১২০. ব্যূহপথে সাত্যকিসহ দুর্য্যোধনাদির যুদ্ধ

১২০তম অধ্যায়

ব্যূহপথে সাত্যকিসহ দুর্য্যোধনাদির যুদ্ধ

সঞ্জয় কহিলেন, “হে মহারাজ! এইরূপে মহারথ সাত্যকি যুদ্ধে যবন ও কাম্বোজদিগকে পরাজিত করিয়া কৌরবসৈন্য অতিক্রমপূর্ব্বক অর্জ্জুননিকটে গমন করিতে লাগিলেন। কৌরবপক্ষীয় সেনাগণ মৃগঘাতী শার্দুলসদৃশ, বিচিত্র কবচধ্বজশোভিত, নরশ্রেষ্ঠ বৃষ্ণিবীরকে দর্শন করিয়া নিতান্ত ভীত হইল। সুবর্ণাঙ্গদ, সুবর্ণশিরস্ত্রাণ ও সুবর্ণধ্বজে সুশোভিত মহাবীর সাত্যকি রথোপরি সুবর্ণশরাসন সঞ্চালিত করিয়া মেরুশৃঙ্গের ন্যায় শোভা পাইতে লাগিলেন। তাঁহার ধনুর্ম্মণ্ডল [বাণযোজনায় আকৃষ্ট হওয়ায় কথঞ্চিৎ গোলাকার] শরৎকালীন উদিত সূৰ্য্যমণ্ডলের ন্যায় বিরাজমান হইল। মত্তদ্বিরদগামী, বৃষস্কন্ধ, বৃষভাক্ষ, নরর্ষভ সাত্যকি গোগণমধ্যস্থ বৃষভের ন্যায়, যূথমধ্যস্থ প্রভিন্ন মাতঙ্গের ন্যায় কৌরবপক্ষীয় সেনাগণমধ্যে শোভা পাইতে লাগিলেন।

“এইরূপে মহাবীর সাত্যকি দ্রোণাচার্য্য, ভোজভূপতি, জলসন্ধ ও কাম্বোজগণের দুস্তর সৈন্য এবং মহাবীর হার্দ্দিক্যকে অতিক্রমপূর্ব্বক দুস্তর কৌরবসৈন্যসাগর উত্তীর্ণ হইলে দুৰ্য্যোধন,চিত্রসেন, দুঃশাসন, বিবিংশতি, শকুনি, দুঃসহ, দুর্ম্মর্ষণ ও ক্রথপ্রমুখ কৌরবপক্ষীয় অসংখ্য 
বীরঘণ অস্ত্রশস্ত্রধারণপূর্ব্বক রোষকষায়িতলোচনে তাঁহার পশ্চাৎ পশ্চাৎ ধাবমান হইলেন। অনন্তর পর্ব্বকালীন পবনোদ্ধূত অর্ণবের ন্যায় কৌরবগণের ভীষণ শব্দ শ্রুতিগোচর হইতে লাগিল। শিনিপুঙ্গব সাত্যকি সেই বীরগণকে মহাবেগে আগমন করিতে দেখিয়া সারথিকে মন্দবেগে অশ্বচালনের অনুমতি প্রদানপূর্ব্বক হাস্যমুখে কহিলেন, “হে সূত! ঐ দেখ, দুর্য্যোধনের চতুরঙ্গিণীসেনা রথঘোষে দশদিক প্রতিধ্বনিত এবং সাগরসমবেত সমুদয় ভূমণ্ডল ও আকাশমণ্ডল কম্পিত করিয়া আমার অভিমুখে আগমন করিতেছে। বেলা যেমন পূর্ণিমাতেও সংক্ষুব্ধ সাগরের মহাবেগ নিবারণ করে, আমিও তদ্রূপ সেই সৈন্যসাগর নিবারিত করিব। আমার ইন্দ্রতূল্য পরাক্রম অবলোকন কর; আমি এক্ষণে নিশিতশরনিকিরে শত্রুসৈন্য বিদারণপূর্ব্বক তোমাকে স্বীয় ইন্দ্রতুল্য পরাক্রম প্রদর্শন করিতেছি। তুমি অবিলম্বেই এই চতুরঙ্গিণী সেনাগণকে আমার হুতাশনকল্প শরজালে নিহত অবলোকন করিবে।’ মহাবীর সাত্যকি সারথিকে এই কথা বলিতেছেন, এমন সময়ে যুযুৎসু সৈনিকপুরুষেরা ‘ধাবিত হও, জয়লাভ কর, অবধানপূর্ব্বক অবলোকন কর,’ ইত্যাকার নানাপ্রকার শব্দ কিরতে করিতে তেজস্বী সাত্যকির সম্মুখে সমাগত হইল। তখন বিষ্নিবীর শাণিতশরজালে বিপক্ষপক্ষীয় অসংখ্য বীরগণ, ত্রিশত অশ্ব ও চারিশত কুঞ্জরকে আহত করিলেন। এইরূপে সাত্যকির সহিত কৌরবগণের ঘোরতর তুমুল সংগ্রাম উপস্থিত হইলে বোধ হইল যেন, দেবাসুরযুদ্ধ উপস্থিত হইয়াছে। মহাবীর সাত্যকি সেই মেঘজালসদৃশ দুৰ্য্যোধনসৈন্যগণকে ছিন্নভিন্ন করিয়া শরজালে অনেকের প্রাণসংহার করিলেন। ঐ সময় সাত্যকির সহিত একটি বাণও ব্যর্থ হইল না; তদ্দর্শনে সকলেই চমকৎকৃত হইল।

