সুমেরুর চূড়া যেন আকাশেতে লাগে।
সেইমত উচ্চ গিরি শোভা পায় আগে।।
গড়ের বাহির গিরি তিরিশ যোজন।
তাহাতে উঠিলে হয় লঙ্কা দরশন।।
পর্ব্বতে চড়েন রাম সহ সেনাগণ।
সঙ্গেতে সুগ্রীব রাজা আর বিভীষণ।।
পর্ব্বত উপরে রাম করেন দেয়ান।
দেখেন সে লঙ্কা বিশ্বকর্ম্মার নির্ম্মাণ।।
স্বর্ণ রৌপ্য ঘর সব দেখিতে রূপস।
চালের উপরে শোভে কনক-কলস।।
ধ্বজা আর পতাকা উড়িছে চতুর্দ্দিক।
রাজগৃহ পাত্রগৃহ শোভিত অধিক।।
পুরী দেখি রামচন্দ্র করেন বাখান।
পৃথিবীমণ্ডলে নাহি হেন রম্যস্থান।।
এ পুরীর রাজা কেন হয়েছে রাবণ।
তবে শোভে যদি রাজা হয় বিভীষণ।।
রঘুবংশে যদি আমি রামনাম ধরি।
বিভীষণে করিব লঙ্কার অধিকারী।।
বিভীষণ মিতাকে লঙ্কায় ভাল সাজে।
বিভীষণে রাজা করি লোকে যেন পূজে।।
আনন্দিত বিভীষণ রামের আশ্বাসে।
গিরি হৈতে উলেন সকলে রাত্রিশেষে।।
পর্ব্বত উপরে রাম বঞ্চি কত রাতি।
নামিলেন সত্বর সহিত সেনাপতি।।
পোহাইতে আছে অল্প যখন রজনী।
হেনকালে লঙ্কা বেড়িলেন রঘুমণি।।
পাইয়া সুগ্রীব শ্রীরামের অনুমতি।
চারি দ্বারে রাখিল বানর-সেনাপতি।।
নীল সেনাপতি বলি ঘন ঘন ডাকে।
একেরে ডাকিতে সবে, ধায় ঝাঁকে ঝাঁকে।।
সুগ্রীব বলেন, নীল তুমি সেনাপতি।
লঙ্কায় যুঝিতে তব প্রথম আরতি।।
বাছিয়া বানর লহ রণেতে প্রধান।
ভালমতে রাখ গিয়া পূর্ব্ব দ্বারখান।।
নীল বীর পূর্ব্ব দ্বারে যায় হরষিত।
ডাক দিয়া অঙ্গদেরে আনিল ত্বরিত।।
সুগ্রীব বলেন, হে অঙ্গদ যুবরাজ।
তোমার অধীন সর্ব্ব বানর সমাজ।।
বাছিয়া কটক তুমি লহ সারাবৎসার।
ভালমতে রাখ গিয়া দক্ষিণের দ্বার।।
চলে অঙ্গদের ঠাট সবে বাছের বাছ।
এক হাতে পর্ব্বত, দ্বিতীয় হাতে গাছ।।
ধূলা উড়াইয়া তারা করে অন্ধকার।
মার মার শব্দে ধায় দক্ষিণের দ্বার।।
দক্ষিণে অঙ্গদ গেল হয়ে হরষিত।
ডাক দিয়া হনুমানে আনিল ত্বরিত।।
সুগ্রীব বলেন, শুন বীর হনুমান।
সবা হৈতে রাখি আমি তোমার সম্মান।।
শিশুকালে লাফ দিলে ধরিতে ভাস্কর।
সাহস করিয়া বাছা ডিঙ্গালে সাগর।।
সংগ্রামে পশিলে তুমি বিক্রমে প্রধান।
পশ্চিমের দ্বার রক্ষা কর সাবধান।।
যেখানে থাকেন রাম লক্ষ্মণ দুভাই।
সাবধান হয়ে তুমি থাকিবে তথাই।।
ধায় হনুমানের কটক মহাবল।
কিলকিল শব্দেতে ব্যাপিল নভঃস্থল।।
ধূলা উড়াইয়া যায় করি অন্ধকার।
মার মার করি গেল পশ্চিমের দ্বার।।
পূর্ব্বে নীল বীরে দিয়া না হয় প্রত্যয়।
ডাকিয়া কুমুদ বীরে আনিল তথায়।।
সুগ্রীব বলেন, হে কুমুদ সেনাপতি।
সহস্র বানর আছে তোমার সংহতি।।
সে সব বানর লয়ে পূর্ব্বদ্বারে চল।
নীলের কটকে গিয়া হও অনুবল।।
তোমা সত্বে যদ্যপি নীলের সৈন্য ভাগে।
তার ভাল মন্দ যে তোমার দায় লাগে।।
সুগ্রীবের আদেশ লঙ্ঘিবে কোন্ জন।
নীলের কাছেতে করে কুমুদ গমন।।
দক্ষিণে অঙ্গদে দিয়া প্রতীতি না যায়।
ডাক দিয়া মহেন্দ্রেরে তথায় পাঠায়।।
মহেন্দ্র দেবেন্দ্র শুন সুষেণ-নন্দন।
আশী কোটি কপি দুই ভায়ের ভিড়ন।।
সে সকল লইয়া দক্ষিণ দ্বারে চল।
অঙ্গদ কটকে গিয়া হও অনুবল।।
তোমা বিদ্যমানে যদি সেই সৈন্য ভাগে।
ভদ্রাভদ্র তাহার তোমার প্রতি লাগে।।
সুগ্রীবের আদেশ লঙ্ঘিবে কোন্ জনা।
অঙ্গদ পশ্চাতে গেল মহেন্দ্রের থানা।।
পশ্চিমে হনুকে দিয়া না হয় প্রতীত।
ডাক দিয়া সুষেণেরে আনিল ত্বরিত।।
সুগ্রীব বলেন, শুন সুষেণ সুহৃৎ।
তিন কোটি বৃন্দ কপি তোমার সহিত।।
সে সবে লইয়া যাহ পশ্চিমের দ্বার।
বায়ু-তনয়ের কার সাহায্য এবার।।
আপনি থাকিতে যদি কোন মন্দ ঘটে।
অপযশ তোমারি সে লোকে ধর্ম্মে রটে।।
সুগ্রীবের আদেশে সুষেণ মহাবীর।
হনুর পশ্চাতে গিয়া হইলেক স্থির।।
উত্তরে কাহারে দিয়া না হয় প্রতীত।
আপনি সুগ্রীব রহে বানর সহিত।।
সাগরের কূলেতে যে বানরের ঘর।
জাঙ্গাল বহিয়া পাছে পলায় বানর।।
বহু কোটি সেনাপতি পাত্র মিত্র লয়ে।
রহিল সুগ্রীব রাজা উত্তর চাপিয়ে।।
ঔষধ আনিতে রহে বীর হনুমান।
মন্ত্রণা-কর্ম্মেতে থাকে মন্ত্রী জাম্ববান।।
প্রহরী হইয়া থাকে দ্বারে বিভীষণ।
চারি দ্বারে সুগ্রীব বেড়ায় ঘনে ঘন।।
যেই দ্বারে সুগ্রীব দেখেন হীনবল।
দুনা করি দেন সৈন্য সমরে অটল।।
চারি দ্বারে সুগ্রীব দিতেছেন আশ্বাস।
চারি দ্বার রক্ষা যে রচিল কৃত্তিবাস।।