১৩১তম অধ্যায়
কুন্তীকথিত বিদুলাসঞ্জয়সংবাদ
কুন্তী কহিলেন, “হে বৎস! এই স্থলে বিদুলাসঞ্জয়সংবাদ কহিতেছি, শ্রবণ কর, পরে যাহা শ্রেয়স্কর হয়, করিবে। ক্ষত্রিয়কুলসম্ভূতা, যমস্বিনী, সাতিশয় ক্ষাত্রধর্ম্মনিরতা, ক্ৰোধপরায়ণা, দীর্ঘদর্শিনী বিদুলানামে এক রমণী ছিলেন। ঐ রাজসমাজবিশ্রুত বহুশাস্ত্রভিজ্ঞ কামিনী একদা স্বীয় পুত্ৰ সঞ্জয়কে সিন্ধুরাজকর্ত্তৃক পরাজিত ও দীনের ন্যায় শয়ান দেখিয়া আক্ষেপ করিয়া কহিতে লাগিলেন, ‘হা অরতিহর্ষবৰ্দ্ধন কুসন্তান। তুমি আমার গর্ভে বা তোমার পিতার ঔরসে জন্মগ্রহণ কর নাই [পিতার তুল্য বলবীর্য্য যুক্ত হও নাই], কোন অজ্ঞাত প্রদেশ হইতে আগমন করিয়াছ। তুমি ক্ৰোধ-শূন্য, অগণনীয়, নিবীৰ্য্য পুরুষের ন্যায় যাবজ্জীবন নিরাশ হইয়া কালাতিপাত করিতেছ। তুমি এক্ষণে কল্যাণকর ভার গ্রহণ কর, আত্মাবমাননা করিও না, অল্পে সন্তুষ্ট হইও না, নিৰ্ভয়চিত্তে শ্রেয়স্কর কাৰ্য্যে মনোযোগ কর।
“ ‘হে কাপুরুষ! গাত্ৰোত্থান কর, পরাজিত হইয়া শক্রগণের হর্ষ ও মিত্ৰগণের শোকবৰ্দ্ধনপূর্ব্বক শয়ান থাকিও না। কুনদী অল্পজলে পরিপূর্ণ হয়, মুষিকের অঞ্জলি অল্পদ্রব্যে পূর্ণ হয় এবং কাপুরুষ অল্পমাত্র লাভেই সন্তুষ্ট হইয়া থাকে। হে অধম! যেমন সৰ্পদষ্ট কুকুর কদাচ নিধনপ্রাপ্ত হয় না, তদ্রূপ অরিপরাজিত হইয়া প্ৰাণত্যাগ করিও না অথবা জীবনে নিরপেক্ষ হইয়াও পরাক্রম প্রকাশ কর। তুমি শ্যেনপক্ষীর ন্যায় পরিভ্রমণপূর্ব্বক আক্রোশ বা তুষ্ণীম্ভাব অবলম্বন করিয়া আশঙ্কিতচিত্তে শত্রুর ছিদ্রান্বেষণে তৎপর হও। কি নিমিত্ত বজ্রাহত মৃতের ন্যায় শয়ান রহিয়াছ? গাত্ৰোত্থান কর, শক্রহস্তে পরাজিত হইয়া নিদ্রিত হইও না। তুমি অন্তগত [যমের মুখে প্রবিষ্ট] না হইয়া স্বকৰ্মদ্বারা বিখ্যাত হও, মধ্যম উপায় সন্ধি, অধম উপায় ভেদ ও নীচ উপায় দান, এইসকল উপায় অবলম্বন করিবার মানস করিও না; উত্তম উপায় দণ্ড, ইহা অবলম্বন করিবার চেষ্টা কর। তিন্দুককাষ্ঠের অলাতের [গাবকাষ্ঠের অঙ্গার] ন্যায় মুহূর্ত্তমধ্যে প্ৰজ্বলিত হও, জীবনাভিলাষী হইয়া তুষাগ্নির ন্যায় চিরকাল ধূমায়িত হইও না। চিরকাল ধূমায়িত হওয়া অপেক্ষা ক্ষণকালও প্রজ্বলিত হওয়া শ্ৰেয়ঃ। কোন ভূপতি-গৃহে যেন নিতান্ত