কৌরবপরাজয়-পলায়ন

“এইরূপে মহাবীর সাত্যকি বেলস্বরূপ হইয়া সেই অসংখ্য রথনাগাশ্বসঙ্কুল, পদাতিরূপ তরঙ্গে সমাকীর্ণ কৌরবসৈন্যরূপ মহাসাগর নিবারণ করিলেন। সেই চতুরঙ্গিণী কৌরবসেনা সাত্যকির শরনিকরে ব্যথিত ও ভীত হইয়া গোসমূহের ন্যায় ভ্রমণ করিতে লাগিল। তৎকালে মহাবীর সাত্যকির শরে বিদ্ধ হয় নাই এমন কোন পদাতি, রথ, হস্তী, অশ্ব বা অশ্বারোহী নয়নগোচর হইল না। নির্ভয়চিত্ত সাত্যকি হস্তলাঘব ও অসাধারণ সৈপুণ্য প্রদর্শনপূর্ব্বক যেরূপ সৈন্য সংহার করিলেন, মহাবীর ধনঞ্জয় সেইরূপ যুদ্ধ করিতে সমর্থ হয়েন নাই।।

“অনন্তর রাজা দুৰ্য্যোধন প্রথমতঃ তিন ও তৎপরে আটবাণে সাত্যকিকে বিদ্ধ করিয়া তিনশরে তাঁহার সারথি ও চারিশরে তাঁহার অশ্বচতুষ্টয় বিদ্ধ করিলেন। তখন দুঃশাসন ষোড়শ, শকুনি পঞ্চবিংশতি, চিত্রসেন পাঁচ ও দুঃসহ পঞ্চদশবাণে তাঁহার বক্ষ্যস্থল বিদ্ধ করিলেন। বৃষ্ণিশার্দূল সাত্যকি শরাহত হইয়া গর্বিতচিত্তে তিন তিন সুতীক্ষ্ণবাণে সমুদয় বিপক্ষকে দৃঢ়তর বিদ্ধ করিয়া শ্যেনপক্ষীর ন্যায় সমরে বিচরণ করিতে লাগিলেন। তৎপরে শকুনির শরাসন ও শরমুষ্টি ছেদনপূর্ব্বক দুৰ্য্যোধনকে তিন, চিত্রসেনকে একশত, দুঃসহকে দশ ও দুঃশাসনকে বিংশতিবাণে বিদ্ধ করিলেন। তখন শকুনি অন্য শরাসন গ্রহণপূর্ব্বক একবার আট ও পুনর্ব্বার পাঁচ বাণ পরিত্যাগ করিয়া তাঁহাকে আহত করিলে দুঃশাসন দশ, দুঃসহ তিন ও দুর্মুখ দ্বাদশবাণে তাঁহাকে বিদ্ধ করিয়া সিংহনাদ করিতে লাগিলেন। মহাবীর দুৰ্য্যোধনও ঐ সময় ত্রিসপ্ততিশরে সাত্যকিকে ও নিশিত তিনশরে তাঁহার সারথিকে বিদ্ধ করিলেন। তখন রথীশ্রেষ্ঠ সাত্যকি সেই সমুদয় বীরগণকে পাঁচ পাঁচ বাণে বিদ্ধ করিয়া দুৰ্য্যোধন-সারথির উপর ভল্লাস্ত্র প্রয়োগ করিলেন। সারথি অস্ত্রাঘাতে পীড়িত হইয়া ভূতলে পতিত ও পঞ্চত্বপ্রাপ্ত হইল। অশ্বগণ সারথিবিহীন হইয়া মহাবেগে সমরস্থল হইতে দুৰ্য্যোধনকে অপনীত করিল। তখন অন্যান্য বীরগণও তাঁহার রথ লক্ষ্য করিয়া তদভিমুখে পলায়ন করিতে লাগিল। সাত্যকি তাহাদিগকে পলায়ন করিতে দেখিয়া সুবর্ণপুঙ্খ শিলানিশিত তীক্ষ্ণশরনিকরে তাহাদিগকে বিদারণপূর্ব্বক অর্জ্জুনের রথাভিমুখে ধাবমান হইলেন। কৌরবপক্ষীয় বীরগণ তাহাকে লঘুহস্তে শরগ্রহণ, সারথিসংরক্ষণ ও আত্মরক্ষা করিতে অবলোকন করিয়া ভূয়োভূয়ঃ প্রশংসা করিতে লাগিলেন।”