১৩৮তম অধ্যায়
রৈভ্যতনয় পরাবসু ঋষি-কর্ত্তৃক পিতৃবধ
লোমশ কহিলেন, “মহারাজ! এই অবসরে রৈভ্য-যজমান মহীপতি বৃহদ্যুম্ন এক যজ্ঞ আরম্ভ করিয়া রৈভ্যাত্মজ অর্ব্বাবসু ও পরাবসুকে বরণ করিলেন। তাঁহারা পিতার আদেশানুসারে যজন কাৰ্য্যাৰ্থ তথায় গমন করিলেন; কেবল রৈভ্য ও পরাবসুর সহধর্ম্মিণী আশ্রমে বাস করিতে লাগিলেন।
“একদা পরাবসু ভাৰ্য্যাদর্শনার্থী হইয়া অল্পতিমিরাচ্ছন্ন রজনীশেষে স্বীয় আশ্রমে প্রত্যাগমন করিলেন। তৎকালে রৈভ্য— মুনি গাঢ় নিদ্রায় অভিভূত ও কৃষ্ণাজিনসংবৃত হইয়া অরণ্যমধ্যে শয়ান ছিলেন। পরাবসু নিবিড়ারণ্যসঞ্চারী মৃগ বোধ করিয়া আত্মত্ৰাণার্থে তাঁহাকে সংহার করিলেন। পরিশেষে পিতার প্ৰেতকাৰ্য্য-সকল সমাধানপূর্ব্বক আশু অর্ব্বাবসু-সন্নিধানে উপনীত হইয়া কহিলেন, ‘ভ্ৰাতঃ! আমি আজি রজনীশেষে আরণ্যমৃগবোধে পিতাকে বধ করিয়াছি; এই নিমিত্ত ব্ৰহ্ম হিংসনব্ৰতানুষ্ঠান করিতে হইবে। যদি আমি ইহাতে প্ৰবৃত্ত হই, তবে তুমি একাকী কদাচি এই যজ্ঞ সম্পন্ন করিতে সমর্থ হইবে না; অতএব তুমি আমার নিমিত্ত এই ব্ৰতানুষ্ঠান করো; আমি একাকীই এই যজ্ঞকাৰ্যসকল নির্ব্বাহ করিব।” অর্ব্বাবসু কহিলেন, ‘ভ্ৰাতঃ! আপনি এই যজ্ঞে দীক্ষিত হউন। আমি আপনার নিমিত্ত নিয়াতেন্দ্ৰিয় হইয়া ব্ৰহ্মহিংসনব্ৰত সাধন করিব।” এই বলিয়া প্ৰস্থান করিলেন।
“কিয়দ্দিন অতীত হইলে একদা অর্ব্বাবসু ব্রতসাধনপূর্ব্বক তথায় আগমন করিতেছেন, এই অবসরে পরাবসু স্বীয় ভ্রাতাকে উপস্থিত দেখিয়া হৰ্ষগদগদম্বরে বৃহদ্যুম্নকে কহিলেন, “মহারাজ! এই ব্ৰহ্মঘাতী যেন যজ্ঞ-দর্শনার্থ এ স্থানে প্রবেশ না করে। আমি কহিতেছি, নিশ্চয়ই ইহার দৃষ্টিপাতমাত্রেই আপনার অনিষ্ট ঘটিবে।” এই কথা শ্রবণ করিবামাত্র রাজা তাহাকে নিষ্কাশিত করিবার নিমিত্ত ভৃত্যবৰ্গকে আদেশ প্রদান করিলেন। ভূত্যেরা প্রভুর আদেশানুসারে তৎক্ষণাৎ তাহাকে উৎসারিত করিল। তখন অর্ব্বাবসু ‘আমি ব্ৰহ্মহত্যা করি নাই’ এই কথা বারংবার কহিতে লাগিলেন; তথাচ ভৃত্যবৰ্গ তাঁহাকে ব্ৰহ্মঘাতী বলিয়া অপসারিত করিল। অর্ব্বাবসু কহিলেন, “আমি ব্ৰহ্মহত্যা করি নাই, আমার ভ্ৰাতাই এই কুকাৰ্য্য করিয়াছেন; আমি কেবল তাঁহাকে ব্ৰাহ্মণবধপাতক হইতে মুক্ত করিয়াছি।” তিনি ক্ৰোধাভরে বারংবার এই কথা বলিলেও ভূত্যেরা তাঁহাকে নিষ্কাশিত করিল।
পরাবসুর তপস্যায় তৎপিতা রৈভ্য ও পুত্রসহ ভরদ্বাজের পুনর্জীবন
“অনন্তর মহাতপাঃ ব্রহ্মর্ষি মৌনাবলম্বনপূর্ব্বক বনে প্রবেশ এবং দিবাকরকে আশ্রয় করিয়া অতিকঠোর তপানুষ্ঠানদ্বারা সূৰ্য্যমন্ত্রপ্রকাশ এক বেদ রচনা করিলে, মূর্ত্তিমান, মরীচিমালী তথায় আবির্ভূত হইলেন। অগ্নিপ্রমুখ দেবগণ এই মহৎকাৰ্য্যদ্বারা পরামপ্রীত ও প্রসন্ন হইয়া অর্ব্বাবসুকে যাজনকাৰ্য্যে বরণ ও পরাবসুকে নিবারণপূর্ব্বক অভিলষিত বরপ্রদানে সম্মত হইলে, অর্ব্বাবসু কহিলেন, “হে দেবগণ! যদি আপনারা প্ৰসন্ন হইয়া থাকেন, তবে এই বর প্রদান করুন যে, আমার পিতা পুনর্জীবিত হইয়া এই অকারণবধ যেন বিস্মৃত ও ভ্রাতা নিরপরাধ হয়েন। আর ভরদ্বাজ ও যবক্ৰীত উভয়েই যেন পুনর্জীবিত হইয়া উঠেন এবং আমার এই সৌর-বেদ যেন সর্ব্বত্র প্রতিষ্ঠালাভ করে।” দেবগণ ‘তথাস্তু’ বলিয়া তাহাকে বর প্রদান করিলেন।”
“অনন্তর ভরদ্বাজ প্রভৃতি সকলেই প্রাদুর্ভূত হইলে যবক্রীত কহিলেন, “হে দেবগণ! আমি বেদাধ্যয়ন ও বহুবিধ ব্ৰতানুষ্ঠান করিয়াছি, তথাপি রৈভ্য-মুনি কিরূপে উক্তরূপ বিধি অনুসারে মদ্বিনাশে কৃতকাৰ্য্য হইলেন? দেবগণ কহিলেন, “হে। যবক্ৰীত! তুমি যেরূপ কহিতেছ, ইহা সেরূপ মনে করিও না। কারণ, তুমি গুরুর সাহায্য ব্যতিরেকে পূর্ব্বে বেদাধ্যয়ন করিয়াছ; কিন্তু রৈভ্য আত্মকর্ম্মদ্বারা গুরুকে সন্তুষ্ট করিয়া বহুক্লেশে অনেক কালে বেদ শিক্ষা করিয়াছেন; এ নিমিত্ত তিনি তোমা অপেক্ষা উৎকৃষ্ট ও তোমার বিনাশে কৃতকাৰ্য্য হইয়াছিলেন।” দেবগণ যবক্রীতকে এই কথা বলিয়া পুনর্ব্বার দেবলোকে প্রস্থান করিলেন। হে মহারাজ! সেই যবক্রীতেরই এই আশ্রম; এই স্থানে অবস্থান করিলে নর সর্ব্বপাপ হইতে বিনিমুক্ত হয়।”