১৩শ অধ্যায়
লৌহভীমভঙ্গে কৃষ্ণের তিরস্কার
বৈশম্পায়ন কহিলেন, হে মহারাজ! অনন্তর পরিচারকগণ অন্ধরাজের গাত্রপ্রক্ষালনাদি [পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা] শৌচক্রিয়া সম্পাদন করিলে বাসুদেব, পুনরায় তাঁহাকে কহিলেন, “নরনাথ! আপনি সমস্ত কাৰ্য্যাকার্য্যবিবেচনায় সমর্থ ও বহুদর্শী এবং বেদ, পুরাণ ও রাজধর্ম্ম প্রভৃতি বিবিধ শাস্ত্র অধ্যয়ন করিয়াছেন। তবে কি নিমিত্ত স্বয়ং অপরাধ করিয়া ঈদৃশ কোপ প্রকাশ করিতেছেন? তৎকালে আমি ভীষ্ম, দ্রোণাচাৰ্য্য, বিদুর ও সঞ্জয়, আমরা সকলে আপনাকে কহিয়াছিলাম যে, পাণ্ডবগণ সমধিক বলবীৰ্য্যশালী; সুতরাং তাঁহাদের সহিত সন্ধিস্থাপনই অবশ্য কর্ত্তব্য। হে মহাত্মন! আমরা ঐরূপে বারংবার আপনাকে সন্ধিস্থাপনে অনুরোধ করিলেও আপনি, সে সময় আমাদিগের বাক্য উল্লঙ্ঘন করিলেন; কোনক্রমে তদনুরূপ কাৰ্য্য করিলেন না। দেখুন, যে স্থিরবুদ্ধি মহীপাল স্বয়ং আপনার দোষ দর্শন ও দেশকাল বিবেচনা করিয়া কার্য্য করেন, তিনি মঙ্গললাভে সমর্থ হয়েন, আর যিনি হিতাহিতবিষয়ে উপদেশ প্রাপ্ত হইয়াও তাহা গ্রহণ করেন না, তাঁহাকে নিশ্চয়ই দুর্নীতিনিবন্ধন বিপদগ্রস্ত হইয়া শোক করিতে হয়। আপনি নিতান্ত চঞ্চলস্বভাব ও দুর্য্যোধনের বশবর্তী ছিলেন বলিয়াই এইরূপ দুরবস্থাগ্রস্ত হইয়াছেন; অতএব এক্ষণে কি নিমিত্ত ভীমসেনকে সংহার করিতে ইচ্ছা করিতেছেন? ভীর্ম্মের অপরাধ কি? যে নীচাশয় স্পৰ্দ্ধাপূর্ব্বক দ্রৌপদীকে সভায় আনয়ন করিয়াছিল, মহাবীর বৃকোদর তাঁহাকে বিনাশ করিয়া বৈর নির্য্যাতন করিয়াছেন। আপনি নিরপরাধে পাণ্ডবগণকে পরিত্যাগ করিয়া কিরূপ অন্যায় কাৰ্য্য করিয়াছিলেন, আর দুৰ্য্যোধনও উহাদের উপর কত অত্যাচার করিয়াছিল, এক্ষণে তাহা বিবেচনা করিয়া ক্রোধসংবরণ করুন।”
হে জনমেজয়! দেবকীপুত্র বাসুদেব এইরূপ কহিলে ধৃতরাষ্ট্র তাঁহাকে সম্বোধন করিয়া কহিলেন, “মাধব! তুমি যাহা যাহা কহিতেছ, তৎসমুদয়ই সত্য, কিন্তু বলবান্ অপত্যস্নেহ আমাকে ধৈৰ্য্যচ্যুত করিয়াছিল, সেই নিমিত্তই আমি ভীমের অশুভানুষ্ঠানে বাসনা করিয়াছিলাম। তুমি ভাগ্যক্রমে সত্যপরাক্রম মহাবল পরাক্রান্ত বৃকোদরকে রক্ষা করাতে সে আমার ভুজপঞ্জরে নিপতিত হয় নাই। যাহা হউক, এক্ষণে আমি একাগ্রচিত্ত হইয়াছি; আমার শোকতাপ সমস্ত দূরীভূত হইয়াছে। অতঃপর মহাবীর ভীমসেনকে কুশলপ্রশ্ন ও সাদর সম্ভাষণ করিব। আমার তনয়গণ ও অন্যান্য ভূপতিসমুদয় নিহত হইয়াছে; সুতরাং এক্ষণে পাণ্ডুতনয়গণই আমার প্রীতি ও মঙ্গলের আস্পদ [স্থান] হইল।” রাজা ধৃতরাষ্ট্র এই কথা বলিয়া রোদন করিতে করিতে ভীমসেন, ধনঞ্জয়, নকুল ও সহদেবকে আলিঙ্গনপূর্ব্বক তাঁহাদিগকে আশ্বাস প্রদান ও আশীৰ্বাদ করিতে লাগিলেন।