প্রখর বা নিতান্ত মৃদু পুত্র জন্মগ্রহণ না করে। লোকে সংগ্রামে গমনপূর্ব্বক মনুষ্যের উৎকৃষ্ট কাৰ্য্য সম্পাদন করিয়া ধর্মের অনৃণ্যত্ব ও আত্মপ্রসাদ লাভ করে। পণ্ডিত ব্যক্তিরা লাভ হউক বা না হউক, কিছুতেই তাপিত হয়েন না। ফলতঃ তাঁহারা ধনতৃষ্ণা পরিত্যাগ করিয়া অবিচ্ছেদে বলসাধ্য কাৰ্য্যে প্রবৃত্ত হইয়া থাকেন। হে পুত্ৰ! হয় স্বীয় প্রভাব উদ্ভাবনে প্রবৃত্ত হও, নচেৎ প্ৰাণ পরিত্যাগ কর; ধর্ম্মনিরপেক্ষ হইয়া [অপেক্ষা না রাখিয়া—উপেক্ষা করিয়া] জীবিত থাকিবার কিছুমাত্র আবশ্যক নাই। হে ক্লীব [দুর্ব্বল]! তোমার ইষ্টপূর্ত্ত বিনষ্ট হইয়াছে, কীর্ত্তিসকল বিলুপ্ত হইয়াছে ও ভোগমূল রাজ্যধন বিচ্ছিন্ন হইয়াছে; তবে আর কি নিমিত্ত বৃথা জীবনধারণ করিতেছ? বুদ্ধিমান ব্যক্তি আপনার পতনসময়েও শত্রুর জঙ্ঘা গ্রহণপূর্ব্বক তাহার সহিত নিপতিত হয়, ছিন্নমূল হইলেও কদাপি ভগ্নোদ্যম হয় না এবং আজানেয় [ছাগ] অশ্বের দৃষ্টান্তানুসারে উদ্যমসহকারে ভারবহন করে। হে পুত্র! স্বীয় পুরুষকার, সত্ত্ব ও মান অবলম্বন কর। এই কুল তোমার দোষেই নিমগ্নপ্রায় হইয়াছে; অতএব তুমি ইহার উদ্ধার কর।
“ ‘লোকে যাহার অদ্ভুত মহৎ চরিত্রের বিষয় জল্পনা না করে, সে স্ত্রীও নয়, পুরুষও নয়, তাহার জন্ম কেবল সংখ্যা-বৰ্দ্ধনের [একজন জন্মিল এইমাত্র সংখ্যাগণনার আধিক্যের জন্ম-নিষ্ফল] নিমিত্ত। দান, তপস্যা, সত্য, বিদ্যা ও অর্থলাভ বিষয়ে যাহার যশ উচ্চারিত না হয়, সে কেবল মাতার মলস্বরূপ। যে ব্যক্তি অধ্যয়ন, তপস্যা, সম্পত্তি, বিক্রমপ্রভৃতি কৰ্মদ্বারা অন্যকে পরাভব করিতে সমর্থ হয়। সেই যথার্থ পুরুষ! হে পুত্ৰ! মূর্খের ন্যায়, কাপুরুষের ন্যায় অযশস্কর দুঃখজনক ভিক্ষাবৃত্তি অবলম্বন করা তোমার কদাপি বিধেয় নহে। শত্রুগণ যে ব্যক্তিকে অভিনন্দন করে এবং যে ব্যক্তি লোকে অবজ্ঞাত, গ্রাসাচ্ছাদনবিহীন [ভোজন ও পরিধেয় বস্ত্ৰ], হীনবীৰ্য্য ও নীচাশয় বন্ধুগণ তাহাকে প্রাপ্ত হইয়া কখনই সুখী হয় না।
