১২৬তম অধ্যায়
দুৰ্য্যোধনের দম্ভোক্তি-কৃষ্ণের প্রতি কটাক্ষ
বৈশম্পায়ন কহিলেন, মহারাজ! রাজা দুৰ্য্যোধন কুরুসভামধ্যে অপ্রিয়বাক্য শ্রবণ করিয়া ভগবান কেশবকে কহিতে লাগিলেন, “হে বাসুদেব! অগ্ৰে উত্তমরূপে বিবেচনা করিয়া বাক্যপ্রয়োগ করা তোমার কর্ত্তব্য; তুমি তাহা না করিয়া বিশেষরূপে আমারই নিন্দা করিতেছ। তুমি অকস্মাৎ কি বলাবল অবেক্ষণ [বিচারদ্বারা নির্ণয়] করিয়া পাণ্ডবগণের প্রতি ভক্তিপ্রদর্শনপূর্ব্বক আমাকে নিন্দা করিতেছ? তুমি, বিদুর, পিতা, আচাৰ্য্য দ্রোণ ও পিতামহ ভীষ্ম, তোমরা এই কয়জন সতত আমারই নিন্দা করিয়া থাক; অন্য কোন ভূপালকে নিন্দা কর না। কিন্তু আমি বিশেষরূপে অনুসন্ধান করিয়া আপনার [নিজের] অনুমাত্রও অপরাধ ও অন্যায়াচরণ দেখিতে পাই না; তথাপি তোমরা সকলে নিয়ত আমার প্রতি বিদ্বেষ প্রকাশ করিতেছ। হে কেশব! পাণ্ডবগণ প্রীতিপূর্ব্বক দ্যূতে প্রবৃত্ত হইলে শকুনি তাঁহাদের রাজ্য জয় করিয়াছিলেন; তাহাতে আমার অপরাধ কি? ঐ সময় পাণ্ডবগণের যেসমুদয় ধন পরাজিত [পরাজয়কৃত গ্রহণ] হইয়াছিল, তাহা তাঁহাদের অসম্মতিক্রমে হয় নাই। অতএব অজেয় পাণ্ডবগণ যে দুরোদরমুখে [পাশাখেলা ব্যাপার] সর্ব্বস্ব বিসর্জ্জনপূর্ব্বক বনে গমন করিয়াছিলেন, তাহাতে আমাদের কিছুমাত্র অপরাধ নাই। এক্ষণে সেই নিতান্ত অসমর্থ পাণ্ডবগণ কি বলিয়া হৃষ্টচিত্তে শত্রুর ন্যায় আমাদের সহিত বিরোধ করিতে চেষ্টা করিতেছেন? আমরা তাঁহাদের কি করিয়াছি? তাঁহারা কি অপরাধে সৃঞ্জয়গণসমভিব্যাহারে আমাদিগের অনিষ্টচিন্তা করিতেছেন? আমার উগ্র কর্ম্ম বা ভীষণবাচনে ভীত হইয়া সুররাজের সমীপেও নত হই না। হে কৃষ্ণ! আমি এমন কোন ক্ষত্রিয়কে অবলোকন করি না, যে যুদ্ধে আমাদিগকে পরাজয় করিতে উৎসাহযুক্ত হয়। পাণ্ডবগণের কথা দূরে থাকুক, দেবগণও সংগ্রামে ভীষ্ম, দ্রোণ ও কর্ণকে পরাজয় করিতে পারেন না। যাহা হউক, আমরা স্বধর্ম্ম উপেক্ষা না করিয়া সংগ্রামে গমনপূর্ব্বক যদি অস্ত্রাঘাতে প্ৰাণ পরিত্যাগ করি, তাহা হইলে স্বৰ্গলাভ করিতে পারিব। সংগ্রামের শরশয্যায় শয়ন করা ক্ষত্ৰিয়গণের প্রধান ধর্ম্ম। যদি আমার শত্ৰুগণের নিকট অবনত না হইয়া সংগ্রামে বীরশয্যা [বীরবাঞ্ছিত মৃত্যুশয্যা] প্রাপ্ত হই, তাহা হইলে আমাদের নিমিত্ত কেহই অনুতাপিত হইবে না। কোন সদ্বংশজাত ক্ষত্রধর্ম্মাবলম্বী ব্যক্তি ভীত হইয়া শত্রুর নিকট অবনত হইতে সম্মত হয়? মতঙ্গমুনি কহিয়াছেন, “উদ্যমই পৌরুষ বলিয়া গণ্য; অতএব উদ্যম করা নিতান্ত আবশ্যক; নত হওয়া কদাপি বিধেয় নহে, বরং অসময়ে ভগ্ন হইবে, তথাপি কোনক্রমে নত হইবে না।” হিতাভিলাষী ব্যক্তিগণ মতঙ্গের এই বচনানুসারে কাৰ্য্য করিয়া থাকেন। হে মহাত্মন! মদ্বিধ ব্যক্তিরা কেবল ধর্মের নিমিত্ত ব্ৰাহ্মণগণের নিকট প্রণত হইয়া থাকেন। অতএব অন্য কোন বিষয় চিন্তা না করিয়া যাবজ্জীবন উক্তরূপ ধর্ম্ম আচরণ করিবে, ইহাই ক্ষত্ৰিয়ের যথার্থ ধর্ম্ম এবং আমারও এ বিষয়ে বিলক্ষণ সম্মতি আছে।
“আমার পিতা যে পূর্ব্বে পাণ্ডবগণকে রাজ্যের অৰ্দ্ধাংশ প্রদান করিতে অনুজ্ঞা করিয়াছিলেন, আমি জীবিত থাকিতে কখনই তাহা হইবে না। ফলতঃ যে পৰ্য্যন্ত মহারাজ ধৃতরাষ্ট্র জীবিত থাকিবেন, তাবৎ আমরা বা তাহারা এক পক্ষকে অবশ্যই ক্ষত্রিয়ধর্ম্ম পরিত্যাগপূর্ব্বক ভিক্ষুকের ন্যায় কালাতিপাত করিতে হইবে। হে কেশব! পূর্ব্বে আমি পরাধীন ও বালক ছিলাম, তৎকালে অজ্ঞানতাবশতঃই হউক বা ভয়প্রযুক্তই হউক, আমার অদেয় রাজ্য প্ৰদান করা হইয়াছিল; এক্ষণে আমি জীবিত থাকিতে পাণ্ডবগণ কদাপি তাহা প্রাপ্ত হইবে না। অধিক কি, সুতীক্ষ্ন সূচীর অগ্রভাগদ্বারা যে পরিমাণ ভূমিভাগ বিদ্ধ করা যায়, পাণ্ডবগণকে তাহাও প্ৰদান করিব না।”