১৩২তম অধ্যায়
বিদুলার সঞ্জয়-উত্তেজিতকরণ
“বিদুলা বলিলেন, “বৎস! যদি তুমি এই অবস্থায় স্বীয় পৌরুষ পরিত্যাগ করিতে বাসনা কর, তাহা হইলে অচিরাৎ তোমাকে হীনজনের পদবীতে পদার্পণ করিতে হইবে। যে ক্ষত্ৰিয় স্বীয় জীবনরক্ষার্থী হইয়া বিক্রম ও তেজঃ প্ৰকাশ না করে, পণ্ডিতগণ তাহাকে চৌর বলিয়া নির্দ্দেশ করেন। হে পুত্ৰ! যেমন মুমূর্ষ ব্যক্তি ঔষধসেবনে অরুচি প্রকাশ করে, তদ্রূপ। আমার এই অর্থোপপন্ন [অর্থযুক্ত] গুণসংযুক্ত বাক্যে তোমার অরুচি হইতেছে। সিন্ধুরাজের প্রজাগণ তাহার প্রতি সন্তুষ্ট নহে, কেবল আপনাদিগের দৌর্ব্বল্যপ্রযুক্ত তাহার ব্যাসন [পতনরূপ বিপদ] প্রতীক্ষা করিয়া রহিয়াছে। কিন্তু তুমি যদি পৌরুষ প্ৰকাশ না কর, তাহা হইলে তোমার স্বপক্ষগণ সহায়সম্পন্ন। হইলেও শত্রুপক্ষ সমাশ্রয় করিবে। অতএব তুমি এক্ষণে আত্মপক্ষের সহিত মিলিত হইয়া গিরিদুর্গে গমনপূর্ব্বক সিন্ধুরাজের ব্যাসন ও অবসর অনুসন্ধান কর, সিন্ধুরাজ অজর ও অমর নয় ।
“ ‘হে পুত্ৰ! তোমার নাম সঞ্জয়, কিন্তু আমি তোমার নামের সার্থকতা দেখিতেছি না। এক্ষণে সেই সার্থকতা সম্পাদন কর [সঞ্জয়-নিঃশেষরূপে শত্রুজয়], ব্যর্থনামা হইও না। এক বিচক্ষণ ব্ৰাহ্মণ বাল্যাবস্থায় তোমাকে নিরীক্ষণ করিয়া কহিয়াছিলেন, এই বালক প্রথমে মহৎ ক্লেশে নিপতিত হইয়া পরিশেষে পুনরায় সৌভাগ্যশালী হইবে। আমি তাঁহার বাক্য স্মরণ করিয়া তোমার জয় প্রত্যাশা করিতেছি এবং তন্নিমিত্তই তোমাকে বারংবার এইরূপ কহিতেছি। যাহার অর্থসিদ্ধি হইলে আত্মীয়গণ আপ্যায়িত হয়, সে ব্যক্তি অর্থের অনুসরণ করিলে ন্যায়ানুসারে অবশ্যই তাহার অর্থসিদ্ধি হইয়া থাকে। হে পুত্র! তুমি লাভালাভে নিরপেক্ষ হইয়া সংগ্রামে প্ৰবৃত্ত হও; ক্ষান্ত হইও না; শম্বর কহিয়াছেন, একদিনের বা প্ৰাতঃকালের ভোজনসামগ্ৰী না থাকা অপেক্ষা গুরুতর ক্লেশকর অবস্থা আর কিছুই নাই; দরিদ্রতা একপ্রকার মৃত্যু; উহা পতিপুত্রের নিধন অপেক্ষাও অধিকতর দুঃখজনক। আমি মহাকুলপ্ৰসূতা [শ্রেষ্ঠ বংশজাত], এক হ্রদ হইতে অন্য হ্রদে গমনের ন্যায় এই বংশে সমাগত হইয়াছি। আমি সকলের কর্ত্রী ছিলাম; ভর্ত্তা আমাকে পরম সমাদর করিতেন। পূর্ব্বে তুমি আমাকে মহার্হ [অত্যন্ত মূল্যবান] বসন, আভরণ ও মাল্যে বিভূষিত এবং সুহৃদগণে পরিবৃত দেখিয়াছ। এক্ষণে তুমি যখন আমাকে ও তোমার ভাৰ্য্যাকে সাতিশয় দীনভাবাপন্ন দেখিবে, তখন তোমার জীবনধারণ ব্যর্থ বলিয়া বোধ হইবে।
“ ‘হে সঞ্জয়! যদি দাস, কর্ম্মকার [দাস অপেক্ষা কিঞ্চিৎ উন্নতশ্রেণীর কর্ম্মচারী], ভৃত্য [বেতনভোগী বিশিষ্ট কর্ম্মচারী], আচাৰ্য্য, ঋত্বিক ও পুরোহিতগণ জীবিকাপ্ৰাপ্ত না হইয়া আমাদিগকে পরিত্যাগ করেন, তাহা হইলে তোমার জীবনধারণের প্রয়োজন কি? আমি যে পৰ্য্যন্ত পূর্ব্বের ন্যায় তোমার যশস্য [যশোযুক্ত] ও শ্লাঘনীয় [গৌরবান্বিত] কাৰ্য্য না দেখিব, তদবধি কখনই আমার শান্তিলাভ হইবে না। ব্রাহ্মণের নিকট “না” এই কথা বলিতে আমার হৃদয় বিদীর্ণ হইয়া যায়, আমি বা আমার ভর্ত্তা আমরা কেহই কখন ব্রাহ্মণের নিকট “না” বলি নাই। আমরা লোকের আশ্রয়; কখনো পরের আজ্ঞাকারী হই