রাজসূয়ারম্ভ-পৰ্ব্বাধ্যায়
বৈশম্পায়ন কহিলেন, হে ভরতকুলতিলক জনমেজয়! মহারাজ যুধিষ্ঠির মহর্ষি নারদের সেই বাক্য শ্রবণ করিয়া নিঃশ্বাস পরিত্যাগ করিলেন এবং রাজসূয়—যজ্ঞের বিষয় চিন্তা করিয়া যৎপরোনাস্তি ব্যাকুল হইলেন। তিনি মহাত্মা রাজর্ষিগণের মহিমা এবং পুণ্যকর্ম্ম দ্বারা যজ্বদিগের উত্তম লোকপ্ৰাপ্তি, বিশেষতঃ রাজর্ষি হরিশ্চন্দ্রের বিষয় সমালোচনা করিয়া রাজসূয়-যজ্ঞানুষ্ঠান করিতে মানস করিলেন। তখন সেই কুরুবংশাবতংস পাণ্ডুনন্দন সমস্ত সভাসদগণকে পূজা করিয়া ও তাঁহাদিগের কর্তৃক পূজিত হইয়া বারংবার চিন্তা করিয়া রাজসূয়-যজ্ঞ করিতে দৃঢ়নিশ্চয় হইলেন। তৎপরে সেই অদ্ভুততেজঃ ধৰ্মানন্দন প্রজাদিগের হিতসাধনে মন অভিনিবিষ্ট করিয়া অবশেষে সর্ব্বলোকের উপকার করিতে লাগিলেন। রাজা ক্ৰোধমদবিবর্জিত হইয়া সকলের ঋণ পরিশোধ করিতে আজ্ঞা দিলেন। ফলতঃ তাহার রাজ্যমধ্যে কেবল ‘সাধু ধর্ম্ম, সাধু ধর্ম্ম’, ভিন্ন আর কোন কথাই ছিল না। ধর্ম্মাত্মা যুধিষ্ঠির পুত্রের ন্যায় প্ৰজাগণকে প্রতিপালন করায় কেহই আর তাহার দ্বেষ্টা রহিল না। এইরূপে তিনি অজাতশত্রু হইয়া উঠিলেন। মহারাজ যুধিষ্ঠিরের পরিগ্রহ [উদার ব্যবহার—সকলের সঙ্গে সস্নেহ মিলন], ভীমসেনের প্রতিপালন, সব্যসাচী অর্জ্জুনের শত্রু-নিবারণ, ধীমান সহদেবের ধর্ম্মানুশাসন এবং নকুলের স্বাভাবিক নম্রতা দ্বারা তাহাদের অধিকারস্থ সমস্ত জনপদে বিগ্রহ বা ভয়ের সম্পর্ক রহিল না। সকলেই স্ব স্ব কাৰ্য্যে নিরত থাকিল, পৰ্জ্জন্য যথাকলে বারিবর্ষণ করিতে লাগিল এবং সকল প্রজারাই ধনসম্পত্তিসম্পন্ন হইল। বাৰ্দ্ধুৰ্ষী [কুসীদ বৃত্তি— সুদে টাকা খাটান], যজ্ঞসত্ত্ব [যজ্ঞের উপাদান], গোরক্ষণ, কৃষি, বাণিজ্য প্রভৃতি কাৰ্য্য সমুদয়ের যথেষ্ট উন্নতি হইল। অনুকর্ষ [দারিদ্র্যবশতঃ রাজার নিকট প্রজার ঋণ গ্ৰহণ], নিষ্কর্ষ [করের জন্য প্রজাপীড়ন], ব্যাধি, অগ্নিদাহ, মূৰ্ছা প্রভৃতি কিছুই রহিল না। দস্যু, বঞ্চক বা রাজবল্লভগণ রাজার কোনপ্রকার অনিষ্টাচরণ করিত না। ধাৰ্মিকবর মহারাজ যুধিষ্ঠির যে যে দেশ অধিকার করিয়াছিলেন, তথাকার নৃপগণ, বণিক-সমুদয়, রজোগুণপ্রধান লোভী লোক এবং সামান্য জাতি সকলেই সর্ব্বদা রাজার প্রিয়কাৰ্য্য দেবোপাসনা এবং স্ব স্ব অদৃষ্টানুসারে ভোগবাসনা চরিতার্থ করিত। সেই সম্রাট সর্ব্বগুণান্বিত, সৰ্বংসহ, সর্ব্বব্যাপী ও অসীম কীর্তিমান ছিলেন। কি দ্বিজাতি, কি গোপজাতি সমস্ত প্রজারাই সেই ভূপতির পিতৃকর্তব্য নীতিশিক্ষা প্ৰদানাদি ও মাতৃকর্তব্য বাৎসল্যাদি গুণ দ্বারা উপকৃত হইয়া তাঁহার প্রতি নিতান্ত অনুরক্ত হইয়া উঠিল।
