১২৭তম অধ্যায়
কৃষ্ণের দুৰ্য্যোধন, তিরস্কার
বৈশম্পায়ন কহিলেন, নরনাথ! মহাত্মা জনাৰ্দন দুৰ্য্যোধনের বাক্যশ্রবণে ক্ৰোধপৰ্য্যাকুলালোচনা [রোষচঞ্চল-ক্ৰোধে বিঘূর্ণিত] হইয়া হাস্য করিতে করিতে কহিতে লাগিলেন, “হে দুৰ্য্যোধন! তুমি আমাত্যের সহিত বীরশয্যা লাভ করিতে বাসনা করিতেছ, তাহা তোমার অবশ্যই লাভ হইবে। স্থির হও, অচিরকালমধ্যেই মহৎসংগ্রাম সমুপস্থিত হইবে। হে মূঢ়! তুমি যে কহিলে, পাণ্ডবগণের প্রতি আমার কিছুমাত্র অত্যাচার নাই, অত্ৰস্থ ভূপতিগণ তাহা বিশেষরূপে অনুধাবন করিয়া দেখুন। হে ভরতকুলকলঙ্ক! তুমি পাণ্ডবগণের সম্পত্তিদর্শনে নিতান্ত সন্তাপ্ত হইয়া শকুনির সহিত পরামর্শপূর্ব্বক কপটদ্যূতে প্ৰবৃত্ত হইয়াছিলে। কপটাচারবিহীন অতিপ্রধান তোমার জ্ঞাতিবর্গ কিরূপে কুটিল ব্যক্তির সহিত অন্যায়াচরণে প্রবৃত্ত হইয়াছিল? অক্ষক্রীড়ায় সাধুগণের বুদ্ধিলোপ এবং অসাধুদিগের ভেদ ও ব্যসন সমুৎপন্ন হইয়া থাকে। তুমি অসমীক্ষ্যকারিতা[অপরিণামদৰ্শিতা]- প্রযুক্ত সদাচারপরায়ণ পাণ্ডবগণের সহিত কপটদ্যূতক্ৰীড়া করিয়া এই ব্যসন সমুৎপাদন করিয়াছ। তুমি কুলশীলসম্পন্না পাণ্ডবগণের প্রাণ অপেক্ষাও প্রিয়তমা মহিষী দ্রৌপদীকে সভামধ্যে আনয়নপূর্ব্বক যেরূপ অপমান ও কটুক্তি করিয়াছ, আর কোন ব্যক্তি ভ্রাতৃভাৰ্য্যার প্রতি সেরূপ ব্যবহার করিতে পারে? পাণ্ডবগণের অরণ্যগমনসময়ে দুঃশাসন কুরুসভামধ্যে তাঁহাদিগকে যাহা যাহা করিয়াছিল, কৌরবগণ তৎসমুদয় অবগত আছেন। ফলতঃ তোমরা পাণ্ডবগণের প্রতি যেরূপ আচরণ করিয়াছ, অন্য কোন ব্যক্তি স্বীয় বন্ধুগণের সহিত তাদৃশ অসদ্ব্যবহার করিতে পারে না। হে দুৰ্য্যোধন! তুমি, কর্ণ ও দুঃশাসন, এই তিনজনে অনাৰ্য্য ও নৃশংস পুরুষের ন্যায় তাঁহাদিগকে বারংবার বহুবিধ কটুক্তি করিয়াছ।
“দেখ, তুমি পাণ্ডবগণের বাল্যাবস্থায় বারণাবতনগরমধ্যে তাঁহাদিগকে মাতৃসমভিব্যাহারে দগ্ধ করিতে সবিশেষ যত্ন করিয়াছিলে, কিন্তু কৃতকাৰ্য্য হইতে পার নাই। তাঁহারা সেই বিপদ হইতে উত্তীর্ণ হইয়া মাতৃসমভিব্যাহারে একচক্রানগরে ব্রাহ্মণের নিকেতনে বহুদিবস প্রচ্ছন্নভাবে বাস করিয়াছিলেন। তুমি বিষসর্পপ্রভৃতি বিবিধ উপায়দ্বারা তাঁহাদিগকে বিনষ্ট করিতে চেষ্টা করিয়াছিলে, কিন্তু কোনক্রমেই কৃতকাৰ্য্য হইতে পার নাই। তুমি উত্তমরূপে বারংবার মহাত্মা পাণ্ডবগণের অনিষ্ট চেষ্টা করিয়াছ; অতএব পাণ্ডবগণের নিকট যে তোমার কিছুমাত্র অপরাধ নাই, ইহা কিরূপে বলিতে পারি?
