১২৩. পুত্রার্থ ধর্মাদির আহ্বান, যুধিষ্ঠিরের জন্ম ভীমের জন্ম, অর্জুনের জন্ম
ত্রয়োবিংশত্যধিকশততম অধ্যায়
বৈশম্পায়ন কহিলেন, হে কুরুবংশাবতংস জনমেজয়! কুন্তী স্বামীর আদেশানুসারে মন্ত্র পাঠ করিয়া ধর্মকে আহ্বান করিলেন। হে কুরুনন্দন! ধৃতরাষ্ট্রপত্নী গান্ধারী সেই সময়ে গর্ভবতী ছিলেন। যে দিবস কুন্তী ধর্মকে আহ্বান করেন, ঐ দিন তাহার সম্বৎসর পূর্ণ হয়। কুন্তী বিবিধোপচারে ধর্মের উদ্দেশে পূজা সাঙ্গ করিয়া অহর্ষি কর্তৃক প্রদত্ত মহামন্ত্র জপ করিতে লাগিলেন। সুরশ্রেষ্ঠ ধর্ম সূৰ্যোপম, জলদনলসস্নিভ বিমানে আরোহণ করিয়া তাঁহার সমীপে সমুপস্থিত হইলেন এবং হাসিতে হাসিতে কুন্তীকে কহিলেন, সুন্দরি! কি নিমিত্ত আমাকে আহ্বান করিলে? বল, তোমাকে কি অভীষ্ট প্রদান করিব? কুন্তী তাঁহার বাক্য শ্রবণ করিয়া হৃষ্টচিত্তে কহিলেন, মহাত্মন্! আপনি অনুগ্ৰহ করিয়া আমাকে এক সন্তান প্রদান করুন। ধর্ম তৎক্ষণাৎ স্বীকার করিয়া তাঁহার গর্ভে সৰ্বপ্ৰাণিহিতকর পরম যশস্বী এক পুত্র উৎপাদন করিলেন। ঐ পুত্র ইন্দ্ৰদৈবত চন্দ্ৰসংযুক্ত অভিজিৎ নামক অষ্টম মুহূর্তে মধ্যাহ্ন সময়ে জন্মগ্রহণ করিল। সন্তান জন্মিবামাত্র দৈববাণী হইল, “এই যে পাণ্ডুর প্রথমজাত পুত্র, ইনি পরম ধাৰ্মিক, বিক্রমশালী, সত্যবাদী, যশস্বী, তেজস্বী ও ব্ৰতাচারী হইবেন এবং যুধিষ্ঠির নামে ত্রিভুবনবিশ্রুত নরপতি হইয়া ঔরসবৎ প্রজাবর্গের প্রতিপালন করিবেন।”
রাজর্ষি পাণ্ডু সেই পরম ধার্মিক পুত্র প্রাপ্ত হইয়া পুনর্বার কুন্তীকে কহিলেন, প্রিয়ে। ক্ষত্রিয়কুলে বলবান ব্যক্তি অধিকতর প্রশংসনীয়; অতএব তুমি আর একটি অমিতবলশালী পুত্র উৎপাদন কর। কুন্তী স্বামীর আজ্ঞা প্রতিপালনার্থ মহর্ষিদত্ত মন্ত্রপাঠপূর্বক বায়ুকে আহ্বান করিলেন। মহাবলপরাক্রান্ত বায়ু তৎক্ষণাৎ মৃগারোহণপূর্বক তাঁহার সমীপে উপনীত হইলেন এবং কহিলেন,-কুন্তী! কি নিমিত্ত আমাকে আহ্বান করিলে? তোমাকে কি অভীষ্ট প্রদান করিতে হইবে? লজ্জানমুখী কুন্তী ঈষৎ হাস্য করিয়া কহিলেন, হে সুয়োতম! আপনি অনুকূল হইয়া আমাকে এক মহাবল পরাক্রান্ত মহাকায়দর্পবিনাশকারী পুত্র প্রদান করুন। বায়ু কুন্তীর প্রার্থনাসারে তাহার গর্ভে উক্ত প্রকার পুত্র উৎপাদন করিলেন। এই পুত্রের নাম ভীম; ভীম জন্মিবামাত্র “বলবীৰ্য্যসম্পন্নদিগের অগ্রগণ্য মহাবীর জন্মগ্রহণ করিলেন” এই দৈববাণী হইল। এই দৈববাণীর পর আর এক আশ্চর্য ব্যাপার ঘটিয়াছিল। সদ্যপ্রসূতভীমসেন স্বীয় জননীর উৎসঙ্গে নিদ্রিত ছিলেন, এমন সময়ে তাহার মাতা