১২৩. ত্রিগৰ্ত্তরক্ষিত দুঃশাসনসহ সাত্যকির যুদ্ধ

১২৩তম অধ্যায়

ত্রিগৰ্ত্তরক্ষিত দুঃশাসনসহ সাত্যকির যুদ্ধ

সঞ্জয় কহিলেন, “হে মহারাজ! এদিকে দুঃশাসন বারিধারাবর্ষী পর্জ্জন্যের ন্যায় অসংখ্য শরবর্ষণপূর্ব্বক শৈনেয়ের প্রতি ধাবমান হইয়া তাঁহাকে প্রথমতঃ ষষ্টি ও তৎপরে যোড়শশরে সমাহত করিলেন। মহাবীর সাত্যকি তাঁহার শরে কিছুমাত্র বিচলিত না হইয়া মৈনাকপর্ব্বতের ন্যায় অবস্থান করিতে লাগিলেন। তখন ভরতশ্রেষ্ঠ দুঃশাসন নানাদেশীয় মহারথগণের সহিত মিলিত হইয়া অসংখ্য সায়ক বর্ষণপূর্ব্বক মেঘনিঃস্বনসদৃশ গভীরগর্জ্জনে দশদিক প্রতিধ্বনিত করিয়া সাত্যকিকে আক্রমণ করিলেন। মহাবাহু সাত্যকি তদ্দর্শনে ক্রোধভরে ধাবমান হইয়া শরসন্নিপাতে তাঁহাকে আচ্ছন্ন করিয়া ফেলিলেন। দুঃশাসনের অগ্রগামী অন্যান্য বীরগণ সাত্যকির শরে সমাচ্ছন্ন হইয়া ভীতিচিত্তে আপনার পুত্রের সমক্ষেই পলায়ন করিল। তৎকালে একমাত্র দুঃশাসন নির্ভীকমনে রণস্থলে অবস্থানপূর্ব্বক সাত্যকিকে শরনিপীড়িত করিয়া তাঁহার অশ্বগণের উপর চারি ও সারথির উপর তিন বাণ নিক্ষেপপূর্ব্বক পুনর্ব্বার শতশরে তাঁহাকে বিদ্ধ করিয়া সিংহনাদ পরিত্যাগ করিতে লাগিলেন। অরাতিনিপাতন সাত্যকি ক্রোধজ্বলিত হইয়া শরসন্নিপাতে দুঃশাসনের সারথি ও ধ্বজ অদৃশ্য করিয়া ফেলিলেন এবং ঊর্ণনাভ যেমন সমাগত মশককে স্বীয় জালে জড়িত করে, তদ্রূপ তিনি দুঃশাসনকে শরজালে জড়িত করিলেন।

