১২৫. পাণ্ডুর পরলোক
পঞ্চবিংশত্যধিক শততম অধ্যায়।
বৈশম্পায়ন কহিলেন,—মহীপতি পাণ্ডু এইরূপে দেবতুল্য প্রিয়দর্শন পঞ্চ পুত্র লাভ করিয়া পরমসুখে কিয়ৎকাল অতিবাহিত করিলেন। ইতিমধ্যে সর্বভূতের সম্মোহনকারী ঋতুরাজ বসন্ত আবির্ভূত হইল। রাজা বনবিহার করিতে গমন করিলেন, মদ্ররাজদুহিতা দিব্যাম্বর পরিধানপূর্বক তাঁহার পশ্চাৎ পশ্চাৎ চলিলেন। ঐ বন পলাশ, তিলক, আম্র, চম্পক, পণরি, ভদ্রক প্রভৃতি ফল পুষ্পসুশোভিত নানাবিধ বৃক্ষজালে সমাকীর্ণ, পদ্ম, কুমুদ, কলার প্রভৃতি জলজ পুষ্প দ্বারা সমাবৃত এবং বহুবিধ জলাশয়ে ব্যাপ্ত ছিল। একে বসন্তকাল ও বনের অলৌকিক সৌন্দৰ্য, তাহাতে আবার অসামান্য রূপলাবণ্য সম্পন্ন রাজীবলোচনা মদ্ৰাধিপতনয়া একাকিনী সঙ্গে সঙ্গে ভ্রমণ করিতেছেন; এই সমস্ত দর্শন করিয়া রাজার অন্তঃকরণের চাঞ্চল্য হইয়া উঠিল। তিনি ক্রমে ক্রমে অনঙ্গশরে অবশচিত্ত হইয়া বলপূর্বক মন্ত্রীকে আলিঙ্গন করিলেন। মাদ্রী বারংবার নিষেধ করিতে লাগিলেন, কিন্তু রাজা কোনক্রমেই নিবৃত্ত হইলেন না। তিনি কমিশরে বিমোহিত হইয়া মৃগরূপধারী ঋষিকুমারের শাপ একবারে বিস্মৃত হইয়া গিয়াছিলেন। দৈবনির্বন্ধ অখণ্ডনীয়, রাজা বারংবার মাদ্রীকর্তৃক নিবারিত হইয়াও কোনক্রমে নিরস্ত হইলেন না; সুতরাং আল্লক্ষ্যনীয় মৃগশাপবশতঃ পঞ্চত্ব প্রাপ্ত হইলেন। মাদ্রী তাঁহাকে তদবস্থ দেখিয়া হার মৃতদেহ আলিঙ্গনপূর্বক উচ্চৈঃস্বরে আর্তনাদ করিতে লাগিলেন। কুন্তী দূর হইতে সেই আর্তনাদ শ্রবণ করিয়া অতীব আকুলিতচিতে স্বীয় পুত্রগণ ও মাদ্রীকুমারদ্বয়কে সমভিব্যাহারে লইয়া শব্দানুসারে গমন করিতে লাগিলেন। মাদ্রী অনতিদূরে কুন্তীকে কুমারগণ সমভিব্যাহারে আসিতে দেখিয়া কাতরস্বরে কহিলেন, ভদ্রে! তুমি একাকিনী এই স্থানে আগমন কর। বালকগণ ঐ স্থানেই থাকুক। কুন্তী মাদ্রীর বচনানুসারে কুমারগণকে রাখিয়া একাকিনী হা হতাস্মি বলিয়া রোদন করিতে করিতে তথায় গমনপূর্বক দেখিলেন, মাদ্রী রাজার মৃতদেহ আলিঙ্গন করিয়া ভূমিতলে শয়ান। আছেন। তখন তিনি শিরে করাঘাত করিয়া বিলাপ করিতে করিতে মাদ্রীকে সম্বোধন করিয়া কহিলেন,আমি রাজাকে সর্বদা রক্ষা করিতাম, ইনি অতিশয় জিতেন্দ্রিয় ছিলেন; তবে ইনি মৃগশাপ জানিয়া শুনিয়া ও কি নিমিত্ত তোমাকে বলাৎকার করিতে প্রবৃত্ত হইলেন? দেখ, আমি যেরূপ ইহাঁকে রক্ষা করিতাম, তোমারও সেইরূপ করা কর্তব্য ছিল, তবে কেন ইহাঁকে নির্জনে আনিয়া প্রলোভিত করিলে? মৃগশাপবিষয়িনী চিন্তা ইহার হৃদয়ে সর্বদা জাগরূক থাকিত, তর্নিমিত্ত নিয়তই যৎপরোনাস্তি দুঃখিত থাকিতেন; অদ্য তোমাকে নির্জনে পাইয়া কি নিমিত্ত ইহার মন চঞ্চল হইল? মদ্ররাজনন্দিনী! তুমি ধন্য ও আমা হইতে অধিকতর সৌভাগ্যবতী, যেহেতু তুমি অদ্য মহারাজের প্রসন্ন বদন দেখিয়ছি। মাদ্রী কুন্তীর এইরূপ পরিদেবনবাক্য শ্রবণ করিয়া কহিলে,-দেবি! এ বিষয়ে আমার কোন অপরাধ নাই। রাজর্ষি বলাৎকারে উদ্যত হইলে, আমি অতি করুণস্বরে তাহাকে ভূয়রীভূয়ঃ নিষেধ করিয়াছিলাম, কিন্তু তিনি আমাদের দুরদৃষ্টক্রমেই হউক বা ঋষিশাপের অনুল্লঙ্ঘীয়তাপ্রযুক্তই হউক, অথবা দুর্দান্ত মদনের অনিবাৰ্যতাবশতই হউক, আমার বাক্যে একবার কর্ণপাতও করিলেন না।
পতিব্রতা কুন্তী মাদ্রীর বচনাবসানে কহিলেন,-ভদ্রে! যাহা হইবার হইয়াছে। এক্ষণে তোমার নিকট এক প্রার্থনা করি, শ্রবণ কর। আমি রাজর্ষির জ্যেষ্ঠ। ধর্মপত্নী, সুতরাং শ্রেষ্ঠ ধর্মফল আমারই প্রাপ্য; অতএব আমি পরলোকগত ভর্তার সহগমন করিব, তুমি ঐ বিষয়ে আমাকে নির্ধারণ করিও না, তুমি গাত্রোত্থান কর। অতি সাবধানে এই সকল সন্তানগুলি প্রতিপালন করিও। আমি মহারাজের মৃতদেহ লইয়া চিতারোহণ করি। মাদ্রী কহিলেন, “আৰ্য্যে! আমি স্বামিসহবাসে অদ্যাপি পরিতৃপ্ত হই নাই, অতএব আমিই ইহার সহগমন করিব; অনুগ্ৰহ করিয়া আমাকে এ বিষয়ে অনুমতি করিতে হইবে। আরও দেখ, মহারাজ আমাতেই আসক্ত হইয়া প্রাণত্যাগ করিয়াছেন, তন্নিমিত্ত যমভবনে গমন করিয়া তাহার অভিলাষ পরিপূর্ণ করা আমার প্রধান ধর্ম ও অত্যন্ত অবশ্য কর্তব্য কর্ম। বিশেষতঃ যদি আমি জীবিত থাকিয়া আপনার পুত্রদ্বয়ের ন্যায় তোমার পুত্রগণকে স্নেহ করিতে না পারি, তাহা হইলে অবশ্যই আমাকে ইহকালে লোকনিন্দায় ও পরকালে ঘোরতর নরকে নিপতিত হইতে হইবে। অতএব সহগমন করাই আমার পক্ষে শ্রেয়ঃকল্প। এক্ষণে তোমার নিকট আমার এই ভিক্ষা যে, মহারাজের মৃতদেহের সহিত আমার কলেবর দগ্ধ কর। আমার পুত্রদ্বয়কে আপন পুত্রগণের ন্যায় স্নেহ ও অপ্রমত্তচিত্তে প্রতিপালন করিবে, ইহা ব্যতীত আমার আর কিছুই বক্তব্য নাই। মদ্ররাজদুহিতা কুন্তীকে এই কথা বলিয়া রাজার মৃতদেহ আলিঙ্গনপূর্বক কলেবর পরিত্যাগ করিলেন।