১২৪. নকুল-সহদেবের জন্ম
চতুর্বিংশত্যধিক শততম অধ্যায়।
বৈশম্পায়ন কহিলেন,-কুন্তীপুত্রগণের ও ধৃতরাষ্ট্রতনয়দিগের জন্ম হইলে মদ্ররাজদুহিতা নির্জনে পাণ্ডুকে কহিলেন, মহারাজ! দুর্ভাগ্যক্রমে আপনি ঋষিশাপে সন্তানোৎপাদনে বঞ্চিত হইয়াছেন, তাহাতে আমার কোন সন্তাপ নাই; আমি বরাহ হইয়াও হীনাবস্থায় রহিয়াছি, তাহাতেও আমার পরিতাপ নাই, কিংবা গান্ধারী শতপুত্রের মাতা হইয়াছেন বলিয়া আমার এক মুহূর্তের নিমিত্তও ঈর্ষা হয় না; কিন্তু হে মহারাজ! আমার অত্যন্ত দুঃখের বিষয় এই যে, কুন্তী ও আমি এই দুইজনই আপনার ভাৰ্য্যা, উভয়েই সমান; কিন্তু কুন্তী পুত্রবতী হইলেন, আমি পুত্রমুখ নিরীক্ষণে বঞ্চিত রহিলাম। হে রাজন্! যদি কুন্তী আমার প্রতি অনুগ্রহ করেন, তাহা হইলেই আমার পুত্র হয়, আর আপনারও অধিক অপত্য লাভ দ্বারা মহৎ উপকার জমে। কিন্তু কুন্তী আমার সপত্নী, আমি কোনক্রমেই তাঁহার নিকট প্রার্থনা করিতে পারিব না। তবে যদি আপনি প্রসন্ন হইয়া তাহাকে অনুরোধ করেন, তাহা হইলেই আমি চরিতার্থ হইতে পারি। রাজর্ষি পাণ্ডু তাহার বাক্য শ্রবণ করিয়া কহিলেন, প্রিয়ে! উত্তম বলিয়াছ, ইহা আমার নিতান্ত অভিলষিত, কেবল তোমার মত হয় কি না, এই সন্দেহ প্রযুক্ত তোমাকে বলি নাই; এক্ষণে ইহা তোমার অনুমোদিত জানিতে পারিয়াছি; অবশ্যই আমি তোমার মনোরথ সিদ্ধির নিমিত্ত কুন্তীকে এ বিষয়ে অনুরোধ করিব। কুন্তী কখনই আমার বাক্য উল্লঙ্ঘন করিবে না।
পাণ্ডু মাদ্রীকে এই কথা বলিয়া কুন্তীর নিকট গমন পূর্বক তাহাকে নিৰ্জ্জনে কহিতে লাগিলেন, হে পৃথে! দেখ, ইন্দ্র ত্রিদশাধিপত্য লাভ করিয়াও যশোলিায় যজ্ঞানুষ্ঠান করেন; তপঃসাধ্যায়সম্পন্ন মন্ত্রবিৎ ব্রাহ্মণগণ কেবল যশের নিমিত্তই গুরুকরণ করিয়া থাকেন এবং রাজর্ষিগণ ও তপোধন ব্রাহ্মণগণ যশোভিলাষে নানাবিধ সৎকর্মের অনুষ্ঠানে যত্নবান হয়েন; অতএব হে প্রিয়ে! তুমি আমার বংশবৃদ্ধির নিমিত্ত, আমার ও পূর্বপুরুষগণের পিণ্ডরক্ষার নিমিত্ত, পতির প্রিয়ানুষ্ঠানের নিমিত্ত এবং আপনার যশোর্ধনের নিমিত্ত একবার মাদ্রীর প্রতি অনুকম্পা করিয়া উহাকে পুত্রবতী কর। হে পৃথে! পুত্ৰদান দ্বারা মাদ্রীকে পরিত্রাণ কর, ইহাতে তোমার যশোবৃদ্ধি হইবে। কুন্তী পাণ্ডনৃপতির বাক্য শ্রবণানন্তর মাদ্রীকে কহিলেন, তুমি কোন দেবতাকে আহ্বান কর, তাহা হইলে অচিরকালমধ্যে তোমার অনুরূপ পুত্রলাভ হইবে, সন্দেহ নাই।
