১৩৪তম অধ্যায়
বহু অর্থবলের আবশ্যকতা
ভীষ্ম কহিলেন, “হে ধৰ্ম্মরাজ! এই স্থলে ইতিহাসবেত্তা পণ্ডিতগণ এই ধৰ্ম্মবাক্য কীৰ্ত্তন করিয়া থাকেন যে, ক্ষত্রিয়ের সাধুজনাচরিত ধর্ম্ম ও অর্থ এই দুইটি প্রত্যক্ষ সুখ। শাস্ত্রোক্ত ধর্ম্মাধর্ম্ম বিচার করিয়া প্রত্যক্ষ সুখে বিঘ্নোৎপাদন করা কর্ত্তব্য নহে। ভূতলে বৃকপদ-চিহ্ন দর্শন করিয়া উহা বস্তুতঃ বৃকের পদচিহ্ন কি না, এইরূপ বিচারের ন্যায় ধর্ম্মাধর্ম্মবিচার নিরর্থক। এই সংসারমধ্যে কেহই ধৰ্ম্মাধর্ম্মের ফল প্রত্যক্ষ করিতে সমর্থ হয়েন নাই। অতএব বিদ্যাদি দশবিধ বল আয়ত্ত করা কর্ত্তব্য। সমুদয় বস্তুই বলবান ব্যক্তির বশীভূত থাকে। সম্পত্তি থাকিলে বল আয়ত্ত এবং বল আয়ত্ত হইলেই উপযুক্ত অমাত্যগণকে প্রাপ্ত হওয়া যায়। এই জগতে নিৰ্দ্ধন ব্যক্তি পতিত ও অল্পমাত্র দ্রব্যই উচ্ছিষ্ট বলিয়া পরিগণিত হয়। বলবান্ ব্যক্তি অতিমাত্র পাপানুষ্ঠান করিলেও ভয়প্রযুক্ত কেহ তাহা ব্যক্ত করে না। ধর্ম্ম ও বল এই দুইটি সত্যের আশ্রয় লাভ করিলে মানবগণ মহাভয় হইতে পরিত্রাণ প্রাপ্ত হইয়া থাকে। বল ও ধৰ্ম্ম এই উভয়ের মধ্যে বলই শ্রেষ্ঠ। বল হইতে ধৰ্ম্মসম্ভূত হয়। ধূম যেমন সমীরণ আশ্রয় করিয়া উড্ডীন এবং লতা যেমন বৃক্ষকে আশ্রয় ও সুখ যেমন ভোগবান ব্যক্তিকে আশ্রয় করিয়া থাকে; তদ্রূপ ধৰ্ম্ম বলবান ব্যক্তিকে অবলম্বনপূৰ্ব্বক অবস্থান করে। বলবান্ পুরুষদিগের অসাধ্য কিছুই নাই। তাহাদিগের সকল কাৰ্য্যই সৎকার্য্য বলিয়া পরিগণিত হয়। বলহীন ব্যক্তি দুষ্কৰ্ম্ম করিল কদাপি পরিত্রাণলাভে সমর্থ হয় না; সকলেই তাহার দৌরাত্মে উত্যক্ত হয়। মানবগণ ঐশ্বৰ্য্যচ্যুত হইলেই সকলের নিকট অবমানিত হইয়া অতিদুঃখে জীবন ধারণ করে। তৎকালে তাহাদিগের প্রাণধারণ মৃত্যুতুল্য হইয়া উঠে। পণ্ডিতেরা কহেন যে, পাপ ও চরিত্রদোষনিবন্ধন বন্ধুবান্ধববিহীন হইলে মনুষ্যকে পরের বাক্যযন্ত্রণায় নিতান্ত নিপীড়িত হইয়া যারপরনাই অনুতাপ করিতে হয়। পাপ হইতে বিমুক্ত হইবার জন্য ত্রয়ীবিদ্যার [বেদবিদ্যার] আলোচনা, ব্রাহ্মণগণের উপাসনা, দর্শন[দর্শনশাস্ত্রসম্মত—যুক্তিযুক্ত]বাক্যপ্রয়োগ ও কাৰ্য্যদ্বারা তাঁহাদিগের তুষ্টি সম্পাদন, মনের উন্নতিসাধন, মহদ্বংশে পাণিগ্রহণ[বড়-বংশে বিবাহ], আপনার নম্রতা স্বীকারপূর্ব্বক অন্যের গুণকীৰ্ত্তন, কঠোর নিয়ম অবলম্বন পূর্ব্বক জপানুষ্ঠান এবং মিতভাষী ও মৃদুস্বভাব হইয়া লোকের হিতসাধন করা আবশ্যক; বহুতর পাপকাৰ্য্যের অনুষ্ঠান করিলে লোকের নিন্দায় ক্রুদ্ধ না হইয়া ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয়সমাজে সতত অবস্থান ও তাঁহাদের অনুমোদিত কার্য্যের অনুষ্ঠান করা উচিত। এইরূপে সদাচারনিষ্ঠ হইলেই লোকে নিস্পাপ ও সকলের সম্মানভাজন হইয়া ইহলোকে ও পরলোকে উৎকৃষ্ট সুখ লাভ করিতে পারে। ধন বিভাগ করিয়া ভোগ করাই বিধেয়; একাকী গোপনে ভোগ করা কর্ত্তব্য নহে।”