“পাণ্ডবগণ স্বীয় পৈতৃক রাজ্যাংশ প্রার্থনা করিতেছেন, তুমি তৎপ্রদানে সম্মত হইতেছে না, কিন্তু অচিরাৎ তোমাকে ঐশ্বৰ্য্যভ্রষ্ট ও নিপতিত হইয়া তাঁহাদিগকে উহা প্ৰদান করিতে হইবে। তুমি পূর্ব্বে পাণ্ডবগণের প্রতি নিতান্ত হীন ও নৃশংসের ন্যায় নানাবিধ অসদ্ব্যবহার করিয়া এক্ষণে তাঁহাদের সহিত বিবাদ করিতে বাসনা করিতেছ। তোমার পিতা, মাতা, ভীস্ম, দ্রোণ ও বিদুর তোমাকে শান্তিমাৰ্গ অবলম্বন করিতে বারংবার অনুরোধ করিতেছেন, কিন্তু তুমি তাহাতে সম্মত হইতেছ না। হে দুৰ্য্যোধন! এক্ষণে সন্ধিস্থাপন হইলে তুমি ও যুধিষ্ঠির উভয়েরই যথেষ্ট লাভ হয়, কিন্তু তুমি অল্পবুদ্ধিপ্রযুক্ত তাহাতে সম্মত হইতেছ না! তুমি সুহৃজ্জনের বাক্য উপেক্ষা করিয়া নিতান্ত অধৰ্ম্য ও অযশস্কর কাৰ্য্যে হস্তক্ষেপ করিতেছ; অতএব স্পষ্টই বোধ হইতেছে, তোমার শ্রেয়োলাভ হইবে না।”
দুঃশাসনের সন্ধি-স্থাপনেচ্ছা!
ভগবান কৃষ্ণের বাক্যাবসান হইলে ধৃতরাষ্ট্রতনয় দুঃশাসন জ্যেষ্ঠভ্রাতা ক্রোধনস্বভাব দুর্য্যোধনকে কহিলেন, “হে রাজন! যদি আপনি স্বেচ্ছাক্রমে পাণ্ডবগণের সহিত সন্ধিস্থাপন না করেন, তাহা হইলে কৌরবগণ আপনাকে বদ্ধ করিয়া যুধিষ্ঠিরের হস্তে সমৰ্পণ করিবেন [পাণ্ডববলশ্রবণে ভীত দুঃশাসনের দুর্বুদ্ধি দূর হওয়ায় ভ্রাতার প্রতি সন্ধি করার কৌশলবিস্তার]। ভীষ্ম, দ্রোণ ও পিতা আপনাকে, আমাকে ও কর্ণকে পাণ্ডবগণের বশীভূত করিতে একান্ত অভিলাষী হইয়াছেন।”
দুর্ম্মতি, নির্লজ্জ, মর্য্যাদাঘাতক, অহঙ্কারপরবশ, দুরাত্মা দুৰ্য্যোধন ভ্রাতার বাক্য শ্রবণে নিতান্ত ক্ৰোধপরতন্ত্র হইয়া বিদুর, ধৃতরাষ্ট্র, বাহ্লীক, কৃপ, সোমদত্ত, ভীষ্ম, দ্রোণ ও জনাৰ্দনের প্রতি অনাদর প্রকাশপূর্ব্বক সহসা গাত্ৰোত্থান করিয়া তথা হইতে প্রস্থান করিতে লাগিলেন। তাঁহার ভ্রাতৃগণ তাঁহাকে প্রস্থান করিতে দেখিয়া তাহার অনুগমনে প্রবৃত্ত হইলেন।
ভীষ্মের ভবিষ্যদ্বাণী
শান্তনুতনয় ভীষ্ম দুৰ্য্যোধনকে সভামধ্যে ক্রুদ্ধ হইয়া গাত্ৰোত্থানপূর্ব্বক ভ্রাতৃগণসমভিব্যাহারে প্রস্থান করিতে দেখিয়া কহিতে লাগিলেন, “হে সভাসদগণ! যে দুরাত্মা ধর্ম্মাৰ্থ পরিত্যাগপূর্ব্বক ক্রোধের বশবর্ত্তী হয়, সে অচিরাৎ ব্যসনাপন্ন হইয়া অরাতিকুলের হাস্যাস্পদ হইয়া উঠে। এই দুরাত্মা ধৃতরাষ্ট্রতনয় দুৰ্য্যোধন উপায়ানভিজ্ঞ বৃথা রাজ্যাভিমান ও ক্ৰোধলোভের একান্ত বশীভূত! যেসমুদয় ভূপতি মোহবশতঃ মন্ত্রিগণসমভিব্যাহারে এ স্থানে সমাগত হইয়াছেন, তাহাদের আয়ুঃশেষ হইয়াছে।”
কৃষ্ণকর্ত্তৃক দুৰ্য্যোধনের শাসনোপায়কীর্ত্তন
