১৩৫তম অধ্যায়
অর্জ্জুনের নিকট কুন্তীর বিশেষ বক্তব্য
“হে কেশব! তুমি ধনঞ্জয়কে এইরূপ কহিবে;—হে বৎস! তুমি জন্মপরিগ্রহ করিলে পর, আমি নারীগণে পরিবৃত হইয়া আশ্রমে উপবিষ্ট আছি, এমনসময়ে অন্তরীক্ষে এইরূপ মনোরম দৈববাণী হইল যে, “হে কুস্তি! তোমার এই পুত্র! সহস্রাক্ষের [ইন্দ্রের] সমকক্ষ হইবেন; সংগ্রামে সমুদয় কৌরবগণকে পরাজিত করিবেন; ভীমসেনের সাহায্যে শত্ৰুগণকে আকুলিত করিবেন, অখণ্ডভূমণ্ডল পরাজয় করিবেন, বাসুদেবের সাহায্যে কুরুগণকে সংহার করিয়া বিনষ্ট পৈতৃক অংশ পুনরায় উদ্ধার করিবেন এবং পরিশেষে ভ্রাতৃগণের সহিত মিলিত হইয়া তিনটি যজ্ঞের অনুষ্ঠান করিবেন। ইহার যশ নভোমণ্ডল স্পর্শ করিবে।” হে কেশব! সেই সত্যসন্ধ সব্যসাচী যে প্রকার বলবান ও দুৰ্দ্ধৰ্ষ, তাহা কেবল তুমিই অবগত আছ। তখন যে প্রকার দৈববাণী হইয়াছিল, এক্ষণে তাহা সম্পূর্ণ হউক। যদি ধর্ম্ম থাকে, তাহা হইলে সেই দৈববাণী অবশ্যই ফলবতী হইবে এবং তুমিই তৎসমুদয় সম্পাদন করিবে। আমি দৈববাণীর প্রতি অসূয়াপ্রদর্শন করিতেছি না। ধর্ম্মকে নমস্কার করি, কেন না, ধৰ্মই প্ৰজাগণকে ধারণ করিয়া আছেন।
ভীমাদির প্রতি কুন্তীর বক্তব্যজ্ঞাপন
“তুমি ধনঞ্জয় ও নিত্যোদ্যোগী বৃকোদরকে এই কথা কহিবে যে, ক্ষত্ৰিয়পত্নীরা যে নিমিত্ত সন্তান প্রসব করেন, তাহার সময় সমাগত হইয়াছে। শ্রেষ্ঠ পুরুষগণ বৈরপ্রান্ত হইয়া অবসন্ন হয়েন না। হে কেশব! তুমি ইহাও অবগত আছ যে, শক্রমর্দন ভীমসেন যে পৰ্য্যন্ত শত্ৰুগণকে সংহার না করিবেন, সে পৰ্য্যস্ত তাঁহার বুদ্ধি কদাচ শান্ত হইবে না।
“হে মাধব! সর্ব্বধর্মের বিশেষজ্ঞ মহাত্মা পাণ্ডুর স্নুষা যশস্বিনী কল্যাণী কৃষ্ণকে কহিবে, হে মহাভাগে! হে কুলীনে! হে যশস্বিনী! তুমি যে আমার পুত্ৰগণের প্রতি যথোচিত আচরণ করিতেছ, তাহা তোমার উপযুক্ত কমই হইতেছে।
“মাদ্রীর পুত্ৰদ্ধয়কে এই কহিবে যে, হে নকুল! হে সহদেব! তোমরা উভয়েই ক্ষত্রিধর্মের অনুগত; অতএব জীবন অপেক্ষাও বিক্রমার্জিত ভোগসকল শ্রেষ্ঠ ও প্ৰিয়তম বোধ করা। বিক্ৰমার্জিত অর্থ ক্ষত্রধর্মেপজীবী [ক্ষত্রিয়ধর্ম্ম যুদ্ধাদি রাজ্যপালন দ্বারা জীবিকাকারী] মানবদিগের মনকে প্রীত করে। তোমরা পরম ধার্মিক; সকল ধর্মের উন্নতিসাধন করিয়া থাক; অতএব তোমাদিগের সমক্ষে দ্রুপদনন্দিনীর প্রতি যে পরুষ[কৰ্কশ]বাক্য প্রয়োগ করা হইয়াছে, কে তাহা ক্ষমা করিতে পারে? তোমাদিগের