১২৯. সম্ভব পর্বাধ্যায় – ভীমের অদর্শনে কুন্তী প্রভৃতির ব্যাকুলতা বিদুরের সান্ত্বনা—ভীমের আগমন
উনএিংশদপিকশততম অধ্যায়।
বৈশম্পায়ন কহিলেন, এ দিকে কৌরবগণ ও যুধিষ্ঠিরাদি ভ্রাতৃচতুষ্টয়া ক্রীড়া শেষ করিয়া যৎকালে গৃহে প্রত্যাগমন করেন,তখন ভীমসেনকে দেখিতে পাইলেন না, তাহাতে এই বিবেচনা করিলেন, যে তিনি আমাদিগের অগ্রেই গ্লিয়াছেন; ইহা স্থির করিয়া কেহ রথে, কেহ গজে, কেহ অশ্বে, কেহ কেহ বা অন্যান্য যান বিশেষে আরোহণ পূর্বক হস্তিনানগরে প্রস্থান করিলেন। পাপাত্মা দুর্য্যোধন বৃকোদরের অদর্শনে সাতিশয় সন্তুষ্ট হইয়া তৃগণের সহিত পুর প্রবেশ করিলেন। ধর্মাত্মা যুধিষ্ঠির দুরাত্মাদুৰ্য্যোধনকৃত ব্যাপারের কিছুই জানিতেন না, সুতরাং ভীমের কোন অনিষ্টশঙ্কা না করিয়াই পুরে প্রবেশ করিলেন। তিনি জননীসদনে উপস্থিত হইয়া অভিবাদন পূর্বক জিজ্ঞাসা করিলেন, মাতঃ! বৃকোদর যে গৃহে আসিয়াছে। তাহাকে দেখিতেছি না কেন? তবে সে কোথায় গেল? আমরা তাহার নিমিত্ত উদ্যান ও বন তম তন্ন করিয়া অন্বেষণ করিয়াছি। যখন অনুসন্ধান করিয়া তাহাকে নিতান্ত পাইলাম না, তখন আমাদের বোধ হইল যে, অগ্ৰেই গৃহে আসিয়াছে। এক্ষণে তাহাকে না দেখিয়া অন্তঃকরণ নিতান্ত ব্যাকুল হইতেছে। সে এখানে আসিয়া আর কোথাও ত গমন করে নাই? আপনি ত তাহাকে কোথাও পাঠান নাই।
কুন্তী যুধিষ্ঠিরের মুখে এই বাক্য শ্রবণ করিয়া, হায়! কি হইল বলিয়া সসম্ভ্রমে যুধিষ্ঠিরকে কহিলেন, বৎস! আমি ভীমসেনকে দেখি নাই, সে এপৰ্য্যন্ত গৃহে আগমন করে নাই, তুমি তোমার অনুজয় সঙ্গে লইয়া শীঘ্র তাহার অন্বেষণ কর। চঞ্চলচিত্তা ভোজরাজদুহিতা জ্যেষ্ঠপুত্রকে এইরূপ আদেশ দিয়া বিহুরকে সন্নিধানে আনয়নপূর্বক কহিতে লাগিলেন, ক্ষত্তঃ! অদ্য কুমারগণ একত্র হইয়া উদ্যানে বিহার করিতে গিয়াছিল, সকলেই ফিরিয়া আসিয়াছে, কেবল একাকী ভীম এ পর্যন্ত প্রত্যাগমন করে নাই, সে যে কোথায় রহিয়াছে, কেহই তাহার অনুসন্ধান করিতে পারে নাই। দুর্মতি দুৰ্য্যোধন তাহাকে দেখিতে পারে না। ঐ দুরাত্মা নিতান্ত তূর, একান্ত ক্ষুদ্র, বিষম রাজ্যলুব্ধ ও সাতিশয় নির্লজ্জ; হয়ত ঐ পাপাত্মাই আমার ভীমকে বিনাশ করিয়াছে; এই ভাবিয়া আমার মন একান্ত ব্যাকুলিত হইতেছে।
মহামতি বিদুর কুন্তীর এই বাক্য শ্রবণ করিয়া কহিলেন, হে কল্যাণি। যদি পরিণামে আপনার মঙ্গল চাও, তবে ও কথা আর মুখে অনিও না, দুরাত্মা দুৰ্য্যোধন তোমার এ কথার সূত্র শুনিতে পাইলে অতিশয় উপদ্রব করিবে। ভীমসেনের নিমিত্ত তোমার কিছুমাত্র চিন্তা নাই। মহামুনি বেদব্যাস কহিয়াছেন, তোমার পুত্রগণ দীর্ঘায়ুঃ হইবেন, তাহার কথা কখন মিথ্যা হইবার নহে। তুমি ভাবিত হইও না। ভীমসেন অবশ্যই প্রত্যাগমন করিয়া তোমার নয়নদ্বয়ের আনন্দ সম্পাদন করিবেন। বিদ্বান বিদুর এই কথা বলিয়া স্বকীয় নিকেতনে গমন করিলেন, কুন্তী পুত্রগণ সমভিব্যাহারে ভীমচিন্তায় একবারে ম্রিয়মাণ হইয়া রহিলেন।