সাত্যকিকর্ত্তৃক পঞ্চশত ত্রিগর্ত্তবীরবধ

“হে মহারাজ! ঐ সময়ে রাজা দুর্য্যোধন দুঃশাসনকে বাণসমাচ্ছন্ন দেখিয়া যুদ্ধবিশারদ ত্রিসহস্র ক্রূরকর্ম্মা ত্রিগৰ্ত্তকে সাত্যকির সহিত যুদ্ধার্থ প্রেরণ করিলেন। তাহারা দুর্য্যোধনের আদেশক্রমে তথায় গমনপূর্ব্বক দৃঢ়তর অধ্যবসায়সহকারে অপরাঙ্মুখ হইয়া অসংখ্য শরদ্বারা সাত্যকিকে অবরোধ করিতে লাগিল। তখন শিনিপুঙ্গব সাত্যকি সেই শরবর্ষী ত্রিগর্ত্তগণের প্রধানতম পাঁচশত যোদ্ধাকে নিহত করিলেন। তাহারা মারুতবেগবিধ্বস্ত বিপুল বনস্পতিসমুদয়ের ন্যায় ধরাতলে নিপতিত হইল। শৈনেয়ের শরে নিকৃত্ত, শোণিতলিপ্ত, অসংখ্য – হস্তী, ধ্বজ ও কনকাভরণভূষিত অশ্বসকল নিপতিত হওয়াতে সমরভূমি বিকশিত কিংশুকসমাচ্ছন্নের ন্যায় বোধ হইতে লাগিল। কৌরবপক্ষীয় যোধগণ সাত্যকির শরে বিদ্ধ হইয়া পঙ্কনিমগ্ন মাতঙ্গের ন্যায় কাহারও সহায়তালাভে সমর্থ হইল না। ভীষণ ভুজগগণ যেরূপ গরুড়ের ভয়ে গর্ত্তমধ্যে প্রবেশ করে, তদ্রূপ সেই কৌরবসৈন্যগণ সকলেই ভীত হইয়া দ্রোণের নিকট পলায়ন করিল। এইরূপে মহাবীর সাত্যকি আশীবিষসদৃশ তীক্ষ্ণশরনিকরে পাঁচশত যোদ্ধাকে নিপাতিত করিয়া মন্দবেগে ধনঞ্জয়ের নিকট গমন করিতে লাগিলেন। তদ্দর্শনে আপনার পুত্র দুঃশাসন তাঁহার উপর সত্বর সন্নতপর্ব্ব নয় বাণ নিক্ষেপ করিলেন; মহাধনুর্দ্ধর সাত্যকিও তাঁহাকে রুক্মপুঙ্খ নিশিতপাঁচশরে বিদ্ধ করিলেন। তখন মহাবীর দুঃশাসন সাত্যকিকে প্রথমতঃ তিন ও তৎপরে পাঁচশরে আঘাত করিয়া হাস্য করিতে লাগিলেন। মহাবীর শৈনেয় তদ্দর্শনে ক্রুদ্ধ হইয়া তাঁহার উপর পাঁচ শর নিক্ষেপ ও তাঁহার শরাসন ছেদন করিয়া হাসিতে হাসিতে ধনঞ্জয়ের নিকট ধাবমান হইলেন। মহাবীর দুঃশাসন তাঁহাকে গমন করিতে দেখিয়া রোষাবিষ্টচিত্তে তাঁহার নিধনবাসনায় লৌহময়ী শক্তি নিক্ষেপ করিলে বীরবর সাত্যকি তৎক্ষণাৎ কঙ্কপত্রভূষিত নিশিত বাণদ্বারা দুঃশাসনের সেই শক্তি ছেদন করিয়া ফেলিলেন। তখন মহাবীর দুঃশাসন অন্য এক শরাসন গ্রহণপূর্ব্বক শরদ্বারা সাত্যকিকে বিদ্ধ করিয়া সিংহনাদ পরিত্যাগ করিতে লাগিলেন।

দুঃশাসনপরাজয়-পলায়ন

“অনন্তর মহাবীর সাত্যকি তাঁহার সিংহনাদবণে একান্ত ক্রোধাবিষ্ট হইয়া তাঁহার বক্ষঃস্থলে অগ্নিশিখাকার শরসমুদয় নিক্ষেপপূর্ব্বক পুনরায় তাঁহাকে সুতীক্ষ্ণ আটবাণে বিদ্ধ করিলেন। মহাবীর দুঃশাসন বিংশতিসায়কে সাত্যকিকে বিদ্ধ করিয়া সিংহনাদ করিতে লাগিলেন। তখন পরমাস্ত্রবিৎ মহারথ সাত্যকি দুঃশাসনের বক্ষঃস্থলে সন্নতপর্ব্ব তিন শর নিক্ষেপ করিয়া শাণিত শরসন্নিপাতে তাঁহার ঘোটক ও সারথিকে বিনষ্ট করিলেন এবং একভল্লে তাঁহার ধনু, পাঁচভল্লে শরমুষ্টি, দুইভল্লে ধ্বজ ও রথশক্তি ছেদন করিয়া অন্যান্য তীক্ষ্ণবাণে তাঁহার পৃষ্ঠরক্ষকদ্বয়কে বিনাশ করিয়া ফেলিলেন। ত্রিগৰ্তসেনাধিপতি দুঃশাসনকে ছিন্নশরাসন, বিরথ, হতাশ ও হতসারথি অবলোকনপূর্ব্বক সত্বর স্বরথে আরোপিত করিয়া রণস্থল হইতে অপসারিত করিতে লাগিলেন। মহাবীর সাত্যকি দুঃশাসনবিনাশার্থ কিয়ৎক্ষণ তাঁহার পশ্চাদ্ধাবন করিলেন, কিন্তু মহাবাহু ভীমসেন সভামধ্যে সৰ্ব্বসমক্ষে আপনার পুত্রগণকে বিনাশ করিতে প্রতিজ্ঞা করিয়াছেন স্মরণ করিয়া আর তাঁহাকে প্রহার করিলেন না। হে মহারাজ! এইরূপে সত্যপরাক্রম সাত্যকি দুঃশাসনকে পরাজিত করিয়া, যে পথে মহাবীর অর্জ্জুন গমন করিয়াছিলেন, সেই পথে গমন করিতে লাগিলেন।”