১৩৩তম অধ্যায়
পথিমধ্যে অষ্টাবক্র-জনক সাক্ষাৎকার
“তখন অষ্টবক্ৰ কহিলেন, “হে রাজন! পথিমধ্যে যাবৎকাল ব্রাহ্মণের সাক্ষাৎকার না হয়, তাবৎ অগ্ৰে অন্ধ, তৎপরে বধির, স্ত্রী, ভারবাহ ও রাজারা ক্ৰমান্বয়ে গমন করিবে; কিন্তু ব্ৰাহ্মণের সহিত মিলিত হইলে সর্ব্বাগ্রে ব্রাহ্মণকে পথ প্রদান করিতে হইবে; ব্রাহ্মণের অগ্ৰে কাহারও গমন করা বিধেয় নহে।”
“জনক কহিলেন, “আমি আপনাকে পথ প্ৰদান করিলাম, এক্ষণে আপনার ইচ্ছানুসারে গমন করুন। অগ্নি অল্পপরিমাণ হইলেও তাহার দাহিকা-শক্তির হ্রাস হয় না; ইন্দ্ৰও সর্ব্বদা ব্ৰাহ্মণগণকে নমস্কার করিয়া থাকেন, অতএব আপনি যে স্থানে ইচ্ছা হয়, গমন করুন।”
“অষ্টাবক্র কহিলেন, ‘হে রাজন! আমরা যজ্ঞদর্শন নিমিত্ত যৎপরোনাস্তি কৌতুহলাক্রান্ত হইয়া এখানে আসিয়াছি। আমরা অতিথি; যজ্ঞাঙ্গনে প্রবেশ করিতে অভিলাষী; আপনি অনুগ্রহ করিয়া দ্বারপালকে দ্বার প্রদান করিতে অনুমতি করুন। হে জনক! আমরা যজ্ঞ-দর্শন এবং আপনার সাক্ষাৎকারলাভ ও আলাপ করিবার নিমিত্ত এস্থানে উপস্থিত হইয়াছি। এই দ্বারপাল দ্বার অবরোধ করাতে আমাদের ক্ৰোধানল সাতিশয় প্রজ্বলিত হইয়া আমাদিগকে দগ্ধ করিতেছে।”
দ্বারপালকর্ত্তৃক বালক অষ্টাবক্রের সভাপ্রবেশে বাধা
“তখন দ্বারপাল কহিল, “হে ব্ৰাহ্মণদারক! আমরা বন্দীর আজ্ঞাকারী; আমি যাহা কহিতেছি, শ্রবণ কর। এই যজ্ঞস্থলে বৃদ্ধ বিদগ্ধ ব্ৰাহ্মণগণেরই প্রবেশ করিতে অনুমতি আছে; বালকদিগের প্রবেশের অধিকার নাই।’
“অক্টাবক্ৰ কহিলেন, ‘হে দ্বারপাল! যদি এ স্থানে বৃদ্ধগণ প্ৰবেশ করিতে সমর্থ হয়েন, তবে আমারও ইহাতে প্রবেশের অধিকার আছে, আমি চরিতব্ৰত ও বেদপ্রভাবসম্পন্ন হইয়া বৃদ্ধস্থানীয় হইয়াছি। আমি গুরুশুশ্রূষানিরত, জিতেন্দ্ৰিয় ও জ্ঞানবান; অতএব আমাকে বালকজ্ঞানে অবজ্ঞা করিও না, অগ্নি অল্পমাত্ৰ হইলেও স্পর্শমাত্ৰ দগ্ধ করে।”
“দ্বারপাল কহিল, “হে ব্ৰাহ্মণকুমার! যদি তুমি অভিজ্ঞ হও, তবে মহর্ষিসেবিত একাক্ষর ও বহুরূপ কর্ম্মকাণ্ডাধিক্যসম্পন্ন বাক্য প্রয়োগ কর। তুমি আপনাকে কখন অভিজ্ঞ জ্ঞান করিও না, বৃথা কেন আত্মশ্লাঘা করিতেছ! বিদ্বান অতি সুদূর্লভ।”
“অষ্টাবক্ৰ কহিলেন, “কেবল কায়বৃদ্ধিতেই বৃদ্ধভাব হয় না, উহাতে অনেক জ্ঞানের অপেক্ষা করে, শাল্মলিবৃক্ষেরও অনেক অষ্ঠীলা [বীজ-বিচি] জন্মে, কিন্তু তাঁহাতে উহার কিছুমাত্র সারবত্তা সমুৎপন্ন হয় না। যাহা হ্রস্ব ও কৃশ, কিন্তু ফলবান, সেই পাদপই যথার্থ বৃদ্ধভাবাপন্ন; কিন্তু যাহার ফল নাই, তাহার বৃদ্ধত্ব কোথায়?”
