১৩২তম অধ্যায়
অষ্টাবক্ৰ-শ্বেতকেতু-বৃত্তান্ত
লোমশ কহিলেন, “হে নরেন্দ্ৰ! যে মন্ত্রবিদগ্ধবুদ্ধি উদ্দালকতনয় শ্বেতকেতু পৃথিবীতলে অদ্যপি বিখ্যাত রহিয়াছেন, এই সেই মহৰ্ষির নানাবিধফলশালী আশ্রমপদ দৃষ্ট হইতেছে। শ্বেতকেতু এই স্থানে মানুষ-রূপধারিণী সাক্ষাৎ সরস্বতীকে সন্দর্শন করিয়া কহিয়াছিলেন যে, “আমি বাণীকে জানিবার নিমিত্ত তপস্যা করিতেছি।” হে রাজন! ঐ যুগে কহোড়নন্দন অষ্টবক্র ও উদ্দালকাতনয় শ্বেতকেতু এই দুই বেদবিদগণের অগ্রগণ্য মুনি ছিলেন; উহাদের পরস্পর মাতুলভাগিনেয় সম্পর্ক। উঁহারা দুইজনে মহীমতি বিদেহরাজের যজ্ঞায়তনে প্রবেশপূর্ব্বক বিবাদবিষয়ে বন্দীকে নিগ্ৰহ করিয়াছিলেন। যে অষ্টবক্ৰ জনকরাজের যজ্ঞে বাদী হইয়া বাদানুবাদে বন্দীকে পরাজয় করিয়া নদীতে নিমগ্ন করেন, সেই অষ্টাবক্র উদ্দালকের দৌহিত্র। হে কৌন্তেয়! তুমি ভ্রাতৃগণ-সমভিব্যাহারে সেই মহর্ষি উদ্দালকের আশ্রমে প্রবেশপূর্ব্বক কিয়ৎকাল বাস করা।
যুধিষ্ঠির কহিলেন, “হে ব্ৰহ্মন! যে অষ্টাবক্র বন্দীকে নিগ্ৰহ করিয়াছিলেন, তাহার প্রভাব কি প্রকার? আর কি নিমিত্তই বা তিন অষ্টবক্রনামে বিখ্যাত হইলেন? এই সমুদয় বৃত্তান্ত বিশেষরূপে বর্ণন করুন।”
লোমশ কহিলেন, “হে রাজন্! মহির্ষি উদ্দালকের কহোড়নামে এক শিষ্য ছিলেন। কহোড় সতত আচাৰ্য্যের বশবর্ত্তী ও শুশ্রূষাপরবশ হইয়া বহুকাল অধ্যয়ন করিয়াছিলেন। তিনি সর্ব্বদা একাগ্ৰচিত্তে স্বীয় আচাৰ্য্যের পরিচর্য্যা করিতেন। মহর্ষি উদালক তাঁহার পরিচর্য্যাদর্শনে প্রসন্ন হইয়া তৎক্ষণাৎ তাঁহাকে সমুদয় শ্রুতি প্রদানপূর্ব্বক স্বীয় কন্যা সুজাতার সহিত তাঁহার বিবাহ দিলেন। কিয়দ্দিনানন্তর সুজাতা গৰ্ভধারণ করিলেন।
অষ্টাবক্র-জন্মবৃত্তান্ত
“একদা সুজাতার গর্ভস্থিত হুতাশনসম প্রভাবসম্পন্ন বালক মাতৃগর্ভ হইতে অধ্যয়নশীল স্বীয় পিতা কহোড়কে কহিলেন, “হে তাত! আপনি সমস্ত রাত্রি অধ্যয়ন করেন, কিন্তু আপনার অধ্যয়ন সম্যক হয় না। আমি আপনার প্রসাদে এই গর্ভাবস্থাতেই সমুদয় সাঙ্গ বেদ ও সমস্ত শাস্ত্ৰ অধ্যয়ন করিয়াছি; অতএব আমি শ্রবণ করিতেছি, আপনার অধ্যয়ন উত্তমরূপ হইতেছে না।” মহর্ষি কহোড় শিষ্যগণমধ্যে গর্ভস্থ বালককর্ত্তৃক এইরূপ অবমানিত হইয়া রোষাভরে তাঁহাকে শাপ প্রদান করিলেন, “তুমি গর্ভে থাকিয়া আমার প্রতি এইরূপ অবমাননাবাক্য প্রয়োগ করিতেছ; অতএব তোমার কলেবরের অষ্টস্থল বক্র হইবে।” কহোড়-নন্দন পিতার শাপানুসারে বক্র হইয়াই জন্মপরিগ্রহ করিলেন; এই নিমিত্ত তাঁহার নাম অষ্টবক্ৰ বলিয়া বিখ্যাত হয়। শ্বেতকেতু অষ্টাবক্রের মাতুল ও তাঁহার সমবয়স্ক ছিলেন।
