১৩২তম অধ্যায়
বিজ্ঞানবলের প্রশংসা-প্রসঙ্গে বিবিধ নীতি
যুধিষ্ঠির কহিলেন, “পিতামহ! রাজাদিগের সর্ব্বলোকহিতকর পরমধর্ম্ম বিনষ্ট ও জগতের যাবতীয় বস্তু দস্যুগণকর্ত্তৃক সমাক্রান্ত হইলে ব্রাহ্মণেরা সেই আপৎকালে স্নেহবশতঃ পুত্রপৌত্রদিগকে পরিত্যাগ করিতে না পারিয়া কিরূপে জীবিকা নির্ব্বাহ করিবেন?”
ভীষ্ম কহিলেন, “ধৰ্ম্মরাজ! সেই আপৎকালে বিজ্ঞানবল আশ্রয় করিয়া জীবনযাপন করা ব্রাহ্মণগণের কর্ত্তব্য। পৃথিবীস্থ যাবতীয় ধনধান্যাদি সাধুদিগের নিমিত্তই সৃষ্ট হইয়াছে, অসাধু দিগের নিমিত্ত কোন বস্তুর সৃষ্টি হয় নাই। যে ব্যক্তি শাস্ত্রপথের অনুবর্তী হইয়া অসাধুদিগের নিকট অর্থগ্রহণপূৰ্ব্বক সাধুদিগকে প্রদান করেন, তিনিই আপদ্ধৰ্ম্মের যথার্থ তত্ত্বজ্ঞ। রাজা বিপকালে রাজ্যপালনার্থ প্রজাগণকে প্রকোপিত না করিয়া তাহাদের অদত্ত বস্তুও গ্রহণ করিতে পারেন। বিজ্ঞানবসম্পন্ন পুণ্যবান ব্যক্তি আপৎকালে গর্হিত কার্য্যের অনুষ্ঠান করিলেও কেহ তাঁহাকে নিন্দা করিতে পারে না। বলপূৰ্ব্বক জীবিকালাভ করাই যাঁহাদের চিরাচরিত ধৰ্ম্ম, তাঁহারা কদাচ অন্যবৃত্তি আশ্রয় করিয়া সন্তোষলাভ করিতে পারেন না। বলবান্ ব্যক্তিরা তেজঃপ্রকাশ করিয়াই কালযাপন করেন। রাজারা আপৎকালে স্বরাষ্ট্রস্থ সমুদয় ব্যক্তির নিকট হইতে কোষসংগ্রহ করিয়া থাকেন, কিন্তু মেধাবী নরপতিগণ ঐ সময় কদৰ্য্যস্বভাব, দণ্ডার্হ ব্যক্তিদিগের দণ্ডবিধান করিয়াই ধনসঞ্চয় করেন। অত্যন্ত আপদ উপস্থিত হইলেও ঋত্বিক্, পুরোহিত, আচার্য্য ও অন্যান্য ব্রাহ্মণগণকে নিপীড়িত করিয়া অর্থ সংগ্রহ করা রাজাদিগের কর্ত্তব্য নহে। যে নরপতি ঐরূপ কাৰ্য্যে হস্তক্ষেপ করেন, তাঁহাকে অগাধ পাপপঙ্কে লিপ্ত হইতে হয়। আমি এক্ষণে যাহা কহিলাম, ইহা অতি প্রামাণিক ও লোকের দিব্যচক্ষুঃস্বরূপ। লোকে ইহার অনুসারে ব্যবহার করিতে পারিলেই সাধুপদবাচ্য হইয়া থাকে। গ্রামবাসী অসংখ্য লোক রোষপরবশ হইয়া রাজার নিকট পরস্পরের দোষ কীৰ্ত্তন করিয়া থাকে; তাহাদিগের বাক্যে বিশ্বাস করিয়া কাহাকেও সৎকৃত বা নিপীড়িত করিবেন না। লোকের পরীবাদকীৰ্ত্তন বা