মাদ্রী কুন্তীর আদেশক্রমে কিয়ৎক্ষণ মনে মনে বিচার করিয়া অশ্বিনীকুমারকে স্মরণ করিলেন। অশ্বিনীকুমার তৎক্ষণাৎ তথায় সমুপস্থিত হইয়া তাঁহার গর্ভে যমজ পুত্র উৎপাদন করিলেন। ঐ পুত্রদ্বয়ের নাম নকুল ও সহদেব। তাঁহারা ভূমিষ্ঠ হইবামাত্র দৈববাণী হইল, হে কুমারদ্বয়! তোমরা অশ্বিনীকুমার অপেক্ষা সমধিক সত্ত্বসম্পন্ন, রূপবান, গুণশালী ও তেজস্বী হইয়া পরমসুখে কালযাপন কর। শতশৃঙ্গবাসী মহর্ষিগণ যথাবিধি আশীৰ্ব্বচন বিধানপূর্বক প্রীতমনে তাঁহাদের নামকরণ করিলেন। কুম্ভীর পুত্রয়ের মধ্যে জ্যেষ্ঠের নাম যুধিষ্ঠির, মধ্যমের নাম ভীম, কনিষ্ঠের নাম অর্জুন হইল। মাদ্রীর পুত্রদ্বয়ের মধ্যে পূর্বজের নাম নকুল, দ্বিতীয়ের নাম সহদেব হইল। পাণ্ডুপুত্র গণ প্রত্যেকে এক এক সংবৎসর অন্তর জন্মগ্রহণ করিয়াছিলেন, তথাপি তাহাদিগকে সমবয়স্ক বোধ হইত। তাহারা সকলেই মহাসত্ত্ব, মহাবীৰ্য্য, মহাবল ও পরাক্রান্ত ছিলেন। রাজর্ষি পাণ্ডু সেই দেবতুল্য রূপবান, মহাতেজস্বী পুত্রগণকে দেখিয়া আহ্লাদসাগরে মগ্ন হইলেন। পাণ্ডুপুত্রগণ ক্রমে ক্রমে শতশৃঙ্গবাসী মুনি ও মুনিপত্নীগণের সাতিশয় প্রিয়পাত্র হইয়া উঠিলেন।
কিয়দ্দিনানন্তর রাজর্ষি পাণ্ডু পুনৰ্বার মাদ্রীর গর্ভে সুতোৎপাদনের নিমিত্ত কুন্তীকে অনুরোধ করাতে তিনি কহিলেন, “মহারাজ! মাদ্রী অতিশয় ধূর্ত; সে একধার দেবতাহান করিয়া দুই পুত্র উৎপাদন করিয়াছে। আমি পূর্বে জানিতাম না যে, দুইজনকে একেবারে আহ্বান করিলে দুই ফল লাভ হয়, তন্নিমিত্ত আমি ঐ ফলে বঞ্চিত হইলাম, অতএব হে মহারাজ! আমি কৃতাঞ্জলিপুটে কহিতেছি, আর আমাকে, ও বিষয়ে অনুরোধ করিবেন না। কুন্তীবাক্য শ্রবণ করিয়া রাজর্ষি পাণ্ডু অগত্যা তাহাতে সম্মত হইয়া নিরস্ত রহিলেন। হে ভরতবংশাবতংস জনমেজয়! এইরূপে দেবদত্ত পাণ্ডুপুত্রগণ হৈমবৎপৰ্বতে থাকিয়া কিয়দ্দিনের মধ্যে বীৰ্য্যবান, যশস্বী, শুভলক্ষণসম্পন্ন, চন্দ্ৰতুল্য প্রিয়দর্শন, সিংহের ন্যায় দর্পশালী, সৰ্বধনুর্ধরাগ্রগণ্য ও দেবতুল্য বিক্রমশালী হইয়া উঠিলেন। তত্ৰত্য মহর্ষিগণ তাহাদিগের লক্ষণ, পরাক্রম ও রূপলাবণ্য দর্শনে সাতিশয় বিস্ময়পন্ন হইলেন। এদিকে দুৰ্য্যোধন প্রভৃতি ধৃতরাষ্ট্রের পুত্রগণ অতি অল্পদিনের মধ্যে জলাশয়স্থ কমলের ন্যায় দিন দিন পরিবর্ধিত হইতে লাগিল।