১৩০তম অধ্যায়
কৃষ্ণের কুন্তীসমীপে কর্ত্তব্যজ্ঞাপন
অনন্তর বাসুদেব কুন্তীর আলয়ে গমনপূর্ব্বক তাঁহাকে অভিবাদন করিলেন এবং কৌরব সভামধ্যে যে ঘটনা হইয়াছিল, সংক্ষেপে সেই সমুদয় বৃত্তান্ত কহিতে আরম্ভ করিলেন, “হে দেবি! আমি ও ঋষিগণ আমরা সকলেই দুৰ্য্যোধনকে বহুবিধ হেতুযুক্ত বাক্য কহিয়াছিলাম; সে তাহা গ্ৰহণ করিল না। কালক্রমে দুৰ্য্যোধনের অনুগত সকলেরই শেষদশা সমুপস্থিত হইয়াছে; অতএব আপনাকে আমন্ত্রণ করিয়া আমি পাণ্ডবগণের নিকট গমন করিব। এক্ষণে যদি পাণ্ডবগণের প্রতি আপনার কিছু বক্তব্য থাকে, বলুন; আমি তাহা শ্রবণ করিতে অভিলাষ করি।”
কুন্তীকর্ত্তৃক যুদ্ধার্থ যুধিষ্ঠিরের উদবোধন
কুন্তী কহিলেন, “কেশব! ধর্ম্মাত্মা রাজা যুধিষ্ঠিরকে এই কথা কহিবে যে, হে পুত্ৰ! তোমার পৃথিবীপালনজনিত প্রচুর ধর্ম্ম বিনষ্ট হইতেছে; অতএব আর প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করিও না। যেমন বেদার্থজ্ঞানশূন্য বেদাধ্যায়ী ব্যক্তির বুদ্ধি নিরন্তর বেদাধ্যয়নে কলুষিত [নিষ্ফল] হয়, তদ্রূপ তোমার বুদ্ধি ধর্ম্মানুষ্ঠানে অভিভূত [আসক্ত] হইয়া কেবল ধর্মের দিকেই ধাবমান হইতেছে। হে বৎস! ভগবান ব্ৰহ্মা যে প্রকারে ধর্মের সৃষ্টি করিয়াছেন, তাঁহার প্রতি দৃষ্টিপাত কর। তিনি ক্রুরকর্ম্মবিগ্রহদ্বারা প্ৰজাগণকে প্রতিপালন করিবার নিমিত্ত বাহু হইতে বাহুবীৰ্য্যোপজীবী [বাহুবলে জীবিকাকারী] ক্ষত্ৰিয়গণকে উৎপাদন করিয়াছেন। আমি বৃদ্ধগণের নিকট এই বিষয়ের একটি দৃষ্টান্ত শ্রবণ করিয়াছি; এক্ষণে তুমি তাহা শ্রবণ কর।”
“পূর্ব্বকালে কুবের প্রীত হইয়া রাজর্ষি মুচুকুন্দকে এই পৃথিবী প্রদান করিয়াছিলেন; মুচুকুন্দ নিজভুজবীৰ্য্যে অর্জিতরাজ্য ভোগ করিবার বাসনায় তাঁহার দান গ্ৰহণ করিলেন না। কুবের তদ্দর্শনে অধিকতর প্রীতি ও বিস্মিত হইলেন। অনন্তর রাজর্ষি মুচুকুন্দ ক্ষাত্রধর্ম্ম অনুসারে বাহুবলসমুপার্জিত বসুন্ধরা শাসন করিতে লাগিলেন।
“হে পুত্র! রাজাকর্ত্তৃক সুরক্ষিত প্ৰজাগণ যত ধর্ম্ম উপার্জ্জন করে, রাজা তাহার চতুর্থভাগ প্রাপ্ত হয়েন। রাজা যে ধর্ম্ম উপার্জ্জন করেন, তাহা তাহার দেবত্বলাভের কারণ হয়; আর তিনি অধর্ম্ম আচরণ করিলে নিরয়গামী হইয়া থাকেন। স্বামীকর্ত্তৃক সম্যক প্রযুক্ত দণ্ডনীতি চারিবর্ণকে স্ব স্ব ধর্মে নিয়োজিত ও আবদ্ধ করে। যখন রাজা অখণ্ড দণ্ডনীতি অবলম্বন করিয়া স্বীকার্য্য সম্পাদন করেন, তখন সর্বোত্তম সত্যযুগ প্রবর্ত্তিত হয়। হে বৎস! সময়ের গুণে বিশেষ বিশেষ রাজা সমুৎপন্ন হয়েন, কি রাজা হইতেই বিশেষ বিশেষ সময় প্রবর্ত্তিত হয়, এরূপ সংশয় করিও না; কেন না, রাজারাই বিশেষ বিশেষ কাল প্রবর্ত্তিত করেন। রাজাই সত্যযুগের স্রষ্টা; রাজাই ত্রেতাযুগের প্রবর্ত্তক; রাজাই দ্বাপরযুগের নিদান এবং রাজাই কলিযুগের কারণ। যে রাজা