এদিকে ভীমসেন অষ্টমদিবসে জাগরিত হইয়া শষ্যা হইতে গাত্রোত্থান করিলেন। ভূজঙ্গমগণ তাঁহার সমীপে উপস্থিত হইয়া তাঁহাকে সান্ত্বনাবাক্যে কহিতে লাগিলেন, হে মহাবাহে! তুমি যে বলোপধায়ক অমৃতপান করিয়াছ, তদ্বারা অযুতগজোপমবলশালী ও যুদ্ধে অধৃষ্য হইবে; এক্ষণে এই দিব্য জলে স্নান করিয়া আপন ভবনে গমন কর; তোমার ভ্রাতৃগণ ও জননী তোমার অদর্শনে একান্ত ব্যগ্র হইয়া সাতিশয় ব্যাকুলিতচিত্তে কালক্ষেপ করিতেছেন। নাগগণের বাক্যাবসানে মহাবলপরাক্রান্ত বৃকোদর মানসমাপ্তি করিয়া শুক্লাম্বর পরিধান ও শুক্লমাল্যধারণপূর্বক বিবিধ বিষণ্ণ সুরভি ঔষধ। দ্বারা কৃতকৌতুকমঙ্গল হইয়া নাগদত্ত সুরস পরমান্ন ভোজন করিলেন। মহাবলপরাক্রান্ত ভুজঙ্গমগণ তাহাকে কেহ বা পূজা কেই বা আশীৰ্বাদ করিতে লাগিলেন। দিব্যাভরণভূষিত ভীমসেন নাগগণকে আমন্ত্রণা করিয়া হৃষ্টচিত্তে নাগলোক হইতে স্বগৃহগমন মানসে গাত্রোত্থান করিলেন। নাগের আঁহাকে জলমধ্য হইতে উতোলন করিয়া সেই পূর্বোক্ত বনোদ্দেশে স্থাপন করিয়া দেখিতে দেখিতেই অন্তর্হিত হইলেন।
তখন মহাবল পরাক্রান্ত মহাবাহু ভীমসেন আর বিলম্ব না করিয়া বনেদ্দেশ হইতে ঋভবনে গমনপুরঃসর সর্বাগ্ৰেই জননীর সন্নিধানে সমুপস্থিত হইলেন এবং অগ্রে মাতাকে, তৎপরে জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা যুধিষ্ঠিরকে অভিবাদন করিয়া কনিষ্ঠ ভ্রাতাদিগের মস্তকাঘ্রাণ করিলেন। পুত্রবৎসলা কুন্তী ও যুধিঠিরাদি ভ্রাতৃচতুষ্টয় প্রথম আহ্লাদিত হইয়া তাঁহাকে আলিঙ্গন করিলেন এবং “দৈব আমাদিগের প্রতি নিতান্ত অনুকুল, এই নিমিত্তি পুনর্বার তোমার সন্দর্শন পাইলাম” এই বলিয়া আনন্দাশ্রু মোচন করিতে লাগিলেন। তৎপরে ভীমপরাক্রম ভীমসেন তাহাদের নিকটে দুর্যোধনের দুষ্টচেষ্টিত অবধি আপনার পাতালপুর হইতে প্রত্যাগমন পৰ্যন্ত যাবতীয় বৃত্তান্ত সবিশেষ কীর্তন করিলেন। অসাধারণ বুদ্ধিসম্পন্ন মহাত্মা যুধিষ্ঠির ভীমের নিকটে দুর্য্যোধনকৃত দুষ্ট ব্যবহার শ্রবণ করিয়া কহিলেন,-ভ্রাতঃ! এ কথা আমাদিগের নিকটে যাহা কহিলে এই পৰ্য্যন্তই ভাল, আর কাহারও নিকটে মুখে আনিও না; আমরা অদ্যাবধি পরস্পর পরস্পরের রক্ষণবিষয়ে সচেষ্ট থাকিব।, ধৰ্মাত্মা যু ধষ্ঠির ভীমসেনকে ইহা বলিয়া তদবধি ভ্রাতৃগণের সহিত সাবধান হইয়া চলিতে লাগিলেন। যে সময়ে পাণ্ডবগণ ক্রীড়াসক্ত থাকিতেন, তৎকালে রাজা ধৃতরাষ্ট্র, দুৰ্য্যোধন, কর্ণ এবং শকুনি নানাবিধ উপায় দ্বারা তাহাদিগের হিংসা করিতে চেষ্টা পাইতেন, কিন্তু তাহারা সে সকল জানিতে পারিয়াও বিদুরের পরামর্শানুসারে কিছুমাত্র প্রকাশ করিতেন না।