শ্রবণ করা কদাপি বিধেয় নহে। যে সভায় পরের নিন্দা কীৰ্ত্তিত হয়, তথায় হস্তদ্বারা কর্ণ আচ্ছাদন বা তথা হইতে প্রস্থান করাই কর্ত্তব্য। অসচ্চরিত্র লোকেরাই পরনিন্দা ও পরের প্রতি ক্রূরাচরণ করে। সাধুব্যক্তিরা সতত সাধুদিগের গুণই কীৰ্ত্তন করিয়া থাকেন। শান্তস্বভাব বৃষভ যেমন যত্নপূৰ্ব্বক ভার বহন করে, নরপতিও সেইরূপ রাজ্যভার বহন করিবেন। যাহাতে অনেকের সাহায্য লাভ করা যায়, এইরূপ কাৰ্য্যের অনুষ্ঠান করা ভূপতির অবশ্য কর্ত্তব্য। অনেকে চিরাচরিত প্রথাকেই প্রধান ধর্ম্ম বলিয়া বিবেচনা করেন, কিন্তু কেহ কেহ উহা স্বীকার করেন না। তাঁহারা কহেন যে, পুরোহিতাদি মান্য ব্যক্তিগণও অপরাধী হইলে তাঁহাকে দণ্ডবিধান করা অবশ্য কর্ত্তব্য। ঐ সকল লোক যে মাৎসর্য্য বা লোভের বশীভূত হইয়া ঈদৃশ বাক্য প্রয়োগ করেন, এরূপ বিবেচনা করিও না; বস্তুতঃ তাঁহারা লিখিতের প্রতি শঙ্খের ব্যবহারানুসারে ধর্ম্মানুরোধেই ঐরূপ কহিয়া থাকেন। অনেক মহর্ষি কুকর্ম্মশীল গুরুরও শাসন করা কর্ত্তব্য বলিয়া নির্দেশ করিয়া গিয়াছেন। যাহা হউক, বস্তুতঃ ঐরূপ কার্য্যে হস্তক্ষেপ করা উচিত নহে। লোকে কুকর্ম্মে প্রবৃত্ত হইলে দেবতারা তাহাকে নিপাতিত করিয়া থাকেন। যে রাজা ছলপূৰ্ব্বক অর্থগ্রহণ করেন, তাহাকে ধর্ম্মচ্যুত হইতে হয়। সর্ব্বাত্মসৎকৃত [সকলের প্রতি সাধু ব্যবহারমূলক] ধৰ্ম্ম চারিপ্রকার বেদনির্দ্দিষ্ট, স্মৃতিনিৰ্দিষ্ট, সাধুজনাচরিত ও আত্মবিচারসিদ্ধ। এই চতুর্ব্বিধ ধৰ্ম্মই অবগত হওয়া রাজাদিগের আবশ্যক। যে নরপতি তর্কশাস্ত্র, বেদশাস্ত্র, বার্ত্তাশাস্ত্র ও দণ্ডনীতিশাস্ত্রের অনুমোদিত ধর্ম্ম পরিজ্ঞাত হইতে পারেন, তিনিই যথার্থ ধৰ্ম্মজ্ঞ। সর্পপদের ন্যায় ধৰ্ম্মমূল অন্বেষণপূর্ব্বক প্রকাশ করা অতি সুকঠিন। নিষাদগণ যেরূপ অরণ্যমধ্যে শরাহত মৃগের রুধিরাক্ত পদচিহ্ন লক্ষ্য করিয়া তাহার অন্বেষণ করে, সেইরূপ ধৰ্ম্মের মর্ম্ম অন্বেষণ করা বুদ্ধিমানের কর্ত্তব্য। পূর্ধ্বতন রাজর্ষিরা সাধুদিগের অবলম্বিত পথই আশ্রয় করিয়া গিয়াছেন; অতএব তুমি এক্ষণে তাঁহাদিগের ন্যায় সেই পথ আশ্রয় কর।”