১২৯তম অধ্যায়
কর্ণকর্ত্তৃক ভীমের পথরোধ কর্ণপরাজয়
ধৃতরাষ্ট্র কহিলেন, “হে সঞ্জয়! এইরূপে মহাবলপরাক্রান্ত ভীমসেন মেঘগম্ভীরনির্ঘোষে ঘোরতর সিংহনাদ করিতে আরম্ভ করিলে কোন্ কোন্ বীর তাঁহাকে অবরোধ করিল? ভীমপরাক্রম ভীমসেন ক্রোধাবিষ্ট হইলে তাঁহার সন্নিধানে অবস্থান করিতে পারে, ত্রিলোকমধ্যে এমন কাহাকেও দৃষ্টিগোচর হয় না। সে যখন সাক্ষাৎ কৃতান্তের ন্যায় গদা উদ্যত করে, তখন রণস্থলে অবস্থান করিতে কেহই সমর্থ হয় না। ভীম রথদ্বারা রথ ও কুঞ্জরদ্বারা কুঞ্জর বিনাশ করিয়া থাকে, তাঁহার সম্মুখে কে অবস্থান করিবে? তাঁহার সম্মুখীন হইতে দেবরাজ ইন্দ্রেরও সাহস হয় না। যাহা হউক, এক্ষণে বল, কালান্তক যমোপম মহাবীর ভীমসেন ক্রুদ্ধচিত্তে তৃণদহনপ্রবৃত্ত দাবদহনের ন্যায় আমার পুত্রগণকে সংহার করিতে আরম্ভ করিলে দুৰ্য্যোধন-হিতনিরত কোন্ কোন্ বীরপুরুষ তাঁহার সমক্ষে অবস্থানপূর্ব্বক তাঁহাকে নিবারণ করিতে লাগিল? হে সঞ্জয়! মহাবীর ভীমসেনের নিমিত্ত আমার যাদৃশ শঙ্কা হয়, অর্জ্জুন, কৃষ্ণ, সাত্যকি ও ধৃষ্টদ্যুম্নের নিমিত্ত তাদৃশ শঙ্কা নাই। অতএব হে সঞ্জয়! কোন্ কোন্ ব্যক্তি আমার পুত্ৰবিনাশে প্রবৃত্ত রোষপ্রদীপ্ত ভীমসেনের সন্নিহিত হইল, তুমি তাহা কীৰ্ত্তন কর।”
সঞ্জয় কহিলেন, “মহারাজ! মহাবীর কর্ণ ভীমসেনকে সিংহনাদ করিতে দেখিয়া তুমুল কোলাহল করিয়া তাঁহার সমক্ষে সমুপস্থিত হইলেন এবং তাঁহার সহিত যুদ্ধার্থী হইয়া ক্রোধভরে সুদৃঢ় শরাসন আকর্ষণপূর্ব্বক বলপ্রদর্শন করিবার বাসনায় মহীরুহ যেমন বায়ুর পথরোধ করে তদ্রূপ তাঁহার পথরোধ করিলেন। মহাবীর ভীমসেন কর্ণকে সম্মুখে নিরীক্ষণপূর্ব্বক ক্রোধে একান্ত অধীর হইয়া তাঁহার উপর শিলানিশিত শরনিকর নিক্ষেপ করিতে লাগিলেন; মহাবীর কর্ণও শরপ্রয়োগপূর্ব্বক তৎপ্রযুক্ত শর প্রতিগ্ৰহ করিলেন। তৎকালে রথী ও অশ্বারোহী প্রভৃতি যেসকল যোধগণ ভীম ও কর্ণের যুদ্ধ অবলোকন করিতেছিলেন, সেই বীরদ্বয়ের তলধ্বনিশ্রবণে তাঁহাদের কলেবর কম্পিত হইতে লাগিল। ক্ষত্রিয়গণ ভীমসেনের ভয়ঙ্কর সিংহনাদ শ্রবণ করিয়া ভূতল ও নভোমণ্ডল অবরুদ্ধ বিবেচনা করিলেন। ঐ সময় মহাবীর ভীমসেন পুনরায় অতি ভীষণ সিংহনাদ পরিত্যাগ করিতে লাগিলেন। ঐ সিংহনাদপ্রভাবে সমুদয় যোদ্ধাদিগের হস্ত হইতে শরাসন ভূতলে নিপতিত হইল। বাহনসকল সাতিশয় ভীত ও বিমনায়মান হইয়া মলমূত্র পরিত্যাগ করিতে লাগিল।