ব্যাঘ্ৰভয়ে এরূপ ভীত হইলেন যে, ক্রোড়স্থিত ভীমসেনকে বিস্মৃত হইয়া পলায়নচেষ্টায় সহসা গাত্রোত্থান করিলেন। জননী গাত্রোত্থান করিলে ভীম তাঁহার ক্রোড় হইতে পর্বতের উপর নিপতিত হইলেন; ভীমের বজ্রসম শরীরাঘাতে গিরিবর একেবারে চুর্ণ হইয়া গেল। পাণ্ডু তদ্দর্শনে সাতিশয় বিস্ময়াপন্ন হইলেন। হে ভরতসত্তম! ভীমের জন্মদিবসেই দুৰ্য্যোধন জন্ম গ্রহণ করেন।
মহাবীর বৃকোদরের জন্ম হইলে পর, পাণ্ডু পুনৰ্বার চিন্তা করিতে লাগিলেন যে, কি প্রকারে আমার এক সৰ্বলোকশ্রেষ্ঠ পুত্র জন্মিবে। সমস্ত লোকই দৈব ও পুরুষকার অবলম্বন করিয়া চলে, তন্মধ্যে দৈবকে কালক্রমেই লাভ করিতে পারা যায়। শুনিয়াছি, অমররাজ ইন্দ্ৰ সর্বদেবশ্রেষ্ঠ ও অপ্রমেয় বলবীৰ্যসম্পন্ন, আমি কায়মনোবাক্যে তপোনুষ্ঠান করিয়া তাহাকে সন্তুষ্ট করি। পরিশেষে তাহার নিকট হইতে অমিতবলশালী পুত্র প্রার্থনা করিয়া লইব। ইন্দ্রের বরে অবশ্যই আমার মহাবল পরাক্রান্ত পুত্র জন্মিবে এবং সেই পুত্র সংগ্রামে সুরাসুর, নাগ, নর, গন্ধর্ব প্রভৃতি সমস্ত প্রাণীকেই জয় করিতে পারিবে। রাজর্ষি পাণ্ডু মনে মনে এইরূপ সংকল্প করিয়া মহর্ষিগণের সহিত মন্ত্রণাপূর্বক কুন্তীকে সাম্বৎসরিক ব্ৰতানুষ্ঠানের আদেশ প্রদান করিলেন এবং আপনিও একাগ্রচিত্তে প্রাতঃকালাবধি সায়ংকাল পর্যন্ত এক পদে দণ্ডায়মান থাকিয়া কঠোর তপস্যাচরণ ও দেবরাজের আরাধনা করিতে লাগিলেন। এইরূপে পাণ্ডু পুত্রকামনায় বহুকাল কঠোর তপস্যার অনুষ্ঠান করিলেন। দেবরাজ তদীয় তপঃপ্রভাবে প্রসন্ন হইয়া তাহার সমীপে আগমন পূর্বক কহিলেন-হে রাজর্ষে! আমি তোমার তপোনিষ্ঠ। দর্শনে সাতিশয় সন্তুষ্ট হইয়াছি, তোমাকে তোমার মনোমত পুত্রবর প্রদান করিয়া যাইব, আমার অনুগ্রহে তোমার পুত্র জন্মিবে। ঐ পুত্র ত্রিলোকবিশ্রুত, গোব্রাহ্মণহিতকারী, সুহৃদগণের অনিন্দবর্ধন ও শত্ৰুদিগের হৃদয়বিদারক হইবে। দেবরাজ এই বলিয়া অন্তর্হিত হইলেন; রাজর্ষি পাণ্ডুও অভীষ্ট সিদ্ধি হওয়ায় পরম পরিতুষ্ট হইয়া কুন্তীর নিকট গমন পূর্বক কহিলেন, কল্যাণি! আমাদিগের মনোরথ পূর্ণ হইয়াছে, অমররাজ সুপ্রসন্ন হইয়া অভিলাষানুরূপ, অতিমানুষকর্মা, যশস্বী, অরাতিনিসূদন, নীতিশাস্ত্রবিশারদ, মহাত্মা, সূৰ্য্যবম তেজস্বী, দুরাধর্ষ, ক্রিয়াবান, অদ্ভুতদর্শন পুত্র প্রদানের অঙ্গীকার করিয়াছেন; এক্ষণে তুমি সেই ত্রিদশাধিপতিকে আহ্বান করিয়া তাহা হইতে পুত্র উৎপাদন করিয়া লও।