যুধিষ্ঠিরের রাজসূয়-মন্ত্রণা
মহারাজ যুধিষ্ঠির স্বীয় মন্ত্রিগণ ও অনুজগণকে আহ্বান করিয়া বারংবার রাজসূয়—যজ্ঞের কথা জিজ্ঞাসা করিতে লাগিলেন। তাঁহারা যজ্ঞানুষ্ঠানেচ্ছুক মহাপ্রাজ্ঞ যুধিষ্ঠিরের সেই মহাৰ্থ বাক্যশ্রবণে পরম পরিতুষ্ট হইয়া কহিতে লাগিলেন, “হে কুরুনন্দন! নৃপতি যদ্বারা অভিষিক্ত হইয়া বারুণগুণ প্রাপ্ত হন, তদ্মারা তিনি সমস্ত সম্রাটুগুণ প্রাপ্ত হইতে পারেন। আমরা আপনার সুহৃদ, আমাদের মতে আপনার রাজসূয়-যজ্ঞ করিবার সময় সমুপস্থিত হইয়াছে। ক্ষত্ৰিয়বল থাকিলেই ঐ যজ্ঞ অনায়াসে সুসম্পন্ন হয়। এই যজ্ঞে ব্রতচারী ব্রাহ্মণগণ সামবেদ দ্বারা ষট্প্ৰকার অগ্নি সংস্থাপন করেন। এই যজ্ঞের অনুষ্ঠান করিলে অগ্নিহোত্র প্রভৃতি সমুদয় যজ্ঞের ফললাভ হয়। এই যজ্ঞের শেষে অভিষেক করিলে লোক সর্ব্বজয়ী হইয়া উঠে। হে মহারাজ! আপনি যজ্ঞানুষ্ঠানে সমর্থ; আমরা সকলেই আপনার বশীভুত। অতএব আপনি অচিরাৎ ঐ রাজসূয়-যজ্ঞের ফললাভ করিবেন। হে রাজন! এক্ষণে কোন বিচার না করিয়া রাজসূয়-যজ্ঞানুষ্ঠান সঙ্কল্প করুন।
ধর্ম্মরাজ যুধিষ্ঠির তাঁহাদের মুখে সেই স্বাভিলষিত ধর্ম্মসংযুক্ত বাক্য শ্রবণে পরম পরিতুষ্ট হইলেন এবং মনে মনে আপনার ক্ষমতা বুঝিয়া রাজসূয়ানুষ্ঠানে নিশ্চয় করিলেন। তখন তিনি পুনরায় ভ্রাতৃগণ, ঋত্বিকগণ, মন্ত্রিগণ এবং ধৌম্য ও দ্বৈপায়ন প্রভৃতি মহাত্মাদিগের সহিত মন্ত্রণা করিয়া কহিলেন, “হে মন্ত্রবিশারদগণ! আমি সার্ব্বভৌমোচিত রাজসূয় যজ্ঞ করিতে বাসনা করিয়াছি, বলুন, কি প্রকারে আমার মনোবাঞ্ছা সফল হইবে?” ধর্ম্মরাজের বাক্য শ্রবণ করিয়া ঋষিগণ ও ঋত্বিকগণ কহিলেন, “হে ধর্ম্মরাজ! তুমি রাজসূয়-যজ্ঞানুষ্ঠানের উপযুক্ত পােত্র বলিয়াই উৎসাহ প্ৰদান করিলাম।” তখন তাহার ভ্রাতৃগণ ও মন্ত্রিগণ তাহাদিগের বাক্যে অনুমোদন করিলেন। তখন মহাপ্ৰজ্ঞ যুধিষ্ঠির লোকগণের হিতবাসনায় পুনর্ব্বার চিন্তা করিতে লাগিলেন। যে ব্যক্তি আপনার সামর্থ্য, সম্পত্তি, দেশ, কাল, ও ব্যয় দেখিয়া এবং