পুণ্ডরীকাক্ষ [কমলনয়ন] জনাৰ্দন ভীষ্মের বাক্যশ্রবণানন্তর ভীষ্ম, দ্রোণ প্রভৃতি মহাত্মাদিগকে কহিতে লাগিলেন, “হে মহাত্মগণ! কুরুবৃদ্ধসকল ঐশ্বৰ্য্যমদমত্ত দুরাচার দুৰ্য্যোধনকে শাসন না করিয়া নিতান্ত অন্যায়াচরণ করিতেছেন। এক্ষণে যাহা কর্ত্তব্য, আমি তাহা একপ্রকার স্থির করিয়াছি। আপনারা তদনুষ্ঠানে সম্মত হইলে শ্রেয়োলাভ হইতে পারে। যদি আপনারা অনুগ্রহ করিয়া ইচ্ছা করেন, তাহা হইলে আমি আপনাদিগের সমক্ষে হিতকর বাক্য বলি। দেখুন, বৃদ্ধ ভোজরাজ উগ্রসেনের তনয় দুরাত্মা কংস পিতা জীবিত থাকিতেই তাহার রাজ্য হরণ করিয়াছিল; তন্নিবন্ধন ঐ দুরাচার স্বীয় বন্ধুবান্ধবকর্ত্তৃক পরিত্যক্ত হয়। পরিশেষে আমি স্বীয় জ্ঞাতিবর্গের হিতার্থে উহাকে সমরে সংহার করিয়া ঐসকল জ্ঞাতিগণসমভিব্যাহারে আহুকতনয় উগ্রসেনকে সৎকারপূর্ব্বক পুনরায় ভোজরাজ্যে অভিষিক্ত করিলাম। এইরূপে কুলরক্ষার্থ এক কংসকে পরিত্যাগ করিয়া সমুদয় যাদব, বৃষ্ণি ও অন্ধকবংশীয়গণ যথেষ্ট সুখভোগে কালাতিপাত করিতেছেন। আর যৎকালে দেবাসুরগণ উদ্যতাস্ত্ৰ [অস্ত্ৰ উত্তোলনপূর্ব্বক যুদ্ধোদ্যত] হইয়া পরস্পর যুদ্ধে প্রবৃত্ত হইলে সমুদয় লোক বিনষ্ট হইতে লাগিল, তৎকালে ভগবান লোকভাবন [লোকসকলের উৎপাদনকারী] কমলযোনি [ব্ৰহ্মা] বিবেচনা করিলেন যে, সমস্ত অসুর, দৈত্য ও দানবগণ নিশ্চয় পরাভবপ্রাপ্ত হইবে এবং আদিত্য, বসু ও রুদ্রগণ স্বৰ্গবাসী [স্ব স্ব পদে প্রতিষ্ঠিত] হইবেন। এই সংগ্রামে সমুদয় দেব, অসুর, মনুষ্য, গন্ধৰ্ব, ভুজঙ্গ ও রাক্ষসগণ করিবে। ভগবান প্রজাপতি মনে মনে এইরূপ বিবেচনায় একান্ত ক্রুদ্ধ হইয়া পরস্পরকে সংহার করিয়া ধর্ম্মকে কহিলেন, “হে ধৰ্ম! তুমি এই সমস্ত দৈত্য ও দানবদিগকে বন্ধন করিয়া বিরুণের নিকট প্রদান কর।” ধর্ম্ম সর্ব্বলোকপিতামহ বিরিঞ্চির আদেশানুসারে সমুদয় দৈত্যদানবগণকে বন্ধন করিয়া বরুণের হস্তে সমর্পণ করলেন। জলাধিপতি বরুণ তাঁহাদিগকে ধর্ম্মপাশ ও স্বীয় পাশদ্বারা বদ্ধ করিয়া সমুদ্রমধ্যে স্থাপনপূর্ব্বক সতত রক্ষা করিতে লাগিলেন।
“হে মহাত্মাগণ! ধর্ম্ম যেমন দুর্দান্ত দানবগণকে বদ্ধ করিয়া বরুণের নিকট প্রদান করিয়াছিলেন, তদ্রূপ। আপনারা দুৰ্য্যোধন, কৰ্ণ, দুঃশাসন ও সুবলনন্দন শকুনিকে বদ্ধ করিয়া পাণ্ডবগণের নিকট প্রদান করুন। কুলরক্ষার নিমিত্ত একজনকে পরিত্যাগ করিবে, গ্রামরক্ষার নিত্তি কুল পরিত্যাগ করিরেব, জনপদরক্ষার নিমিত্ত গ্রাম পরিত্যাগ করিবে এবং আত্মরক্ষার নিমিত্ত পৃথিবী পৰ্য্যন্ত পরিত্যাগ করবে। অতএব হে রাজন! আপনি দুৰ্য্যোধনকে – বন্ধন করিয়া পাণ্ডবগণের সহিত সন্ধিসংস্থাপন করুন, আপনার দোষে যেন সমুদয় ক্ষত্রিয় বিনষ্ট না হয়।”