশে ধারণপূর্ব্বক সংসারের স্থিতিবিধান করিয়াছেন। তোমরা সকলে সমীপবর্ত্তী হইয়া বিশুদ্ধ-হৃদয়ে এই ভগবতী ভাগীরথীকে অভিবাদন কর।”
তীর্থপ্রসঙ্গে নরকাসুরবৃত্তান্ত-বর্ণন
মহাত্মা পাণ্ডবগণ লোমশবাক্য-শ্রবণে পবিত্ৰ হইয়া আকাশগঙ্গা মন্দাকিনীকে অভিবাদনপূর্ব্বক প্রহৃষ্টমনে পুনর্ব্বার গমন করিতে আরম্ভ করিলেন। কিয়দ্দূর গমন করিয়া দেখিলেন, মেঘসন্নিভ পাণ্ডুরবর্ণ বস্তু দিকসকল ব্যাপিয়া রহিয়াছে। তাঁহারা লোমশকে তাহার বৃত্তান্ত জিজ্ঞাসা করিবার নিমিত্ত উৎসুক হওয়ায় তিনি তাঁহাদিগের অভিপ্ৰায় জানিয়া কহিলেন, “হে পাণ্ডবগণ! আমি আপনাদিগের অভিপ্ৰায় প্রকাশ করিতেছি, শ্রবণ করুন। ঐ যে কৈলাসশিখরসদৃশ শোভাসম্পন্ন বস্তুরাশি নিরীক্ষণ করিতেছেন, উহা মাহাত্মা নরকাসুরের অস্থিস্তরের সহিত মিশ্রিত হইয়া থাকতে পর্ব্বতের ন্যায় প্রতীয়মান হইতেছে।
“ভগবান পুরাতন দেব বিষ্ণু দেবরাজের হিতকামনায় নরকদৈত্যকে নিহত করিয়াছিলেন। মহামনাঃ নরকাসুর দশসহস্রবর্ষ তপস্যা, তপ ও স্বাধ্যায়প্রভাবে ঐন্দ্রপদের প্রার্থী এবং বাহুবলে নিতান্ত প্ৰগলভ হইয়াছিল। দেবরাজ নরকাসুরকে বলবান ও ধর্ম্মপরায়ণ অবলোকন করিয়া ভয় ও উদ্বেগে অস্থির হইয়া সর্ব্বব্যাপী নারায়ণকে ধ্যান করিলে তিনি তৎক্ষণাৎ আবির্ভূত হইলেন। তাঁহাকে দর্শন করিবামাত্র তদীয় তেজঃপ্রভাবে প্রজ্বলিত হুতাশনে নিস্তেজ হইয়া উঠিলেন এবং দেবগণ ও ঋষিগণ তাঁহাকে স্তব করিতে আরম্ভ করিলেন। অনন্তর বজ্রধর কৃতাঞ্জলিপুটে নমস্কার করিয়া তাঁহার সম্মুখে আপনার ভয়ের বৃত্তান্তসকল নিবেদন করিলেন।
“ভগবান বিষ্ণু কহিলেন, “হে দেবেন্দ্র! তুমি যে নরক-দৈত্য হইতে ভীত হইয়াছ, আমি তাহা অবগত হইয়াছি। সে তপস্যাপ্রভাবে ঐন্দ্ৰপদ প্রার্থনা করিতেছে। নরক-দৈত্য তপঃসিদ্ধ হইলেও আমি তোমার প্রীতির নিমিত্ত তাহার প্রাণসংহার করিব, তুমি মুহূর্ত্তকাল প্রতীক্ষা কর।