কুন্তী পতির আজ্ঞানুসারে মহর্ষিদত্ত মন্ত্র জপ করিয়া ইন্দ্রদেবের আবাহন করিলেন। কুন্তীর আবাহনে দেবরাজ তৎক্ষণাৎ আসিয়া উপস্থিত হইলেন এবং তাঁহার গর্ভে পাণ্ডুর প্রার্থনানুরূপ পুত্র উৎপাদন করিলেন; ঐ পুত্রের নাম অর্জুন। অর্জুন জন্মিবামাত্র মহাগভীরনির্ঘোষে আকাশবাণী হইল, নবাসীগণ শ্রবণ করিয়া বিস্ময়াবিষ্ট হইলেন। নভোমণ্ডল শায়মান হইল। কুন্তী একাগ্রচিত্তে ছিলেন; শুনিলেন, হে পৃথে! তোমার এই পুত্র কাবীর্য্যোপম, শিবসম পরাক্রমশালী ও ইন্দ্রবৎ অজয্য হইয়া চতুর্দিকে যশোরাশি বিস্তার করিবেন। যেমন বিষ্ণু হইতে অদিতির প্রতি বৰ্ধিত হইয়াছিল, অর্জুন হইতে তোমারও সেইরূপ প্রীতি লাভ হইবে। অর্জুন স্বীয় ভুজবলে কুরু, সোম, চেদি, কাশি, করুষ প্রভৃতি নানা জনপদ বশীভূত করিয়া কুরুকুলের শ্রীবৃদ্ধি করিবেন। ইহার বাহুবলে ভগবান্ হুতাশন খাণ্ডববনে সর্বভূতের মেদ ভক্ষণ করিয়া পরম পরিতৃপ্ত হইবেন। এই মহাবল পরাক্রান্ত মহাবীর, গ্রাম্য মহীপালগণকে জয় করিয়া ভ্রাতৃগণের সহিত যজ্ঞত্রয় সম্পন্ন করিবেন। হে পৃথে! তোমার এই পুভ্র পরশুরামসম তেজস্বী, বিষ্ণুতুল্য পরাক্রান্ত, বলবাদিগের অগ্রগণ্য ও মহাযশস্বী হইবেন। ইনি সংগ্রামে দেবাদিদেব মহাদেবকে পরিতুষ্ট করিয়া তাহার নিকট হইতে পাশুপতনামে মহাস্ত্র প্রাপ্ত হইবেন। ইনি দেবরাজ ইন্দ্রের আজ্ঞানুসারে দেবগণের পরম শত্রু নিবাতকবচনামক দৈত্য সকলকে বিনাশ করিবেন। ইনি সমস্ত দিব্যাস্ত্র সংগ্রহ করিয়া বিনষ্ট রাজ্যের প্রত্যুষ্কার করিবেন।”
হে ভরতবংশাবতংস! এই দৈববাণী শ্রবণে কুন্তী পরমাহলাদিত ও সাতিশয় আশ্চর্যান্বিত হইলেন। শতশৃঙ্গনিবাসী তপস্বিগণের ও ইন্দ্রাদি অমরনিকরের অহিলাদের আর পরিসীমা রহিল না। পুষ্পবৃষ্টি পতিত হওযায় দিঘণ্ডল আচ্ছন্ন ও বাসিত হইল। আকাশে দুন্দুভিধ্বনি হইতে লাগিল। সমস্ত দেবগণ একত্র হইয়া অর্জুনকে স্তব করিতে লাগিলেন। সর্প সমুদায়, বিহঙ্গমকুল, গন্ধর্বগণ অষ্পরা সকল, প্রজাপতিগণ, সপ্তর্ষিমণ্ডল, ভরদ্বাজ, কশ্যপ, গৌতম, বিশ্বামিত্র, জমদগ্নি, বশিষ্ঠ এবং ভগবান্ অত্রি তথায় আগমন করিলেন। মরীচি, অঙ্গিরা, পুলস্ত্য, পুলহ, ক্রতু, দক্ষপ্রজাপতি এবং দিব্যমাল্যাম্বরষ্কারী গন্ধর্বগণ ও অপ্সরাগণ অর্জুনসমীপে গান করিতে আরম্ভ করিলেন। অপ্সরাগণ নৃত্য করিতে লাগিল। মহর্ষিরা চতুর্দিকে তপস্যা করিতে লাগিলেন। ভীমসেন, উগ্রসেন, ঊর্ণায়ু, অনঘ, গোপতি, ধৃতরাষ্ট্র, সূৰ্যবৰ্চ্চাঃ, যুগপ, তৃণপ, কাফিনন্দি, চিত্ররথ, সালিশিরা, পর্জ্জন্য, কলি, নারদ, সত্বাবৃহত্ত্বাবৃহক, করাল, বহুগুণশালী ব্রহ্মচারী, সুবর্ণ, বিশ্বাবসু, সুম, সুচন্দ্র, শরূ এবং গীতমাধুৰ্য্যসম্পন্ন সুবিখ্যাত হাহা ও হুহু ইত্যাদি গন্ধর্বগণ সমভিব্যাহারে শ্রীমান্ তুম্বুরু আসিয়া অর্জুন সমীপে মধুরস্বরে গান করিতে লাগিলেন। নানালঙ্কারভূষিত। বিশালনয়না, অনুচানা, অনবদ্যা, গুণমুখ্যা, গুণাবরা, অদ্রিকা, সোমা, মিশ্রকেশী, অলম্বুষা, মরীচি, শুচিকা, বিদ্যুৎপর্ণা, তিলোত্তমা, অম্বিকা, লক্ষণ, ক্ষেমা, রম্ভা, মনোরমা, অসিতা, সুবাহু, সুপ্রিয়া, বপুঃ, পুণ্ডরীকা, সুগন্ধা, সুরসা, প্রমাথিনী, কাম্য, শারদ্বতী, মেনুকা, সহজা, কর্ণিকা, পুঞ্জিকস্থলা, ঋতুস্থলা, ঘৃতাচী, বিশ্বাচী, পূর্বচিতি, উম্লোচা, প্রম্লোচা, উৰ্বশী প্রভৃতি অপ্সরাসকল পরমানন্দে নৃত্য ও গান করিতে লাগিলেন। ধাতা, অৰ্যমা, মিত্র, বরুণ, ভগ, ইন্দ্র, বিবস্বান, পূষা, ত্বষ্টা, সবিতা, পৰ্যন্ত ও বিষ্ণু, এই দ্বাদশ আদিত্য, ইহারা আকাশে থাকিয়া অর্জুনের মহিমাবর্ধন করিতে লাগিলেন। মৃগব্যাধ, সর্প, নিঋতি, অজৈকপাদ, অহিঃ, পিণাকী, দহন, ঈশ্বর, কপালী, স্থাণু ও ভগবান্ ভগ এই একাদশ, রুদ্র তথায় অবস্থান করিয়াছিলেন। অশ্বিনীকুমার, অষ্টবসু, মহাবল মরুদগণ, বিশ্বেদেবগণ ও সাধ্যগণ অর্জুনের চতুর্দিক বেষ্টন করিয়া রহিলেন। কর্কোটক, বাসুকী, কচ্ছপ এবং কুণ্ড ও তক্ষক ইত্যাদি মহাতপাঃ মহাবল পরাক্রান্ত মহাক্রোধশালী মহোরগগণ এবং তাক্ষ, অরিষ্টনেমি, গর, আসিধ্বজ, অরুণ, আরুণি প্রভৃতি বৈনতেয়গণ তথায় আগমন করিলেন। বিমান ও গিরিশৃঙ্গের অগ্রগত ঐ সমস্ত সমভ্যাগত দেবগণকে কেবল তপেবলসম্পন্ন সিদ্ধ মহর্ষিগণই দেখিতে পাইলেন, অন্যান্য লোকে নেত্রগোচর করিতে পারিল না। মহর্ষিগণ সেই আশ্চর্য ব্যাপার অবলোকন করিয়া সাতিশয় বিস্ময়াপন্ন হইলেন এবং তদবধি পাণ্ডবগণের প্রতি অধিকতর শ্রদ্ধা করিতে লাগিলেন।
অর্জুনের জন্ম হইলে রাজর্ষি পাণ্ডু অপর এক পুত্রের কামনায় কুন্তীর নিকট প্রার্থনা করিলেন। কুন্তী তাঁহার আশয় বুঝিতে পারিয়া কহিলেন, মহাত্মন্! আর আমাকে পুরুষান্তরসংসর্গের অনুরোধ করিবেন না। শাস্ত্রকারেরা কহিয়া গিয়াছেন যে, স্ত্রীলোক আপৎকাল উপস্থিত হইলে তিনবার পৰ্যন্ত পরপুরুষদ্বারা সন্তানোৎপাদন করিতে পারে, তিন বারের অধিক কোনক্রমেই পুরুষান্তরসংসর্গ করিতে পারে না। যে নারী চারিবার পরপুরুষের সহিত সংসর্গ করে, তাহাকে স্বৈরিণী কহে। পাঁচবার উক্ত প্রকার কার্যে লিপ্ত হইলে বেশ্যাপদবাচ্য হইয়া থাকে; অতএব হে বিদ্বন্! তুমি ধর্মজ্ঞ হইয়াও কি নিমিত্ত নিতান্ত উদ্ভ্রান্তচিত্তের ন্যায় আমাকে পুনর্বার অপত্যোৎপাদনের অনুমতি করিতেছ?