১৩৭তম অধ্যায়
কর্ণ-ভীমযুদ্ধ শত্ৰুঞ্জয়াদি ধৃতরাষ্ট্রপুত্রবধ
সঞ্জয় কহিলেন, “হে মহারাজ! মত্তমাতঙ্গ যেমন প্রতিপক্ষ মাতঙ্গের গর্জ্জন সহ্য করিতে পারে না, তদ্রূপ মহারথ রাধেয় ভীমসেনের জ্যানিনাদ সহ্য করিতে পারিলেন না। তিনি ক্ষণকাল ভীমসেনের নিকট হইতে অপসৃত হইয়া বৃকোদরশরে নিপাতিত আপনার পুত্রগণকে অবলোকন করিয়া নিতান্ত বিমনায়মান ও দুঃখিত হইলে এবং দীর্ঘ ও উষ্ণ নিশ্বাস পরিত্যাগপূর্ব্বক পুনরায় ভীমাভিমুখে গমন করিলেন। তিনি ক্রোধে লোহিতনেত্র হইয়া ভীষণ ভুজঙ্গের ন্যায় গর্জ্জনপূর্ব্বক শরবর্ষণ করিয়া ক্ষিপ্তরশ্মি ভাস্করের ন্যায় শোভা পাইতে লাগিলেন। মহাবীর বৃকোদর দিবাকরের করজালের ন্যায় কর্ণের শরজালে সমাচ্ছন্ন হইলেন। পক্ষিগণ যেমন বৃক্ষকোটরে প্রবিষ্ট হয়, তদ্রূপ ময়ূরপুচ্ছবিভূষিত, রাধেয়বিসৃষ্ট শরসকল ভীমসেনের সর্ব্বাঙ্গে প্রবেশ করিল। তখন কর্ণচাপচ্যুত সুবর্ণপুঙ্খ শরনিকর উপর্য্যুপরি পতিত হইয়া শ্রেণীবদ্ধ হংসসমুদয়ের ন্যায় বিরাজিত হইতে লাগিল। তৎকালে বোধ হইল যে, বাণসকল চাপ, ধ্বজ, ছত্র, ঈষামুখ ও রথের ন্যায় উপকরণ হইতে বহির্গত হইতেছে। এইরূপে মহাবীর রাধেয় বেগবান্ সুবর্ণময় শরসমুদয় পরিত্যাগ করিয়া আকাশমণ্ডল পরিপূরিত করিলেন; কিন্তু মহাবল বৃকোদর তদ্দর্শনে কিছুমাত্র ভীত হইলেন না। তিনি জীবিতনিরপেক্ষ হইয়া নয়বাণে সেই কর্ণনিক্ষিপ্ত অন্তসদৃশ শরজাল ছিন্নভিন্ন করিয়া শাণিত বিংশতিশরে রাধানন্দনকে বিদ্ধ করিলেন। প্রথমে কর্ণ শরজালে ভীমসেনকে যেরূপ সমাচ্ছন্ন করিয়াছিলেন, এক্ষণে ভীমসেন তাঁহাকে সেইরূপ শরজালে সমাচ্ছন্ন করিয়া ফেলিলেন। তখন আপনার পক্ষীয় বীরসকল ও চারণগণ ভীমসেনের বিক্রমদর্শনে মহা আহ্লাদিত হইয়া তাঁহাকে ধন্যবাদ প্রদান করিতে লাগিলেন।
ঐ সময় কৌরবপক্ষীয় ভূরিশ্ৰবা, কৃপাচার্য্য, অশ্বত্থামা, মদ্ররাজ, জয়দ্রথ ও উত্তমৌজা এবং পাণ্ডবপক্ষীয় যুধামন্যু, সাত্যকি, কেশব ও অর্জ্জুন—এই দশজন মহারথ ভীমকে ধন্যবাদ প্রদানপূর্ব্বক সিংহনাদ পরিত্যাগ করিতে আরম্ভ করিলেন। তন্নিবন্ধন সমরস্থলে অতি ভয়ঙ্কর লোমহর্ষণ শব্দ সমুত্থিত হইল।