“অনন্তর মহাতেজাঃ বিষ্ণু হস্তদ্বারা নরকাসুরের চেতনা হরণ করিলে সে আহত গিরিরাজের ন্যায় ধরাতলে পতিত হইল। ঐ সেই মায়ানিহত নরক-দৈত্যের অস্থিসমূহ বিদ্যমান রহিয়াছে। আর এই সমগ্র বসুমতী পাতালতলে নিমজ্জিত হইলে ভগবান বিষ্ণু একদন্ত বরাহবিগ্ৰহ পরিগ্রহ করিয়া পুনরায় তাহাকে যে উদ্ধার করিয়াছিলেন, তাহাই তাঁহার দ্বিতীয় কর্ম্ম।”
যুধিষ্ঠির কহিলেন, “ভগবান! বসুমতী কি নিমিত্ত বিনষ্ট হইয়াছিল? ভগবান ত্ৰিলোকীনাথ বা কি প্রকারে তাঁহাকে পুনরায় শতযোজন উদ্ধৃত করিয়াছিলেন? কিরূপেই বা সর্ব্বশস্যপ্ৰসবিনী ভগবতী বসুমতী সুস্থিরা হইলেন? কাহার প্রভাবেই বা শতযোজন নিমর্জ্জিত হইয়াছিলেন? কোন ব্যক্তিই বা পরমাত্মার অদ্ভুত শক্তি প্রদর্শন করিয়াছিল? এই সকল বৃত্তান্ত সবিস্তারে শ্রবণ করিবার নিমিত্ত কৌতুহলাক্রান্ত হইয়াছি, আপনিই সেই কৌতুহলনিবারণের একমাত্র উপায়, অতএব এই সমস্ত বৃত্তান্ত সবিস্তারে বর্ণন করুন।”
লোমশ কহিলেন, “হে যুধিষ্ঠির! আপনি যাহা জিজ্ঞাসা করিলেন, তৎসমুদয় বৃত্তান্ত কহিতেছি, শ্রবণ করুন। প্রথমে ভয়ঙ্কর সত্যযুগ উপস্থিত হইলে আদিদেব বিষ্ণু স্বয়ং যমত্বপদে অধিষ্ঠিত হইয়া যমকাৰ্য্য সম্পাদন করিতে লাগিলেন। তৎকালে জন্তুগণ কেবল জন্মপরিগ্ৰহ করিত, কাহাকেও মৃত্যুর সহিত সাক্ষাৎ করিতে হইত না। এই নিমিত্ত পশু, পক্ষী, পিশিতাশন, মানবকুল ও সলিল অযুতগুণে বৰ্দ্ধিত হইয়া উঠিলে বসুমতী তাহাদিগের অতিমাত্ৰ ভারে ব্যথিত হইয়া শতযোজন নিম্নে নিপতিত হইলেন।
বিষ্ণুকর্ত্তৃক ধরার ভারহরণ
“অনন্তর পৃথিবী নারায়ণের শরণাগত হইয়া কহিলেন, “ভগবন। আমি আপনার প্রসাদে চিরকাল এই স্থানে সুস্থির হইয়াছিলাম, কিন্তু এরূপ ভারাক্রান্ত হইয়া কোনক্রমেই অবস্থিতি করিতে পারিনা। অতএব আমি আপনার শরণাপন্ন হইয়াছি, হে বিভো! প্ৰসন্ন হইয়া আমাকে এই ভার হইতে মুক্ত করুন।”
“ভগবান নারায়ণ বসুমতীর এই বাক্য শ্রবণ করিয়া সানন্দে আকাশবাণীর দ্বারা কহিলেন, “অয়ি কাতরে বসুধারিণি! ভীত হইও না, আমি তোমাকে ভারমুক্ত করিতেছি।” নারায়ণ এইরূপে বসুধাকে বিদায় করিয়া একদন্ত, রক্তলোচন, অতিভীষণ বরাহমূর্ত্তি ধারণপূর্ব্বক ভাস্বরধূমসম স্বীয় শোভা বিস্তারপূর্ব্বক সেই স্থানেই বদ্ধিত হইয়া সমুজ্জ্বল দশনাগ্রভাগ দ্বারা ধরামণ্ডলকে শতযোজন উৰ্দ্ধে উদ্ধার করিলেন।
