১৩৬. রণাঙ্গনে কর্ণের আগমন, কর্ণের অঙ্গরাজ্যে অভিষেক, কর্ণের অভিষেক—দুর্য্যোধনসখ্য
ষটত্রিংশদধিকশতমন অধ্যায়।
বৈশম্পায়ন কহিলেন,– মহারাজ! তৎপরে লোকে অবকাশ প্রদান করিলে মহাবল পরাক্রান্ত অঙ্গরাজ কর্ণ বিস্ময়োৎফুল্ললোচনে বিস্তীর্ণ রঙ্গস্থলে প্রবেশ করিলেন। তদীয় মুখমণ্ডল ফুণ্ডলদ্বয়ে অলঙ্কত। তিনি সহজাত কবচ ধারণ ও কটিদেশে খড়গ বন্ধন করিয়া পদচারী পর্বতের ন্যায় শোভা পাইতে লাগিলেন। তিনি সূৰ্য্যের ঔরসে কুমারী কুন্তীর গর্ভে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁহার যশের পরিসীমা ছিল না। দীপ্তি, কান্তি ও দ্যুতি দ্বারা তিনি চন্দ্র, সূৰ্য্য ও অনলের তুল্য ছিলেন। তিনি মৃগরাজ সিংহ ও হস্তিসমূহের ফল একাকী ধারণ করিতেন। তিনি উন্নতকায় ও সর্বাঙ্গসুন্দর ছিলেন। সেই মহাবল কর্ণ রঙ্গস্থলে ইতস্ততঃ অবলোকন করিয়া অতিভক্তি-সহকারে দ্রোণ ও কৃপাচার্য্যকে প্রণাম করিলেন। রঙ্গ লোকেরা তাহাকে নিরীক্ষণ করিয়া নিশ্চল ও স্থিরলোচন হইল এবং ইনি কে ইহা সবিশেষ জানিবার নিমিত্ত একান্ত কৌতূহলাক্রান্ত হইল। তখন সূর্যতনয় কর্ণ অজ্ঞাত ভ্রাতা অর্জুনকে জলধর-গভীরস্বরে কহিলেন, হে পার্থ! তুমি যেরূপ কর্ম করিয়াছ, সর্বসমক্ষে আমিও বিশেষরূপে সেই কাৰ্য সম্পাদন করিব, তুমি বিস্মিত হইও না।
তাঁহার বাক্যাবসান না হইতেই চতুর্দিক হইতে দর্শকেরা যন্ত্রোৎক্ষিপ্তের স্যায় সত্বর উত্থিত হইল। কর্ণের তাদৃশ উৎসাহবাক্যে দুৰ্য্যোধনের প্রীতি ও অর্জুনের,লজ্জা ও ক্রোধের উদ্রেক হইল। তৎপরে দ্রোণের নির্দেশানুসারে সংগ্ৰামপ্রিয় কর্ণ, অর্জুন যেরূপ অনুষ্ঠান করিয়াছিলেন, তিনিও তদনুরূপ কাৰ্য করিলেন। তখন দুৰ্য্যোধন ভ্রাতৃগণ সমভিব্যাহারে মহাবীর কর্ণকে আলিঙ্গন করিয়া প্রফুল্লমনে ও সাদরবচনে কহিলেন, হে মহাবাহে! আমাদিগের সৌভাগ্যক্রমে তুমি এ স্থলে উপস্থিত হইয়াছ। এক্ষণে স্বেচ্ছানুসারে কুরুরাজ্য উপভোগ কর। তদীয় এতাদৃশ বাক্য কর্ণগোচর করিয়া কর্ণ কহিলেন, প্রভো! বোধ হয়, আমি আমার কর্তব্য কর্ম সমুদায়ই সমাধা করিয়াছি, এক্ষণে তোমার সহিত বন্ধুতা করিতে এবং অর্জুনের সহিত দ্বন্দ্বযুদ্ধ করিতে বাসনা করি। তখন দুৰ্য্যোধন কহিলেন, ভাল, এক্ষণে আমার সহিত বন্ধুতা করিয়া বিষয়ভোগবাসনা চরিতার্থ কর, পরে বিপক্ষ পক্ষের মস্তকে পদার্পণ করিয়া পরমসুখে কালাতিপাত করিও। দুর্যোধনের এইরূপ উদ্ধত বাক্যে উত্তেজিত ও ক্ষিপ্তপ্রায় হইয়া অৰ্জন ভ্রাতৃমধ্যে উন্নত ভূধরের ন্যায় অবস্থিত কর্ণকে কহিলেন, রে কর্ণ! যাহারা অনাহুত হইয়া উপদেশ প্রদান করে ও যাহারা অনাহূত হইয়া কথা কহে, তাহারা যে লোকে গমন করে, অদ্য তোর প্রাণ সংহার করিয়া তথায় প্রেরণ করিব। তখন কর্ণ প্রত্যুত্তর করিলেন, হে অর্জুন! দেখ, এই রঙ্গভূমি সাধারণের অধিকৃত; সুতরাং ইহার মধ্যে তোমার বিশেষ কোন প্রভুত নাই। অভ্যাগত ভূপালগণ সকলেই পরাক্রান্ত এবং ধর্ম ও পরাক্রমের অনুসরণ করিয়া থাকেন। অধিক কি বলিব, যাবৎ গুরুজন-সমক্ষে শরণার তোমর শিরচ্ছেদন না করিতেছি, তাবৎ আর বিফল শরক্ষেপের আবশ্যকতা নাই।