সত্যযুগ প্রবর্ত্তিত করেন, তিনিই অখণ্ড স্বৰ্গভোগ করিয়া থাকেন; ত্ৰেতাযুগের প্রবর্ত্তক রাজা তদপেক্ষা কিঞ্চিদৃণ স্বৰ্গভোগে সমর্থ হয়েন, যিনি দ্বাপরযুগের সৃষ্টি করেন, তিনি স্বৰ্গফলের অৰ্দ্ধ ভোগ করিতে পারেন; কিন্তু কলিযুগের প্রবর্ত্তক রাজাকে সম্পূর্ণ পাপভোগ করিতে হয়। দুষ্কর্ম্ম রাজা চিরকাল নরকে বাস করেন। রাজদৌষে জগৎকে ও জগতের দোষে রাজাকে পাপভাগী হইতে হয়।
“অতএব তুমি পিতৃপিতামহাদিপরম্পরাগত রাজধর্মের প্রতি দৃষ্টিপাত কর; তুমি যেরূপে অবস্থান করিতে অভিলাষ করিতেছ, তাহা রাজর্ষিদিগের ধর্ম্ম নয়। দুর্ব্বল ও দয়ালু রাজা কিছুমাত্র প্রজাপলিনসম্ভূত ফললাভ করিতে সমর্থ হয়েন না। তুমি এক্ষণে যেরূপ আচরণ করিতেছ, কি আমি, কি পাণ্ডু, কি পিতামহ, কি তোমার পূর্ব্বপুরুষগণ—আমরা কেহই তোমাকে এরূপ আশীর্ব্বাদ করি নাই। আমি তোমাকে প্রতিনিয়ত এই কহিয়াছি যে, তুমি যজ্ঞ, দান, তপস্যার অনুষ্ঠান করিবে এবং শৌৰ্য্য, প্রজ্ঞা, সন্তান, মাহাত্ম্য, বল ও তেজঃ লাভ করিবে। মনুষ্য ও দেবতাগণ সম্যক আরাধিত হইলে ইহলোকে দীর্ঘ আয়ু, ধন ও পুত্র এবং পরলোকসাধন স্বাহা [*যজ্ঞাদিদ্বারা অগ্নিসেবা এবং শ্ৰাদ্ধাদিদ্বারা পিতৃপূজা করিবার সুযোগ] ও স্বধা [*] প্ৰদান [*] করেন। পিতা, মাতা ও দেবগণ পুত্রের নিকট হইতে নিরন্তর দান, অধ্যয়ন, যজ্ঞ ও প্ৰজাপালন অভিলাষ করিয়া থাকেন। বৎস! আমি যাহা কহিলাম, উহা ধর্মোপেত বা অধৰ্মযুক্ত, তাহা জানি না; কিন্তু উহা আমার স্বভাবতঃ সমুৎপন্ন হইয়াছে; অতএব ইহা বিবেচনা করিয়া কর্ম্ম করিবে। দেখ, তোমরা বেদজ্ঞ ও সৎকুলজাত হইয়াও জীবিকার অভাবে নিতান্ত ক্লিষ্ট হইতেছে।
“হে পুত্ৰ! ক্ষুধিত মনুষ্যগণ বদন্যবর শৌৰ্য্যশালী ব্যক্তিকে প্রাপ্ত হইয়া যে সন্তুষ্টচিত্তে অবস্থান করে, ইহা অপেক্ষা অধিক ধর্ম্ম আর কি হইতে পারে? দানদ্বারা একপ্রকার, বলদ্বারা একপ্রকার আর সুনৃত[সত্য]বাক্যদ্বারা একপ্রকার ধর্ম্ম উপার্জ্জন হইয়া থাকে, কিন্তু ধার্মিক ব্যক্তি রাজ্যলাভ করিলে সকলপ্রকার ধর্ম্মই লাভ করিতে পারেন। ব্রাহ্মণ ভিক্ষাবৃত্তি অবলম্বন, ক্ষত্ৰিয় প্রজাপালন, বৈশ্য ধনোপার্জ্জন ও শূদ্র তাঁহাদিগকে সেবা করিবেন। ভিক্ষাবৃত্তি অবলম্বন করা তোমাদিগের পক্ষে নিষিদ্ধ; আর কৃষিকৰ্ম করাও তোমাদিগের পক্ষে উপযুক্ত হয় না। তুমি ক্ষত্ৰিয়, আপদ হইতে পরিত্রাণ করাই তোমার কর্ত্তব্য এবং ভুজবীৰ্য্যই তোমার জীবিকা। অতএব সাম, দান, ভেদ, দণ্ড বা নীতিদ্বারা অপহৃত পৈতৃকাংশ পুনরায় উদ্ধার করা। আমি তোমাকে প্রসব করিয়া নিরাশ্রয় ও পরপিণ্ড[পরান্ন]প্রত্যাশী হইয়া রহিলাম, ইহা অপেক্ষা অধিক দুঃখ আর কি আছে? অতএব হে পুত্র! রাজধর্ম্ম অনুসারে যুদ্ধ কর, পিতামহগণের নামলোপ করিও না এবং আপনিও ক্ষীণপুণ্য হইয়া অনুজগণের সহিত নিরয়[নরক]গামী হাইও না।”