সম্যকরূপে বিবেচনা করিয়া কাৰ্য্য করে, তাহাকে বিপদগ্ৰস্ত হইতে হয় না। মহারাজ যুধিষ্ঠির কেবল আপনার মতে কর্তব্য হইল বলিয়া যজ্ঞারম্ভ করা অনুচিত বিবেচনা করিয়া অপ্রমেয় মহাবাহু সর্ব্বলোকোত্তম কৃষ্ণের সহিত পরামর্শ করিতে স্থির করিলেন। তিনি ভাবিলেন, কৃষ্ণ সর্ব্বজ্ঞ ও সর্ব্বকৃৎ, তিনি অবশ্যই আমাকে সৎপরামর্শ দিবেন। ধর্ম্মরাজ মনে মনে এইরূপ স্থির করিয়া কৃষ্ণসমীপে দূত প্রেরণ করিলেন। দূত শীঘ্ৰগামী রথে আরোহণ-পূর্ব্বক সত্বর দ্বারাবতী গমন করিয়া বাসুদেবের সমীপে সমুপস্থিত হইল। ভগবান চক্ৰপাণি দূতমুখে যুধিষ্ঠিরের দর্শনাকাঙক্ষা শ্রবণ করিয়া ইন্দ্রসেনকে সমভিব্যাহারে লইয়া যাত্রা করিলেন এবং ক্রমে ক্ৰমে নানাদেশ অতিক্ৰম করিয়া পরিশেষে ইন্দ্রপ্রন্থে যুধিষ্ঠিরের নিকট উপস্থিত হইলেন। যুধিষ্ঠির তাঁহাকে সমাগত দেখিয়া পরাম-সমাদরে পিতার ন্যায় পূজা করিলেন। তৎপরে ভীম, অৰ্জ্জুন ও মাদ্রীনন্দনদ্বয় গুরুর ন্যায় তাহাকে অৰ্চনা করিলেন। তৎপরে ভগবান বাসুদেব স্বীয় পিতৃম্বসা কুন্তীর সহিত সাক্ষাৎ করিয়া অন্যান্য সুহৃদগণের সহিত আমোদ করিতে লাগিলেন।
কৃষ্ণসমীপে যুধিষ্ঠিরের রাজসূয় সঙ্কল্প নিবেদন
এইরূপে ভগবান কৃষ্ণ কিঞ্চিৎকাল বিশ্রাম করিলে পর যুধিষ্ঠির আপনার প্রয়োজন জানাইবার নিমিত্ত তাঁহার সমীপে সমুপস্থিত হইয়া কহিলেন, “হে কৃষ্ণ! আমি রাজসূয়-যজ্ঞ করিতে অভিলাষ করিয়াছি। ঐ যজ্ঞ কেবল ইচ্ছা করিলেই সম্পন্ন হয়, এমন নহে; যেরূপে উহা সম্পন্ন হয়, তাহা তোমার সুবিদিত আছে। দেখ, যে ব্যক্তিতে সকলই সম্ভব, যে ব্যক্তি সর্ব্বত্র পূজ্য এবং যিনি সমুদয় পৃথিবীর ঈশ্বর, সেই ব্যক্তিই রাজসূয়ানুষ্ঠানের উপযুক্ত পাত্র। আমার অন্যান্য সুহৃদগণ আমাকে ঐ যজ্ঞ করিতে পরামর্শ দিয়াছেন, কিন্তু আমি তোমার পরামর্শ না লইয়া উহার অনুষ্ঠান করিতে নিশ্চয় করি নাই। হে কৃষ্ণ! কোন কোন ব্যক্তি বন্ধুতার নিমিত্ত দোষোদঘোৰ্ষণ করেন না, কেহ কেহ স্বার্থপর হইয়া প্ৰিয়বাক্য কহেন। কেহ বা যাহাতে আপনার হিত হয়, তাহাই প্রিয় বলিয়া বোধ করেন। হে মহাত্মন! এই পৃথিবীমধ্যে উক্ত প্রকার লোকই অধিক, সুতরাং তাঁহাদের পরামর্শ লইয়া কোন কাৰ্য্য করা যায় না। তুমি উক্ত প্রকার দোষ রহিত ও কামক্রোধবিবর্জিত; অতএব আমাকে যথার্থ পরামর্শ প্ৰদান কর।”