১৩৯. সৌবীর-পরাজয়
একোনচত্বারিংশদধিকশততম অধ্যায়।
বৈশম্পায়ন কহিলেন,-মহারাজ! অনন্তর সম্বৎসর অতীত হইলে মহারাজ ধৃতরাষ্ট্র পাণ্ডুনন্দন যুধিষ্ঠিরকে যৌবরাজ্যে অভিষিক্ত করিলেন। যুধিষ্ঠির রাজ্যলাভ করিয়া স্বকীয় অসাধারণ ধৈৰ্য্য, স্থৈর্য, সহিষ্ণুতা, ঋজুতা, অনৃশংসাচার, ভৃত্যানুকম্পা, স্থিরসৌহার্দ প্রভৃতি সদ্গুণ দ্বারা অনতিদীর্ঘকালমধ্যে নিজ পিতার মহীয়সী কীৰ্ত্তি এককালে তিরোহিত করিলেন। ভীমপরাক্রম ভীমসেন ভগবান বলদেব হইতে অসিচৰ্য্যা, গদাযুদ্ধ ও রথযুদ্ধ প্রভৃতি বিবিধ বিষয়ের জ্ঞানলাভ করিয়া ভ্রাতৃগণের একান্ত বশদ হইয়া রহিলেন। অর্জুন প্রগাঢ় দৃঢ়মুষ্টি ছিলেন। লক্ষ্যবেধে তাহার বিলক্ষণ পটুতা ছিল, তিনি ক্ষুর, নারাচ, ভল্ল, বিপাটন প্রভৃতি বহুবিধ অস্ত্রশস্ত্রে বিশেষ পারদর্শী হইয়াছিলেন। তাঁহার ঐ সকল অস্ত্রশস্ত্র নিক্ষেপবিষয়ে সম্যক্ লাঘব ও সৌষ্ঠব জন্মিয়াছিল। জীবলোকে অর্জুনের তুল্য বলবান্ আর কেহই নাই, দ্রোণাচাৰ্য এই নিমিত্ত সর্বদাই তাঁহার ভূয়সী প্রশংসা করিতেন।
একদা দ্রোণ কৌরবীসভায় অর্জুনকে সম্বোধন করিয়া কহিলেন, বৎস! আমার গুরু অগ্নিবেশ, অগস্ত্যের নিকটে ধনুর্বেদ শিক্ষা করিয়াছিলেন। এক সময়ে তিনি আমাকে আহ্বান করিয়া কহেন, বৎস! আমি তপোবলে ব্ৰহ্মশিরঃ নামে যে অমোঘ অস্ত্র প্রাপ্ত হইয়াছি, এক্ষণে তাহা শিষ্যপরম্পরায় প্রদান করিতে ইচ্ছা করি; ইহার প্রভাবে পৃথিবী দগ্ধ হইতে পারে। শুরুদেব অস্ত্রগুণ এইরূপ কীর্তন করিয়া প্রদানকালে আমাকে এই বলিয়া নিষেধ করেন, বৎস! তুমি এই অস্ত্র কচি মনুষ্যের ও ক্ষীণবীর্য্য জীবের উপর প্রয়োগ করিও না। এক্ষণে এই দিব্যাস্ত্র প্রদানের তুমিই উপযুক্ত পাত্র, আর কাহাকেও ইহার যোগ্য দেখিতেছি না; কিন্তু বৎস! মুনি যেরূপ নিয়ম নির্ধারিত করিয়া দিয়াছেন, সাবধান, যেন তাহার অন্যথা না হয়। জ্ঞাতিসম্প্রদায়-সমক্ষে তোমাকে আরও কিছু গুরুদক্ষিণা প্রদান করিতে হইবে। অর্জুন তৎক্ষণাৎ তাহা স্বীকার করিলেন। তৎপরে আচাৰ্য পুনৰ্বার কহিলেন, হে অর্জুন! রণস্থলে তুমি আমার প্রতিযোদ্ধা হইবে, ইহাও অঙ্গীকার কর। অর্জুন ‘যে আজ্ঞা’ বলিয়া তাহার চরণ গ্রহণপূর্বক উত্তরাভিমুখে প্রস্থান করিলেন। জীবলোকে অর্জুনের তুল্য আর দ্বিতীয় ধনুর্দ্ধর নাই, এই প্রশংসাবাদ সর্বত্র উত্থিত হইল; ফলতঃ অর্জুন গদাযুদ্ধ, অসিচৰ্য্যা, রথ ও ধনুযুদ্ধে অদ্বিতীয় হইয়াছিলেন। ন্যায়পর সহদেব উশনপ্রণীত নীতিশাস্ত্রে সম্যক্ ব্যুৎপত্তি লাভ করিয়া ভ্রাতৃগণের একান্ত বশম্বদ হইয়া রহিলেন। ভ্রাতৃচতুষ্টয়ের প্রীতিভাজন নকুল দ্রোণাচার্যোপদেশে বিবিধ শিক্ষায় সুশিক্ষিত হইয়া বিচিত্র যোদ্ধা ও অতিরথ বলিয়া সর্বত্র প্রসিদ্ধ হইয়াছিলেন। পাণ্ডবেরা গন্ধৰ্বদিগের উপপ্লবকালে রণস্থলে যবনরাজ সেবীরকে সংহার করিলেন। সৌবীর বৎসরয়ব্যাপী এক যজ্ঞ অনুষ্ঠান করিয়াছিলেন। তিনি সর্বদা কুরুদিগের প্রতি দ্বেষভাব প্রকাশ করিতেন। বিচিত্রবীর্য এবং মহারাজ পাণ্ডু যাহাকে বশীভূত করিতে পারেন নাই, মহাবীর অর্জুন নিজ বাহুবলে সেই বিতুলনামা সৌবীরক শাসন করিলেন। তাহার শরহারে সংগ্রামপ্রিয় দত্তামিত্র বলিয়া বিখ্যাত সুমিত্ৰনাম সৌরীরক শাসিত হইযাছিল। অর্জুন ভীমসেনের সাহায্যে এক রথেই অযুতরথ ও পশ্চিমদেশবাসীদিগকে পরাজয় করেন। তৎপরে সেই রথেই আরোহণ করিয়া দক্ষিণ দিও জয় করিলেন: এবং পরাজিত রাজমণ্ডলীর নিকট হইতে প্রচুর অর্থ সংগ্রহ কর্নিয়া কুরুরাজ্যে অনিয়ন করিতে লাগিলেন। পূর্বকালে মহানুভর পাণ্ডবেরা এইরূপে অনেক। নেক ভূপালগণকে রাজ্যচ্যুত করিয়া স্বীয় রাজ্যের সীমা বিস্তার করেন।
পাণ্ডবদিগের বাহুবল অলৌকিক বিবেচনা করিয়া মহারাজ ধৃতরাষ্ট্রের মনোগত সমুদায় সাধুভাব নিতান্ত দূষিত হইল; তিনি তদ্বিষয়িণী বলবর্তী চিন্তায় একান্ত নিমগ্ন হইয়া রাত্রিকালে সুখে নি। যাইতে পারিতেন না।