“দ্বারপাল কহিল, বালকগণ বৃদ্ধদিগের নিকট হইতে বুদ্ধি গ্রহণপূর্ব্বক কালক্রমে বৃদ্ধ হইয়া থাকে; কিন্তু অল্পকালমধ্যে জ্ঞানোপার্জ্জন হওয়া অসম্ভব। হে বালক! তুমি বৃথা কেন বৃদ্ধের ন্যায় বাক্যব্যয় করিতেছ?”
“অষ্টবক্ৰ কহিলেন, হে দ্বৌবারিক! কেবল পলিত হইলেই বৃদ্ধ হয় না, কিন্তু যে ব্যক্তি বালক হইয়াও প্রজ্ঞাবান হয়, দেবগণ তাহাকে স্থবির বলিয়া নির্দেশ করেন। কি বয়স, কি পলিত, কি ঐশ্বৰ্য্য, কি বন্ধু কিছুতেই বৃদ্ধ হইতে পারে না; যে ব্যক্তি সাঙ্গ বেদসম্পন্ন, ঋষিগণ তাঁহাকেই মহান বলিয়া নির্ণয় করিয়াছেন। আমরা রাজসভায় বন্দীকে অবলোকন করিবার মানসে আগমন করিয়াছি। হে দ্বারপাল! তুমি জনকনৃপতির নিকট আমার আগমন-বার্ত্তা নিবেদন কর; তুমি অবশ্যই দেখিবে, অদ্য আমি পণ্ডিতগণের সহিত বিচার ও বাদে বন্দীকে নিশ্চয়ই পরাজয় করিব। আমি রাজা ও পুরোহিত্যপ্রমুখ বিদ্বান ব্রাহ্মণেরা সকলে অবাক হইয়া আমার উৎকর্ষ বা অপকর্ষ পরীক্ষা করিবেন।”
“দ্বারপাল কহিল, “হে ব্ৰাহ্মণকুমার! তুমি দশবর্ষবয়স্ক; কিরূপে সুশিক্ষিত ও বিদ্বানদিগের প্রবেশ্য যজ্ঞসভায় প্রবেশ করিবে? আমি কৌশলক্রমে তোমাকে প্রবেশ করাইবার চেষ্টা করিতেছি; তুমিও স্বয়ং যথাবিধি যত্ন কর।”
জনককর্ত্তৃক অষ্টাবক্রের বিদ্যাপরীক্ষা
“তখন অষ্টাবক্ৰ জনক-রাজকে সম্বোধন করিয়া কহিতে লাগিলেন, “হে জনকবংশাবতংস মহারাজ! আপনি সম্রাট ও সর্বৈশ্বৰ্য্যসম্পন্ন, আপনি যজ্ঞীয় কর্ম্মানুষ্ঠানবিষয়ে পূর্ব্বতন রাজা যযাতির ন্যায় প্রশংসাভাজন। শুনিয়াছি, আপনার বন্দী [জনক-রাজের সভাপণ্ডিত] প্ৰভূত বিদ্যাসম্পন্ন; সে বাদে অন্যান্য বিদ্বানদিগকে পরাজয় করিয়া আপনার পুরুষগণদ্বারা জলে নিমজ্জিত করে। হে রাজন! আমি এই কথা শুনিয়া ব্ৰাহ্মণগণের সমীপে অদ্বৈতব্ৰহ্ম কীর্ত্তন করিতে আসিয়াছি। আপনার বন্দী কোথায়? সূৰ্য্য যেমন নক্ষত্রগণকে ধ্বংস করেন, আমিও তদ্রূপ তাহাকে এক্ষণেই বিনাশ করিব।”
