১৩৭তম অধ্যায়
ভীষ্ম দ্রোণাদির উৎসাহ যুক্ত উপদেশ
বৈশম্পায়ন কহিলেন, হে রাজন! রাজা দুৰ্য্যোধন ভীষ্ম ও দ্রোণের বাক্যশ্রবণানন্তর বিমনাঃ, বক্ৰদৃষ্টি ও অধোবদন হইয়া ভ্রূদ্বয়ের মধ্যভাগ সঙ্কুচিত করিয়া অবস্থান করিতে লাগিলেন; কোন কথা কহিলেন না। তখন ভীষ্ম ও দ্রোণ তাঁহাকে দুৰ্ম্মনায়মান দর্শন করিয়া পরস্পর মুখাবলোকনপূর্ব্বক পুনরায় কহিতে আরম্ভ করিলেন।
ভীষ্ম কহিলেন, হে দুৰ্য্যোধন! আমি সেই শুশ্রূষাসম্পন্ন, অনসূয় [অসূয়ারহিত— নির্দোষে দোষাবিষ্কারশূন্য], ব্ৰহ্মপরায়ণ, সত্যবাদী যুধিষ্ঠিরের সহিত প্রতিযুদ্ধ করিব, তাহা হইলে তোমার আর দুঃখের বিষয় কি?”
দ্রোণ কহিলেন, “হে রাজন! যদিও আমি অশ্বত্থামার ন্যায় কপিধ্বজ ধনঞ্জয়ের প্রতি সবহুমান প্রীতি করিয়া থাকি, অধিক কি, সে আমার পুত্র অপেক্ষাও প্রিয়তর, তথাপি ক্ষত্রধর্ম্মানুরোধে সেই অর্জ্জুনের সহিত প্রতিযুদ্ধ করিব। ক্ষত্ৰজীবিকায় ধিক। সেই অলৌকিক ধনুৰ্দ্ধর ধনঞ্জয় আমারই প্ৰসাদে সকল যোদ্ধা অপেক্ষা শ্ৰেষ্ঠ হইয়াছে। মিত্রদ্রোহী, দুষ্টস্বভাব, নাস্তিক, অসরল ও শঠ ব্যক্তি সৎসমাজে সমাগত হইলে যজ্ঞে সমুপস্থিত মুখের ন্যায় পূজনীয় হয় না। পাপাত্মা ব্যক্তি পাপ হইতে নিবারিত হইলেও পাপ ইচ্ছা করে; কিন্তু পুণ্যাত্মা ব্যক্তি পাপকর্মে নিয়োজিত হইলেও শুভ ইচ্ছা করিয়া থাকেন। তুমি প্রিয়ানুষ্ঠানপরায়ণ পাণ্ডবগণের সহিত মিথ্যা ব্যবহার করিয়াছ; এই দোষেই তোমাকে পরাভূত হইতে হইবে। আমি, ধৃতরাষ্ট্র, বিদুর ও বাসুদেব, আমরা সকলে তোমার হিতকর কথাই কহিলাম; কিন্তু তুমি তাহা অগ্রাহ্য করিয়া আপনাকে বলবান মনে করিয়া গঙ্গাবেগের ন্যায় গ্রাহ[কুন্তীর]-নক্র[হাঙ্গর]মেকর সন্ধুল মহাসাগর সহসা উত্তীর্ণ হইতে অভিলাষ করিতেছ।
“যেমন লোকে পরের পরিত্যক্ত বস্ত্র ও মাল্য পরিধান করিয়া আপনার বোধ করে, তদ্রূপ তুমি যুধিষ্ঠিরের রাজলক্ষ্মী প্রাপ্ত হইয়া লোভাবশতঃ আপনার বলিয়া জ্ঞান করিতেছ। ধর্ম্মরাজ যুধিষ্ঠির দ্রৌপদী ও সশস্ত্র ভ্রাতৃগণে পরিবৃত হইয়া বনস্থ হইলেও কোন রাজ্যস্থ ব্যক্তি তাঁহাকে পরাজয় করিবে? সকল রাজা
যুধিষ্ঠির অবিচলিতচিত্তে সেই কুবেরের সহিতও সংগ্রাম করিয়াছিলেন। পাণ্ডবগণ কুবেরসদন হইতে রত্ন আহরণ করিয়া এক্ষণে তোমার সমৃদ্ধিসম্পন্ন রাজ্য আক্রমণ করিতে অভিলাষ করিতেছেন। আমরা দান করিয়াছি, হোম করিয়াছি, অধ্যয়ন করিয়াছি এবং ধনদ্বারা ব্ৰাহ্মণগণকে সন্তুষ্ট করিয়াছি; সুতরাং আমরা একপ্রকার কৃতকৃত্যু হইয়াছি, আর আমাদের আয়ুও প্রায় নিঃশেষিত হইয়াছে; মরিলেও কোন হানি নাই। কিন্তু তুমি যে রাজ্যসুখ, মিত্র ও ধন পরিত্যাগপূর্ব্বক পাণ্ডবগণের সহিত যুদ্ধ করিয়া ব্যসনপ্রাপ্ত হইবে, ইহা অত্যন্ত দুঃখের বিষয়। আর তপস্যা ও ব্ৰতপরায়ণা সত্যবাদিনী দ্রৌপদী যাঁহার জয় আশঙ্কা করিতেছেন, তুমি সেই পাণ্ডবকে কিপ্রকারে পরাজয় করিবে? জনাৰ্দন যাহার মন্ত্রী ও নিখিল ধনুৰ্দ্ধরের অগ্রগণ্য ধনঞ্জয় যাহার ভ্রাতা, তুমি সেই পাণ্ডবকে কিপ্রকারে পরাজয় করিবে? ধৈৰ্য্যশীল, জিতেন্দ্ৰিয় ব্রাহ্মণগণ যাঁহার সহায় এবং যিনি স্বয়ং উগ্ৰতপাঃ মহাবীর, তুমি সেই পাণ্ডবকে কিপ্রকারে পরাজয় করিবে? সুহৃদগণ ব্যসনাৰ্ণবে নিমগ্ন হইবে। হিতৈষী সুহৃদের যাহা কর্ত্তব্য, আমি তাহা পুনরায় কহিতেছি। হে বীর! যুদ্ধে প্রয়োজন নাই; কুরুগণের সমুন্নতির নিমিত্ত সন্ধিস্থাপন কর; পুত্র, অমাত্য ও সেনাগণের সহিত পরাভবপ্রাপ্ত হইও না।”