১৪০তম অধ্যায়
সাত্যকিকর্ত্তৃক অলম্বুষনৃপতিবধ
ধৃতরাষ্ট্র কহিলেন, “হে সঞ্জয়! প্রতিদিনই আমার প্রদীপ্ত যশঃ ক্ষীণ এবং বহুসংখ্যক যোদ্ধা যোদ্ধা বিপক্ষশরে নিহত হইতেছে। অতএব বোধ হয়, দৈব আমাদিগের পক্ষে নিতান্ত প্রতিকূল। মহাবীর ধনঞ্জয় অশ্বত্থামা ও কর্ণকর্ত্তৃক সুরক্ষিত, সুরগণেরও অপ্রবেশ্য কৌরবসৈন্যমধ্যে রোষভরে প্রবেশ করিয়াছেন। প্রভূতবলশালী কৃষ্ণ, ভীম ও শিনিপ্রবীর সাত্যকির সহিত মিলিত হওয়াতে তাহার পরাক্রম পরিবর্দ্ধিত হইয়াছে। হে সঘ্জয়! ঐ বৃত্তান্ত শ্রবণাবধি অগ্নি যেমন তৃণ দগ্ধ করে, তদ্রূপ শোকানল আমাকে নিরন্তর দগ্ধ করিতেছে। আমি জয়দ্রথপ্রমুখ মহীপালগণকে যেন কালগ্রাসে নিপতিত বোধ করিতেছি। হে সঞ্জয়! সিন্ধুরাজ জয়দ্রথ ধনঞ্জয়ের অনিষ্টাচরণ করিয়া এক্ষণে তাঁহার নেত্রগোচর হইয়া কিরূপে প্রাণরক্ষায় সমর্থ হইবেন? আমার বোধ হইতেছে যেন, সিন্ধুরাজ কলেবর পরিত্যাগ করিয়াছেন। যাহা হউক, এক্ষণে সংগ্রামবৃত্তান্ত কীৰ্ত্তন কর। যে মহাবীর ধনঞ্জয়ের সাহায্যার্থ নলিনীদলপ্রমার্থী মত্তমাতঙ্গের ন্যায় বারংবার কৌরবসৈন্যসকল সংক্ষোভিত করিয়া ক্রোধভরে তন্মধ্যে প্রবেশ করিয়াছেন, সেই বৃষ্ণিবংশাবতংস সাত্যকি কিরূপে সংগ্রাম করিলেন?”
সঞ্জয় কহিলেন, “মহারাজ! অনন্তর মহারথ সাত্যকি কর্ণশরে নিতান্ত নিপীড়িত পুরুষপ্রবীর বৃকোদরকে গমন করিতে দেখিয়া রথারোহণে তাঁহার অনুগমন করিতে লাগিলেন এবং বর্ষাকালীন জলদজালের ন্যায় গভীর গর্জ্জনপূর্ব্বক ক্রোধে শরৎকালীন দিবাকরের ন্যায় প্রদীপ্ত হইয়া কৌরবপক্ষীয় সেনাগণকে বিকম্পিত করিয়া শত্ৰুসংহারে প্রবৃত্ত হইলেন। তিনি যখন রজতের ন্যায় ধবলবর্ণ অশ্বসমুদয় সঞ্চালনপূর্ব্বক গমন করিতে লাগিলেন, তৎকালে কৌরবপক্ষীয় কোন বীরই তাঁহাকে নিবারণ করিতে সমর্থ হইলেন না। অনন্তর অমর্ষপূর্ণ, সমরে অপরাঙ্মুখ, শরাসন ও সুবর্ণবৰ্মধারী মহারাজ অলম্বুষ সেই মাধবকুলতিলক সাত্যকির সমীপে সমুপস্থিত হইয়া তাঁহাকে নিবারণ করিতে লাগিলেন। তখন সেই বীরদ্বয়ের অভূতপূর্ব্ব ঘোরতর যুদ্ধ আরম্ভ হইল। উভয়পক্ষীয় যোদ্ধারা তাঁহাদিগকে নিরীক্ষণ করিতে লাগিলেন। অলম্বুষ সাত্যকিকে লক্ষ্য করিয়া দশ শর পরিত্যাগ করিলে তিনি তৎসময় উপস্থিত না হইতে হইতেই শরনিকরে ছেদন করিয়া ফেলিলেন। তখন মহারাজ অলম্বুষ শরাসন আকর্ণ আকর্ষণ করিয়া পুনরায় অগ্নিকল্প সুতীক্ষ্ণ সুপুঙ্খ তিন শর প্রয়োগ করিলেন। ঐ শরত্রয় সাত্যকির বর্ম্ম ভেদ করিয়া শরীরমধ্যে প্রবিষ্ট হইল। এইরূপে অলম্বুষ অগ্নি ও অনিলসদৃশ প্রভাবসম্পন্ন অতিভাস্বর শরত্রয়ে সাত্যকির দেহ ভেদ করিয়া চারিবাণে তৎক্ষণাৎ তাঁহার ধবলকায় চারি অশ্বকে বিদ্ধ করিলেন।
“অনন্তর চক্রধরসদৃশ প্রভাবশালী সাত্যকি মহাবেগসম্পন্ন চারিশরে অলম্বুষের অশ্বগণকে বিনাশ করিলেন; পরে কালানলসন্নিভ ভল্লদ্বারা অলম্বষের সারথির কণ্ঠচ্ছেদন করিয়া তাঁহার কুণ্ডলালঙ্কৃত পূর্ণশশিপ্রকাশ বদনমণ্ডল কলেবর হইতে পৃথক করিয়া ফেলিলেন। হে মহারাজ! এইরূপে যদুকুলতিলক সাত্যকি মহারাজ অলম্বষকে বিনাশ করিয়া কৌরবসৈন্যগণকে নিবারণপূর্ব্বক অর্জ্জুনসন্নিধানে গমন করিতে লাগিলেন। তাঁহার গোদুগ্ধ, কুন্দ, ইন্দু ও হিমসবর্ণ, সুবর্ণজালজড়িত, সিন্ধুদেশীয় অশ্বগণ তাঁহার অভিলাষানুসারে তাঁহাকে ইতস্ততঃ বহন করিতে লাগিল। তখন আপনার আত্মজগণ ও যোধসকল যোদ্ধৃপ্রধান দুঃশাসনকে সম্মুখীন করিয়া সাত্যকির অভিমুখে ধাবমান হইলেন এবং সৈন্যগণের সহিত সাত্যকিকে পরিবেষ্টনপূর্ব্বক তাঁহার উপর শরাঘাত করিতে লাগিলেন; মহাবীর সাত্যকিও অগ্নিকল্প শরনিকরে তাঁহাদিগকে নিবারণ করিয়া সত্বর দুঃশাসনের অশ্বগণকে বিনষ্ট করিলেন। ঐ সময় মহাবীর অর্জ্জুন ও বাসুদেব মহাবীর সাত্যকিকে নিরীক্ষণ করিয়া সাতিশয় হর্ষ প্রাপ্ত হইলেন।”