“ঐ সময় বহুতর ভয়ঙ্কর দুর্নিমিত্ত প্রাদুর্ভূত হইল। অন্তরীক্ষ গৃধ্র, কঙ্ক ও বায়সে সমাচ্ছন্ন হইয়া গেল। তখন মহাবীর কর্ণ বিংশতিশরে ভীমসেনকে নিতান্ত নিপীড়িত করিয়া সত্বর পাঁচশরে তাঁহার সারথিকে বিদ্ধ করিলেন। ভীমসেন তদ্দর্শনে সত্বর কর্ণের প্রতি চতুঃষষ্টি সায়ক প্রয়োগ করিয়া হাস্য করিতে লাগিলেন। তখন কর্ণ ভীমের প্রতি চারি সায়ক নিক্ষেপ করিলেন। মহাবীর বৃকোদর হস্তলাঘব প্রদর্শনপূর্ব্বক সন্নতপর্ব্ব সায়কনিকরে ঐ সকল শর উপস্থিত না হইতে হইতেই দূর হইতে খণ্ড খণ্ড করিয়া ফেলিলেন। অনন্তর মহাবীর কর্ণ শরজালদ্বারা ভীমসেনকে সমাচ্ছন্ন করিতে লাগিলেন। ভীমসেন কর্ণশরে বারংবার আচ্ছাদিত হইয়া ক্রোধভরে তাঁহার কার্ম্মকের মুষ্টিদেশ ছেদন করিয়া তাঁহাকে দশশরে বিদ্ধ করিলেন। তখন মহারথ কর্ণ শরাসনে জ্যারোপণপূর্ব্বক ভীমকে শরজালে বিদ্ধ করিতে লাগিলেন। ভীমসেন কর্ণের শরাঘাতে সাতিশয় রোষাবিষ্ট হইয়া মহাবেগে আনতপর্ব্ব তিনশরে তাঁহার বক্ষঃস্থল বিদ্ধ করিলেন। মহাবীর কর্ণ বক্ষঃস্থলে বিদ্ধ শরত্রয়দ্বারা উত্তঙ্গ-শৃঙ্গত্রয়সম্পন্ন মহীধরের ন্যায় শোভাপ্রাপ্ত হইলেন। তৎকালে ধাতুধারাস্রাবী ভূধর হইতে যেমন গৈরিকধাতু নির্গত হয়, তদ্রূপ তাঁহার বক্ষঃস্থল হইতে রুধিরধারা প্রবাহিত হইতে লাগিল। এইরূপে মহাবীর কর্ণ ভীমের শরহারে নিতান্ত নিপীড়িত ও ঈষৎ বিচলিত হইয়া শরাসনে শরসন্ধানপূর্ব্বক তাঁহাকে বিদ্ধ করিয়া পুনরায় সহস্র সহস্র বাণ নিক্ষেপ করিতে আরম্ভ করিলেন। মহাবীর ভীম কর্ণের শরজালে সহসা সমাচ্ছন্ন হইয়া গর্ব্ব প্ৰকাশপূর্ব্বক অবিলম্বে তাঁহার ধনুর্জা ছেদন ও সারথিকে শমনসদনে প্রেরণ করিয়া চারি অশ্বকে বিনাশ করিলেন। তখন মহারথ কর্ণ সেই অশ্বশূন্য রথ হইতে সত্বর অবতীর্ণ হইয়া বৃষসেনের রথে সমারূঢ় হইলেন।
“হে মহারাজ! এইরূপে প্রবলপ্রতাপশালী মহাবীর ভীম কর্ণকে পরাজয় করিয়া মেঘনির্ঘোষসদৃশ সিংহনাদ পরিত্যাগ করিতে লাগিলেন। ধর্ম্মনন্দন রাজা যুধিষ্ঠির ভীমের সেই সিংহনাদশ্রবণে কর্ণকে পরাজিত বোধ করিয়া সাতিশয় সন্তুষ্ট হইলেন।
পাণ্ডবসৈন্যগণ চারিদিকে শঙ্খধ্বনি করিতে লাগিল। কৌরবপক্ষীয় বীরগণ বিপক্ষসৈন্যগণের সেই তুমুল কোলাহল শ্রবণ করিয়া সিংহনাদ পরিত্যাগ করিতে লাগিলেন। মহাবীর অর্জ্জুন গাণ্ডীবে টঙ্কার প্রদান ও বাসুদেব শঙ্খধ্বনি করিতে আরম্ভ করিলেন। ঐ সময় ভীমের ভীষণ সিংহনাদ সেই সমস্ত শব্দ সমাচ্ছাদিত করিয়া সমুদয় সৈন্যদিগের শ্রুতিগোচর হইতে লাগিল। অনন্তর কর্ণ মৃদুভাবে ও ভীম দৃঢ়রূপে অজিহ্মগামী শরবর্ষণ আরম্ভ করিলেন।”