নাই; এক্ষণে যদি আমাকে অন্যের আশ্রয়ে জীবিকা-নির্ব্বাহ করিতে হয়, তাহা হইলে আমি নিশ্চয়ই প্ৰাণ পরিত্যাগ করিব। অতএব হে বৎস! এই অপার অপ্লব [পোতহীন—আশ্রয়াশূন্য] দুঃখসাগরে তুমি প্লবস্বরূপ হইয়া আমাদিগকে পারে নীত কর, স্বস্থানে স্থাপিত কর ও মৃতদেহে জীবন প্ৰদান কর। যদি তোমার জীবনে প্রয়োজন না থাকে, তবে শত্ৰুগণকে উপেক্ষা কর। হে পুত্র! যদি তুমি শক্ৰগণের প্রতি তেজ প্রকাশ না করিয়া নিতান্ত ক্লীবের ন্যায় ব্যবহার করিতে বাসনা কর, তাহা হইলে অচিরাৎ পাপ ক্ষত্ৰিয়বৃত্তি পরিত্যাগ করাই তোমার কর্ত্তব্য।
“ ‘দেখ, বলবান ব্যক্তি একমাত্র শত্ৰু সংহার করিলেও লোকমধ্যে বিখ্যাত হয়। পুরন্দর একমাত্র বৃত্ৰাসুরকে সংহার করিয়াই মহেন্দ্ৰত্ব, লোকের নিয়ন্ত্রিত্ব [লোকপরিচালনার প্রভুত্ব] ও ঈশ্বরকে প্রাপ্ত হইয়াছেন। যে মহাবীর সংগ্রামে আপনার নাম প্রকাশ করিয়া বর্ম্মধারী শত্ৰুগণকে আহ্বান, শত্রুসৈন্যদিগকে বিদ্রাবণ [বিতাড়িত] অথবা রথীদিগকে সংহারপূর্ব্বক মহাদ্যশ লাভ করিতে পারেন, তাহার নিকট শক্রগণেরা ব্যথিত ও বিনত হইয়া থাকে। কাপুরুষেরাই অবশ হইয়া প্ৰাণ পরিত্যাগপূর্ব্বক রণদক্ষ শূর ব্যক্তিগণের সমুদয় বাসনা পরিপূর্ণ করে। সাধু ব্যক্তিরা সমূলে রাজ্য উন্মুলন ও জীবন পরিত্যাগ করেন না এবং শত্রুর শেষ [অবশিষ্ট] রাখেন না। হে পুত্ৰ! রাজ্যই স্বর্গ ও অমৃতের একমাত্র পথ, উহা রুদ্ধ হইয়াছে জ্ঞান করিয়া অগ্নির ন্যায় তাহার অভিমুখে গমন কর। রণে শত্রুগণকে পরাজয় করিয়া স্বধৰ্ম প্রতিপালন কর। তুমি শক্রগণের ভয়াবৰ্দ্ধন, কিন্তু আমি অদ্যাপি তোমাকে এতদৃশ দীনভাবাপন্ন হইতে দেখি নাই। হে পুত্র! আমাদিগকে যেন দীনচিত্তে শোক করিতে করিতে তোমাকে হৃষ্টচিত্তে শত্ৰুগণে পরিবৃত দেখিতে না হয়। তুমি সৌবীরদেশীয় কন্যাগণের সহিত অবস্থান করিয়া আনন্দিত হও; এবং স্বার্থসাধন করিয়া পূর্ব্বের ন্যায় শ্লাঘনীয় হও; সিন্ধুদেশীয় কন্যাগণের বশীভূত হইও না। তোমার তুল্য রূপ, যৌবন, বিদ্যা অভিজনসম্পন্ন [কুলমৰ্য্যাদাশালী] লোকবিশ্রুত, যশস্বী ব্যক্তি যদি ভারবহনকার্য্যে বৃষভের সমরে পরাঙ্মুখ হয়, তাহা হইলে তাহার মরণই শ্ৰেয়ঃ।
“হে বৎস! তোমাকে পরের প্রিয়বাদী ও অনুগামী হইতে দেখিয়া কদাচ শান্তিলাভ করিতে পারিব না। এই কুলসম্ভূত কোন ব্যক্তিই কখন পরের অনুগমন করেন নাই; অতএব তোমারও পরের অনুগামী হইয়া জীবন ধারণ করা কর্ত্তব্য নহে। আমি প্ৰজাপতিকৃত এবং আমাদিগের বংশের ও অন্য বংশের বৃদ্ধগণপ্রোক্ত [৫। বৃদ্ধগণকথিত] শাশ্বত ক্ষত্রিধর্ম্ম পরিজ্ঞাত আছি। যে যে মহাত্মারা আমাদিগের এই কুলে জন্মগ্রহণ করিয়াছেন, তাহারা ভীত হইয়া কদাপি কাহারও নিকট নত হয়েন নাই। ক্ষত্ৰিয়ের পক্ষে উদ্যম নিতান্ত আবশ্যক, নত হওয়া কদাপি উচিত নহে, ক্ষত্ৰিয় বরং অকাণ্ড [বৃথা ভাবে— অন্যায়রূপে] ভগ্ন হইবে, তথাপি নত হইবে না। মহামনাঃ ক্ষত্ৰিয় মত্তমাতঙ্গের ন্যায় পর্য্যটন করিবে ও ধর্মের নিমিত্ত ব্ৰাহ্মণগণের নিকট নত হইবে এবং সহায়সম্পন্ন হউক বা না হউক, লোকদিগকে নিয়মিত ও পাপাত্মাদিগের দণ্ডবিধান করিয়া কালাতিপাত করিবে।”