অনন্তর অর্জুন আচাৰ্য দ্রোণকর্তৃক আদিষ্ট ও ভ্রাতৃগণকর্তৃক আশ্লিষ্ট হইয়া সংগ্ৰামাৰ্থ কর্ণের সম্মুখে গমন করিলেন। সমরপ্রিয় কর্ণ, দুর্য্যোধন ও তদীয় ভ্রাতৃগণ কর্তৃক আলিঙ্গিত হইয়া ধনুর্বাণ ধারণপূর্বক সমরাঙ্গনে অবতীর্ণ হইলেন। তদনন্তর ইন্দ্ৰায়ুধালঙ্কত, সৌদামিনী-পরিবেষ্টিত, বলাকাশোভিনী মেঘমালা নভোমণ্ডল অচ্ছিন্ন করিয়া ঘোররবে গর্জন করিতে লাগিল। তাহার পর ভগবান ভাস্কর পুত্রবৎসল দেবরাজকে রঙ্গল অবলোকন করিতে দেখিয়া সন্নিহিত মেঘমণ্ডলী অপসারিত্ব করিলেন। অর্জুন মেঘের সুশীতলচ্ছায়ায় অচ্ছিন্ন এবং কর্ণ আতপপে সন্তপ্ত হইতে লাগিলেন। যে দিকে কর্ণ, সেই দিকে ধার্তরাষ্ট্রেরা, যে দিকে অর্জুন তথায় দ্রোণ, কৃপ ও ভীষ্ম প্রভৃতি অব স্থান করিতে লাগিলেন। এইরূপে রঙ্গ সমস্ত লোক ও মহিলাগণ দুই ভাগে বিভক্ত হইয়া এক একপক্ষে পক্ষপাত করিতে লাগিল। এই সম্বাদ শ্রবণ করিয়া ভোজরাজদুহিতা কুন্তী বিমুগ্ধ হইলেন। সর্বধর্মবেত্ত। বিদুর তাহাকে মুচ্ছিতা দেখিয়া পরিচারিকাদিগকে সুশীতল জলসেচনদ্বারা পরিচৰ্য্যা করিতে আদেশ দিয়া কুন্তীকে আশ্বস্ত করিলেন। কুন্তী সংজ্ঞালাভ করিয়া পুত্রদ্বয়কে দর্শন করত ইতিকর্তব্যবিমূঢ় ও অত্যন্ত সন্ত্রান্ত হইলেন। তখন দ্বন্দ্বযুদ্ধকুশলী কৃপ উভয়কে ধনুর্ধারণ করিতে দেখিয়া কর্ণকে কহিলেন, কুন্তীগৰ্ভসস্তৃত মহারাজ পাণ্ডুর তৃতীয় পুত্র অর্জুন তোমার সহিত দ্বন্দ্বযুদ্ধ করিবেন। হে মহাবাহ। এক্ষণে তুমি আপনার মাতা ও পিতার নামোল্লেখ কর এবং কোন্ কুলে জন্মগ্রহণ করিয়াছ ও কোন রাজর্ষিবংশ অলঙ্কত করিয়াছ, তাহাও সবিশেষ বল। তোমার পরিচয় প্রাপ্ত হইলে অর্জুন প্রতিদ্বন্দ্বী হইতে পারেন, নচেৎ তোমার সহিত যুদ্ধ করিবেন না, কারণ, রাজকুমারেরা অজ্ঞাতকুলশীল ব্যক্তির সহিত সংগ্রামে প্রবৃত্ত হয়েন না।
এইরূপ অভিহিত হইলে কর্ণ লজ্জায় অধোমুখ হইয়া রহিলেন। তৎকালে তাঁহার মুখমণ্ডল বর্ষানীর-পরিক্ষিপ্ত সুকোমল পদ্মের ন্যায় শোভা পাইতে লাগিল। তাহা দেখিয়া দুর্য্যোধন দ্রোণকে সম্বোধিয়া কহিলেন, হে আচাৰ্য! শাস্ত্রে কথিত আছে, যিনি সৎকুলে সমুদ্ভূত, বীর ও সৈন্যচালনসমর্থ, তাঁহার সহিত যুদ্ধ করা যায়। তথাচ যদি অর্জুন রাজা ব্যতিরেকে অন্যের সহিত যুদ্ধ না করেন, তবে আমি এই মুহূর্তেই কর্ণকে অঙ্গরাজ্যে অভিষিক্ত করিতেছি।
অনন্তর দুৰ্য্যোধন মহারথ কর্ণকে কাঞ্চনময় পীঠোপরি সংস্থাপনপূর্বক মন্ত্রবিদ ব্রাহ্মণগণকে আহ্বান করিয়া লাজ, কুসুম ও সুবর্ণদ্বারা অঙ্গরাজ্যে অভিষিক্ত করিলেন। মহাবল কর্ণ অঙ্গরাজ্যে অভিষিক্ত হইলে তাহার মন্তকোপরি ছত্র ধারণ করিল, উভয় পার্শ্বে চামরব্যজন এবং বন্দিগণ জয়ধ্বনি করিতে লাগিল। তখন অঙ্গরাজ কর্ণ সাদরসম্ভাষণপূর্বক দুৰ্য্যোধনকে কহিলেন, হে মহারাজ! তোমাকে রাজ্যদানের সমুচিত কি,প্রতিদান করিব? বল, এক্ষণে আমার প্রত্যুপকার করিবার ক্ষমতা আছে। দুৰ্য্যোধন কর্ণের এইরূপ মধুর বাক্য কর্ণগোচর করি কহিলেন, হে কর্ণ! এক্ষণে তোমার সহিত সখ্য সংস্থাপন করিবার বাসনা করি। কর্ণ ‘তথাস্তু’ বলিয়া তাহার বাক্য স্বীকার করিলেন, এবং হর্ষোৎফুল্ললোচনে পরস্পর আলিঙ্গন করিয়া অতিশয় সন্তুষ্ট হইলেন।