“ধরাতল উত্তোলনসময়ে নরলোক, সুরলোক ও অন্তরীক্ষ এরূপ সংক্ষোভিত হইয়াছিল যে, দেব, ঋষি, তপোধন ও মানবগণ অতিমাত্ৰ ত্ৰস্ত ও ক্ষুব্ধ হইয়া হাহাকার করিতে লাগিল। মনুষ্যের কথা দূরে থাকুক, তৎকালে দেবগণ পৰ্য্যন্ত কম্পমান হইয়াছিলেন। অনন্তর দেবগণ ও ঋষিগণ একত্র হইয়া সুখাসীন লোকসাক্ষী ব্ৰহ্মার সমীপে গমনপূর্ব্বক কৃতাঞ্জলিপুটে কহিলেন, “হে দেবেশ! সমুদয়লোক সংক্ষোভিত হইয়াছে, চরাচর ব্যাকুল হইয়াছে, সমস্ত সাগরবারি আন্দোলিত হইতেছে এবং সমুদয় বসুমতী শতযোজন নিম্নগামিনী হইয়াছে। হে ব্ৰহ্মন! এ কি ঘটনা উপস্থিত হইল? কাহার প্রভাবে সমস্ত জগৎ এরূপ আকুল হইয়া উঠিল? আমরা ইহাতে হতচেতন্যপ্রায় হইয়াছি। আপনি অনুগ্রহ করিয়া এই সকল কথা বর্ণন করুন।”
“ব্ৰহ্মা কহিলেন, “হে অমরগণ! বোধ হয়, তোমরা অসুরভয় অনুভব করিয়া এরূপ ক্ষুব্ধ হইয়াছ; কিন্তু ইহা তাহা নহে, যিনি সর্ব্বব্যাপী অক্ষয়াত্মা পরমপুরুষ, তাঁহারই প্রভাবে সুরলোকসকল সংক্ষোভিত হইয়াছে। অখণ্ড ভূমণ্ডল শতযোজন নিম্নে নিমগ্ন হইয়াছিল; পরমাত্মা বিষ্ণু পুনরায় তাহাকে উদ্ধার করিয়াছেন, এইজন্য এবম্পকার সংক্ষোভ উপস্থিত হইয়াছে। হে দেবগণ! সংক্ষোভের কারণ শ্রবণ করিলে, এক্ষণে সংশয় দূর কর।”
দেবগণ কহিলেন, “ব্রহ্মন! ভগবান নারায়ণ যে স্থানে অবস্থিত হইয়া বসুমতীর উদ্ধারসাধন করিতেছেন, সেই স্থান নিরূপণ করিয়া বলুন, আমরা তথায় গমন করিব।”
“ব্ৰহ্মা কহিলেন, “হে দেবগণ! শ্ৰীমান নারায়ণ এক্ষণে নন্দনবনে অবস্থিতি করিতেছেন। তোমরা স্বচ্ছন্দে তথায় গমন করিয়া সেই অনাময় পুরুষকে অবলোকন কর। তিনি বরাহরূপ ধারণ করিয়া ধরাতল উদ্ধারপূর্ব্বক কালানলের ন্যায় শোভা পাইতেছেন। তাঁহার বক্ষঃস্থলে শ্ৰীবৎসমণি সুব্যক্তিরূপে বিরাজিত রহিয়াছে।” অনন্তর অমরগণ মহাত্মা বিষ্ণুকে অবলোকন ও আমন্ত্রণপূর্ব্বক পিতামহ-সমভিব্যাহারে স্ব স্ব স্থানে প্রস্থান করিলেন।”
পাণ্ডবগণ এই কথা শ্রবণ করিয়া হৃষ্টচিত্তে লোমশের আদেশানুসারে ত্বরিতপদে গমন করিতে প্ৰবৃত্ত হইলেন।