“রাজা কহিলেন, “হে ব্ৰাহ্মণবালিক! তুমি বন্দীর বাক্যবল অবগত না হইয়াই উহাকে পরাজয় করিতে বাসনা করিতেছ, ইহা অনুচিত। যাহারা উহার প্রভাব জানেন, তাহারা এরূপ বলিতে পারেন না; অনেকানেক বেদবেত্তা ব্রাহ্মণ তাঁহার বাক্যবিল ও ক্ষমতা অবগত হইয়াছেন। তারকা-সমুদয় যেমন ভাস্করের নিকট শোভমান হয় না, তদ্রূপ অনেকানেক পণ্ডিতগণ উহার নিকট পরাজিত হইয়াছেন। আর যে সমস্ত বিজ্ঞানমত্ত মনীষিগণ বন্দীকে পরাজয় কিরবার মানসে সভায় সুমপস্থিত হয়েন, তাঁহারা তাঁহার নিকটেই পরাজয়প্রাপ্ত ও অপ্রতিভ হইয়া তথা হইতে প্ৰস্থান করেন; সদস্যগণের সহিত বাক্যালাপ করিতে সমর্থ হয়েন না।”
“অষ্টবক্ৰ কহিলেন, “হে রাজন! স্পষ্টই বোধ হইতেছে যে, বন্দী মাদৃশ লোকের সহিত বিবাদ করে নাই; এই নিমিত্তই সিংহের ন্যায় নিৰ্ভয়চিত্তে গর্জ্জন করে। অদ্য সে মৎকর্ত্তৃক পরাজিত হইয়া পথিমধ্যে ভগ্নশকটের ন্যায় নিশ্চল হইয়া থাকিবে।”
“রাজা কহিলেন, “যে ব্যক্তি দ্বাদশ অংশ, চতুর্বিংশতি পর্ব্ব ও ষষ্ট্যধিকত্ৰিশত অরসংযুক্ত পদার্থের অর্থ অবগত আছেন, তিনিই যথার্থ পণ্ডিত।”
“অষ্টবক্ৰ কহিলেন, “হে রাজন! চতুর্বিংশতি পর্ব্ব, ছয় নাভি, দ্বাদশ নেমি ও ষষ্ট্যধিকত্রিশতা অরযুক্ত সেই সদগতি চক্ৰ তোমাকে রক্ষা করুন।”
“রাজা কহিলেন, “যে দুই পদাৰ্থ বড়বাদ্বয়ের ন্যায় সংযুক্ত ও শ্যেনপক্ষীর ন্যায় পতনশীল, দেবগণের মধ্যে কে ঐ দুই পদার্থ প্রসব করেন এবং ঐ পদার্থদ্বয় বা কি প্রসব করে?”
“অষ্টাবক্ৰ কহিলেন, “ঐ দুই পদার্থ যেন তোমার শত্রুর গৃহেও না হয়। মেঘ ঐ দুই পদার্থের প্রসবিতা এবং উহারাও মেঘ উৎপাদনা করিয়া থাকে।”
“রাজা কহিলেন, ‘কে চক্ষু মুদ্রিত না করিয়া নিদ্রা যায়? কে জন্মিয়া স্পন্দিত হয় না? কাহার হৃদয় নাই ও কোন বস্তু বেগে বর্দ্ধিত হয়?”
“অষ্টবক্ৰ কহিলেন, মৎস্য নয়ন মুদ্রিত না করিয়া নিদ্রা যায়, অণ্ড জন্মিয়া স্পন্দিত হয় না, প্রস্তরের হৃদয় নাই, নদী বেগে বর্দ্ধিত হয়।”
“তখন রাজা কহিলেন, “হে ব্ৰাহ্মণকুমার! তোমাকে সামান্য মানুষ বলিয়া বোধ হইতেছে না; তুমি বালক নও, আমি তোমাকে বৃদ্ধ বলিয়া জানিলাম; বাক্যালাপে তোমার তুল্য কেহই নাই, অতএব তোমাকে আমি দ্বার প্রদান করিতেছি, এই বন্দী রহিয়াছেন, অবলোকন কর।”