“হে কুরুরাজ! তখন আপনার পুত্র রাজা দুৰ্য্যোধন অতি সত্বর মহাধনুৰ্ধর সহোদরগণকে কহিলেন, “হে ভ্রাতৃগণ! তোমাদিগের মঙ্গল হউক। তোমরা শীঘ্র কর্ণের রক্ষণে যত্নবান্ হইয়া তাঁহার নিকট গমনপূর্ব্বক তাঁহাকে বৃকোদরের হস্ত হইতে পরিত্রাণ কর। নচেৎ ভীমনির্মুক্ত শরনিকর রাধানন্দনকে সংহার করিবে। তখন আপনার সাত পুত্র দুৰ্য্যোধনের আজ্ঞানুসারে ক্রোধভরে ভীমাভিমুখে ধাবমান হইয়া তাঁহাকে নিবারণ করিতে লাগিলেন। গ্রীষ্মান্তে জলধর যেমন বারিধারায় পর্ব্বতকে আবৃত করে, তদ্রূপ তাঁহারা বৃকোদরকে শরধারায় সমাচ্ছন্ন করিলেন। প্রলয়কালে সপ্তগ্রহ যেমন সুধাংশুকে পীড়িত করে, তদ্রূপ সেই সপ্ত মহারথ ভীমকে নিপীড়িত করিতে লাগিলেন। তখন মহাবীর ভীমসেন পূর্ব্ববৈর স্মরণ করিয়া দৃঢ়তর মুষ্টিসুশোভিত শরাসন আকর্ষণ করিতে লাগিলেন এবং সেই বীরগণকে সামান্য মনুষ্য জ্ঞান করিয়া তাঁহাদের দেহ হইতে প্রাণ নিষ্কাষিত করিয়াই যেন সুৰ্য্যরশ্মিসদৃশ সাত শর সন্ধানপূর্ব্বক তাঁহাদিগের উপর নিক্ষেপ করিলেন। ভীমনিক্ষিপ্ত কনকমণ্ডিত শাণিত শরসকল তাঁহাদিগের হৃদয় বিদারণ ও শোণিতপানপূর্ব্বক শোণিতলিপ্ত ও আকাশমার্গে সমুত্থিত হইয়া ব্যোমচারী বহুসংখ্যক গরুড়ের ন্যায় শোভা পাইতে লাগিল। আপনার পুত্রেরাও ভিন্নহৃদয় হইয়া রথ হইতে ভূতলে নিপতিত হইলেন। তাঁহাদের পতনসময়ে বোধ হইল যেন, গিরিসানুসমুৎপন্ন বনস্পতি গজভগ্ন হইয়া ভূতলে নিপতিত হইতেছে। হে মহারাজ! এইরূপে শত্ৰুঞ্জয়, শত্রুসহ, চিত্র, চিত্রায়ুধ, দৃঢ়, চিত্রসেন ও বিকর্ণ—আপনার এই সাত পুত্র নিপাতিত হইলেন। তন্মধ্যে পাণ্ডবপ্রিয় বিকর্ণের নিমিত্ত বৃকোদর শোকে নিতান্ত ব্যাকুল হইয়া কহিতে লাগিলেন, ‘হে বিকর্ণ! আমি তোমাদিগের শতভ্রাতাকে বিনাশ করিব বলিয়া প্রতিজ্ঞা করিয়াছিলাম। সেই প্রতিজ্ঞাপ্রতিপালননিবন্ধনই আজ তুমি নিহত হইলে। তুমি আমাদিগের, বিশেষতঃ মহারাজ যুধিষ্ঠিরের হিতসাধনে একান্ত তৎপর। হে ভ্রাতঃ! তুমি যুদ্ধই ক্ষত্রিয়ের প্রধান ধর্ম্ম, এই মনে করিয়া ন্যায়ানুসারে রণস্থলে আগমন করিয়াছিলে। অতএব তোমার নিমিত্ত অনুতাপ করা ন্যায়ানুগত নহে।’