যে রাজ্য অপহৃত হইয়াছে, তাহাতে আমার দুঃখ নাই; তোমরা যে দূতে পরাজিত হইয়াছ, তাহাতেও আমি দুঃখিত নই এবং তোমাদের বিবাসনেও [নির্ব্বাসনে-বনগমনে] আমার দুঃখ নাই; কিন্তু কেবল সেই শ্যামাঙ্গী দ্রুপদবালা যে সভামধ্যে রোদন করিতে করিতে পরুষবাক্য শ্রবণ করিয়াছিলেন, তাহাই আমার অধিকতর দুঃখের কারণ। স্ত্রীধর্মিণী[রজঃস্বলা] ক্ষত্রিধর্ম্মানুগামিনী দ্রৌপদী নাথবতী[পতিমতী-পতিযুক্তা] হইয়াও যে তৎকালে অনাথা হইয়াছিলেন, তাহাই আমার সমধিক দুঃখের বিষয়।
“হে মহাবাহো! তুমি সেইসকল ধনুৰ্দ্ধরের অগ্রগণ্য ধনঞ্জয়কে কহিবে, হে বীর! তুমি দ্রৌপদীর পদবীর [দ্ৰৌপদী-অভিপ্ৰেত পথের] অনুসরণ কর। হে কেশব! ইহা তোমার আগচোর নাই যে, যমোপম ভীমসেন ও অর্জ্জুন কুপিত হইলে দেবগণকেও সংহার করিতে পারে। কিন্তু ইহা অপেক্ষা তাহাদিগের অধিক অপমানের বিষয় আর কি হইতে পারে যে, দ্রুপদনন্দিনীকে সভামধ্যে আগমন করিতে হইয়াছিল এবং সেই স্থানেই দুঃশাসন কুরুবীরগণের সমক্ষে ভীমসেনকে পুরুষবাক্য প্রয়োগ করিয়াছিল।
“হে বৎস! তুমি আমার পুত্রদিগকে পুনরায় সেইসকল কথা স্মরণ করিয়া দিবে। পাণ্ডবগণ, দ্রৌপদী ও তাঁহার পুত্ৰগণকে কুশলজিজ্ঞাসা এবং তাঁহাদিগকে আমার কুশলসংবাদ প্রদান করিও। এক্ষণে তুমি নির্ব্বিঘ্নে গমন কর; আমার পুত্ৰগণকে প্রতিপালন করিও।”
হস্তিনা হইতে কৃষ্ণের প্রস্থান
অনন্তর মৃগেন্দ্ৰগমন [সিংহতুল্য গমনশীল] মহাবাহু কেশব কুন্তীকে অভিবাদন ও প্রদক্ষিণ করিয়া তথা হইতে প্ৰস্থান করিলেন এবং ভীষ্মপ্রভৃতি কুরুবীরগণকে বিসর্জ্জনপূর্ব্বক কৰ্ণকে স্বীয় রথে সমারূঢ় [এক রথে কৃষ্ণ-কর্ণের প্রস্থান] করিয়া সাত্যকিসমভিব্যাহারে নগর হইতে নিষ্ক্রান্ত হইলেন। অনন্তর কৌরবগণ একত্ৰ হইয়া পরস্পর কহিতে লাগিলেন, “কেশবের কি অদ্ভুত ভাব! সমুদয় পৃথিবী মৃত্যুপাশের বশীভুত হইয়া তাহার শরীরে গুঢ় হইয়া রহিয়াছে। হা! দুৰ্য্যোধনের মুর্খতায় এই রাজ্যাদি কিছুই থাকিবে না।”
এদিকে পুরুষোত্তম নগর হইতে গমন করিয়া বহুক্ষণ কর্ণের সহিত মন্ত্রণা করিলেন। পরে কর্ণকে বিদায় করিয়া অশ্বগণকে মহাবেগে চালন করিতে অনুমতি করিলেন। মনের ন্যায় বেগবান মারুতগতি অশ্বগণ দারুকের নিয়োগানুসারে যেন নভোমণ্ডল গ্রাস করিয়া মহাবেগে গমন করিতে লাগিল এবং আশুগামী শ্যেনের ন্যায় অনতিবিলম্বে অতিবিস্তীর্ণ পথ অতিক্ৰম করিয়া উপপ্লব্য নগরে উপনীত হইল।