“ক্রমে ক্রমে গর্ভের উপচয় হওয়াতে সুজাতা সাতিশয় পীড্যমানা হইয়া নির্জ্জনে স্বীয় স্বামী কহোড়কে প্রসন্ন করিয়া কহিলেন, “হে মহর্ষে। আমার দশম মাস সমুপস্থিত; আপনি নিতান্ত নির্ধন; এ সময়ে অর্থ ব্যতীত আমি কিরূপে এই বিপদ হইতে মুক্ত হইব? কহোড় ভাৰ্য্যার বাক্যশ্রবণে ধনার্থী হইয়া জনকরাজের নিকট গমন করিলে তত্রত্য বাদবেত্তা বন্দী তাঁহাকে বাদে পরাজয় করিয়া জলে নিমগ্ন করিল। মহর্ষি উদ্দালক স্বীয় জামাতার বৃত্তান্ত অবগত হইয়া সুজাতার নিকট সমুদয় প্রকাশপূর্ব্বক কহিলেন, “বৎসে! তোমার পুত্ৰ যেন এই বৃত্তান্ত কোনপ্রকারে অবগত হইতে না পারে।” সুজাতা স্বীয় পিতৃবাক্যানুসারে সেই বৃত্তান্ত নিজ তনয়ের অগোচরে রাখিলেন। তন্নিমিত্ত অষ্টবক্র ভূতলে জন্মগ্রহণ করিয়াও ঐ বৃত্তান্ত অবগত হইতে সমর্থ হয়েন নাই। তিনি উদ্দালককে পিতা ও শ্বেতকেতুকে ভ্ৰাতা বলিয়া জানিতেন।
অষ্টাবক্রের জনক-যজ্ঞসভায় গমন
“ক্রমে অষ্টাবক্রের দ্বাদশবর্ষ-বয়ঃক্রম হইলে একদা তিনি উদ্দালকের অঙ্গে উপবিষ্ট আছেন, এমত সময়ে শ্বেতকেতু ঈৰ্যাপরবশ হইয়া তাহাকে হস্তধারণপূর্ব্বক আকর্ষণ করিলে তিনি ক্ৰন্দন করিতে লাগিলেন। তখন শ্বেতকেতু কহিলেন, “হে অষ্টবক্র! এ তোমার পিতৃক্রোড় নহে।” অষ্টাবক্ৰ শ্বেতকেতুর এইরূপ দুরুক্তি-শ্রবণে সাতিশয় বিরক্ত হইয়া দুঃখিতচিত্তে গৃহে গমনপূর্ব্বক স্বীয় মাতাকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “জননি! আমার পিতা কোথায়?” সুজাতা পুত্রের বাক-শ্রবণে সাতিশয় দুঃখিত ও শাপভায়ে একান্ত ভীত হইয়া তাঁহাকে সমুদয় বৃত্তান্ত কহিলেন। তখন অষ্টবক্ৰ মাতৃমুখে সমুদয় বৃত্তান্ত অবগত হইয়া রজনীযোগে শ্বেতকেতুকে কহিলেন, “কল্য আমরা দুইজনে জনক-রাজের যজ্ঞে গমন করিব। শ্রবণ করিয়াছি, ঐ যজ্ঞ বহুবিধ আচাৰ্য্যে পরিপূর্ণ; আমরা তথায় গমন করিয়া ব্ৰাহ্মণগণের বিবাদ শ্রবণ ও বিপুল অর্থ উপার্জ্জন করিব, তত্ৰত্য শান্ত ও সৌম্য ব্ৰহ্মঘোষশ্রবণে [বেদধ্বনি-শাস্ত্রবাক্য] আমাদের বিচক্ষণাত্বলাভ হইবে।”
“অনন্তর মাতুল ও ভাগিনেয় উভয়ে জনক-রাজের যজ্ঞে গমন করিলেন। পথিমধ্যে রাজার সহিত তাঁহাদের সাক্ষাৎকারলাভ হওয়াতে তাহারা গমনে নিবারিত হইলেন।”