“হে কুরুরাজ! ভীমসেন এইরূপে রাধেয়সমক্ষে আপনার পুত্রগণকে বিনাশ করিয়া ঘোরতর সিংহনাদ পরিত্যাগ করিলেন। ধর্ম্মরাজ যুধিষ্ঠির মহাধনুৰ্ধর ভীমসেনের সেই সিংহনাদ শ্রবণ করিয়া আপনাকে জয়শালী বিবেচনা করিয়া অত্যন্ত প্রীত হইলেন এবং সুমহান্ বাদিত্র শব্দ করিয়া ভ্রাতার সিংহনাদ সাগ্রহে শুনিতে লাগিলেন। এইরূপে যুধিষ্ঠির মহাবীর বৃকোদরের সঙ্কেতশ্রবণে পরম আহ্লাদিত হইয়া শস্ত্রবিদগণের অগ্রগণ্য দ্রোণের অভিমুখে ধাবমান হইলেন। এদিকে রাজা দুৰ্য্যোধন একত্রিংশৎ সহোদরকে নিহত দেখিয়া চিন্তা করিতে লাগিলেন যে, মহাত্মা বিদুর যাহা কহিয়াছিলেন, তাহা এক্ষণে সার্থক হইতেছে। মহারাজ দুৰ্য্যোধন এই প্রকার চিন্তা করিয়া ইতিকৰ্ত্তব্যবিমূঢ় হইয়া রহিলেন।
“হে মহারাজ! আপনার পুত্র দুৰ্ম্মতি দুৰ্য্যোধন ও দুরাত্মা কর্ণ দূতক্রীড়াকালে সভামধ্যে পাঞ্চালীকে সমানীত করিয়া সমস্ত পাণ্ডুপুত্রের, কৌরবগণের ও আপনার সমক্ষে কৃষ্ণাকে সম্বোধনপূর্ব্বক বলিয়াছিলেন যে, কৃষ্ণে! পাণ্ডবেরা বিনষ্ট ও চিরনরকগামী হইয়াছে, তুমি অন্য কাহাকে পতিত্বে বরণ কর। এক্ষণে সেই পরুষবাক্যের ফলোদয়কাল সমুপস্থিত হইয়াছে। আপনার পুত্রেরা মহাত্মা পাণ্ডবগণকে ষণ্ডতিল প্রভৃতি কটুবাক্য বলিয়া তাহাদের মনে যে ক্রোধাগ্নি উদ্দীপিত করিয়াছিলেন, মহাবীর ভীমসেন ত্রয়োদশ বৎসরের পর সেই ক্রোধাগ্নি উদ্গিরণপূর্ব্বক আপনার পুত্রগণকে বিনাশ করিতেছেন। মহাত্মা বিদুর অনেক বিলাপ করিয়াও আপনাকে শান্তিপক্ষ অবলম্বন করাইতে সমর্থ হয়েন নাই; এক্ষণে আপনি পুত্রের সহিত সেই ক্ষত্তার বাক্যলঙ্ঘনের ফলভোগ করুন। আপনি বৃদ্ধ, ধীর ও তত্ত্বার্থদর্শী হইয়াও দৈববিড়ম্বনাবশতঃ সুহৃদের হিতবাক্য শ্রবণ করিলেন না। এক্ষণে শোক সংবরণ করুন। আমার বোধ হইতেছে, আপনিই স্বীয় দুর্নীতিনিবন্ধন আপনার পুত্রগণের বিনাশহেতু হইয়াছেন। হে কুরুরাজ! মহাবলপরাক্রান্ত বিকর্ণ ও চিত্রসেনপ্রমুখ আপনার যে যে মহারথ পুত্রেরা ভীমের দৃষ্টিপথে নিপতিত হইয়াছিলেন, সকলেই শমনসদনে গমন করিয়াছেন। আপনার নিমিত্তই আমাকে মহাবীর ভীমসেন ও কর্ণের শরে সহস্র সহস্র সৈন্যগণকে নিপাতিত অবলোকন করিতে হইল।”