“নিশ্চয়ই বোধ হইতেছে, আমাদিগকে রাজ্য হইতে প্রবাসিত, সর্ব্বকামে বঞ্চিত ও দীনভাবাপন্ন হইয়া জীবিকভাবে প্ৰাণ পরিত্যাগ করিতে হইবে। হে পুত্র! তুমি অমঙ্গলকারী সৎকুলনাশক কলি, পুত্ররূপে আমার গর্ভে জন্ম পরিগ্রহ করিয়াছ। কোন কামিনী যেন ক্ৰোধ-শূন্য, নিরুৎসাহ, নিবীৰ্য্য, শক্ৰকুলের আনন্দজনক পুত্র প্রসব না করে। হে বৎস! আর ধূমায়িত [ধূমিত—ধূমময়] হইও না, প্রজ্বলিত হইয়া শত্ৰু সংহার করে, অরাতিকুলের মস্তকোপরি মুহুর্ত্তকাল প্রজ্বলিত হওয়াও শ্রেয়ঃ, অমর্ষপরায়ণ ও ক্ষমাশূন্য ব্যক্তিই যথার্থ পুরুষ, ক্ষমাবান ও অমর্ষহীন লোক স্ত্রীও নয়, পুরুষও নয় [বলবীৰ্য্য ব্যাখ্যা; অন্যত্র নহে]। সন্তোষ, দয়া শক্রগণের প্রতি অনুত্থান [শত্রুর বিরুদ্ধে না দাঁড়ান] ও ভয় শ্ৰীনাশের প্রধান কারণ আর নিরীহ ব্যক্তি কদাচ মহত্ত্বলাভ করিতে সমর্থ হয় না। অতএব এক্ষণে তুমি পরাভবরূপ দোষ হইতে আত্মাকে মুক্ত ও হৃদয় লৌহতুল্য করিয়া পুনরায় স্বার্থসাধনে তৎপর হও। পরের পরাক্রম সহ্য করিতে পারে বলিয়া নরের নাম পুরুষ হইয়াছে, যে নর স্ত্রীলোকের ন্যায় নিরীহভাবে কালাতিপাত করে, তাহার পুরুষনামের কিছুই সার্থকতা থাকে না। অতিশূর সিংহবিক্ৰান্ত মহাশয় ব্যক্তি মৃত হইলেও তাঁহার বিষয়স্থ [অধিকারস্থিত] প্ৰজাগণ পরমসুখে কালাতিপাত করে। যে ব্যক্তি আপনার প্রিয়কাৰ্য্য ও সুখ পরিত্যাগপূর্ব্বক সম্পত্তিলাভের চেষ্টা করে, সে অচিরাৎ অমাত্যগণকে হৃষ্ট করিতে পারে।”
“তখন সঞ্জয় তাঁহাকে কহিলেন, “মাতঃ! যদি আমি তোমার নেত্ৰপথ হইতে অন্তর্হিত হই, তাহা হইলে তোমার আভরণ, ভোগসমুদয়, পৃথিবী বা জীবনে প্রয়োজন কি?”
“বিদুল কহিলেন, “বৎস! আমার বাসনা এই যে, তোমার শত্ৰুগণ অনাদৃত ব্যক্তিগণের ও মিত্ৰগণ আদৃত ব্যক্তিদিগের প্রাপ্যলোক প্রাপ্ত হউক। তুমি ভৃত্যবৰ্গকর্ত্তৃক পরিত্যক্ত পরপিণ্ডোপজীবী [পরান্নভোজনে জীবনধারণকারী] সত্ত্বশূন্য [তেজোবীৰ্য্যহীন] দীনগণের বৃত্তির অনুবর্ত্তন করিও না। যেমন প্রাণীগণ মেঘের প্রভাবে ও দেবগণ সুররাজের প্রভাবে জীবিত থাকেন, তদ্রূপ ব্ৰাহ্মণ ও সুহৃদগণ তোমার অনুগ্রহে জীবিকা নির্ব্বাহ করুন। প্রাণীগণ পক্কফলশালী পাদপের ন্যায়। যাঁহাকে প্রাপ্ত হইয়া জীবিকা নির্ব্বাহ করে তাহারই জীবন সার্থক। যে মহাবল পরাক্রান্ত বীরের বলবিক্রমে বান্ধবগণ সুখী হয়েন, তাহারই জীবন ধন্য। যে ব্যক্তি স্বীয় বাহুবলপ্ৰভাবে জীবিকা নির্ব্বাহ করে, সে ইহলোকে বিপুল কীর্ত্তি ও পরলোকে সদগতি লাভ করিতে পারে।’ ”