১১শ অধ্যায়
দ্রৌপদীর বিলাপ—অশ্বত্থামার বধে অনুরোধ
বৈশম্পায়ন কহিলেন, হে মহারাজ! ধর্ম্মরাজ যুধিষ্ঠির এইরূপে পুত্র, পৌত্র ও সুহৃদগণকে সমরে নিহত দেখিয়া শোকে ও দুঃখে নিতান্ত অভিভূত হইলেন। তাঁহাদের রূপলাবণ্য ও গুণগ্রাম স্মরণে তাঁহার শোকসাগর এককালে উচ্ছলিত হইয়া উঠিল। তখন তত্ৰত্য সুহৃদ্গণ নিতান্ত দুঃখিত হইয়া অপূর্ণনেত্র, কম্পিতকলেবর, বিচেতনপ্রায় ধর্ম্মরাজকে বিবিধ প্রকারে সান্ত্বনা করিতে লাগিলেন। ঐ সময়ে মহাত্মা নকুল রোরুদ্যমানা [১] দ্রৌপদীর সহিত সূৰ্য্যসদৃশ সমুজ্জ্বল রথে আরূঢ় হইয়া তথায় আগমন করিলেন। কমলনয়না পাঞ্চালী শিবির-সন্নিধানে পুত্রগণের নিধনবৃত্তান্ত শ্রবণমাত্র বায়ুতাড়িত কদলীর ন্যায় বিকম্পিতকলেবরে শোকাকুলচিত্তে রাজা যুধিষ্ঠিরের নিকট আগমনপূর্ব্বক সহসা ধরাতলে নিপতিত হইলেন। তাঁহার মুখকমল তিমিরাবৃত সুৰ্য্যের ন্যায় মলিন হইয়া গেল। ক্রোধপরায়ণ বৃকোদর প্রিয়তমাকে ধূলিধূসরিত দেখিয়া বাহুপ্রসারণপূর্ব্বক ধারণ করিয়া সান্ত্বনা করিতে লাগিলেন। পুত্র শোকার্ত্তা দ্রৌপদী ভীমসেন কর্ত্তৃক আশ্বাসিত হইয়া অন্যান্য পাণ্ডবগণ সমক্ষে ধর্ম্মরাজকে কহিলেন, “মহারাজ! আপনি ক্ষাত্ৰধর্ম্মানুসারে পুত্রগণকে কালকবলে নিক্ষেপ করিয়া কি সুখে রাজ্যসম্ভোগ করিবেন? সমুদয় পৃথিবীর অধীশ্বর হইয়াই কি একবারে মত্তমাতঙ্গগামী সুভদ্রাতনয় অভিমন্যুকে বিস্মৃত হইলেন? আপনি শিবিরমধ্যে বীরবরাগ্রগণ্য পুত্রগণের নিধন বৃত্তান্ত শ্রবণ করিয়া কিরূপে সুস্থির রহিয়াছেন? পাপপরায়ণ নৃশংস অশ্বত্থামা সুখসুপ্ত বীরগণকে নিহত করিয়াছে শ্রবণ করিয়া আমার হৃদয় শোকানলে দগ্ধ হইতেছে। যদি আপনি সেই পামরের জীবন সংহার না করেন, তাহা হইলে আমি নিশ্চয়ই এই স্থানে প্রায়োপবেশন করিব। অতএব অবিলম্বে দুরাত্মা দ্রোণতনয়কে উপযুক্ত প্রতিফল প্রদান করুন।” যশস্বিনী কৃষ্ণা এই বলিয়া ধর্ম্মরাজের সমীপে প্রায়োপবেশন করিলেন।
ভীম কর্ত্তৃক অশ্বত্থামার অনুসরণ
পরমধাৰ্মিক রাজা যুধিষ্ঠির প্রিয়মহিষী পাঞ্চালীকে প্রায়োপবিষ্ট দেখিয়া কহিলেন, “যাজ্ঞসেনি! তুমি ধর্ম্মের মর্ম্ম অবগত আছ। তোমার পুত্র ও ভ্রাতৃগণ ধর্ম্মযুদ্ধে নিহত হইয়াছে; অতএব তাদের নিমিত্ত আর অনুতাপ করিও না। আর দ্রোণপুত্র এ স্থান হইতে অতি দূরবর্তী দুর্গম অরণ্যে পলায়ন করিয়াছে; অতএব তুমি কিরূপে তাহার সমরমৃত্যু অবগত হইতে সমর্থ হইবে?”
দ্রৌপদী কহিলেন, “মহারাজ! শুনিয়াছি, দ্রোণপুত্রের মস্তকে সহজমণি [সহজাত মণি – মস্তকে মণি লইয়াই জাত] আছে, যদি আপনি ঐ পাপাত্মাকে নিপাতিত করিয়া তাহার সেই মণি আহরণ করেন, তাহা হইলে উহা আপনার মস্তকে রাখিয়া আমি কথঞ্চিৎ জীবন ধারণ করিতে পারি।” চারুদর্শনা যাজ্ঞসেনী ধর্ম্মরাজকে এই কথা কহিয়া ভীমসেনের নিকট আগমনপূর্ব্বক কাতরস্বরে কহিলেন, “হে নাথ! ক্ষাত্রধর্ম্ম স্মরণ করিয়া আমাকে পরিত্রাণ করা তোমার অবশ্য কর্ত্তব্য। অতএব সুররাজ যেমন শম্বরকে নিহত করিয়াছিলেন, তদ্রূপ তুমি পাপাত্মা অশ্বত্থামাকে নিপাতিত কর। ইহলোকে তোমার তুল্য পরাক্রান্ত পুরুষ আর কে আছে? তুমি যে বারণাবনগরে বিষম বিপন্ন পাণ্ডবগণের একমাত্র আশ্রয় হইয়াছিলে, হিড়িম্ব নিশাচরের হস্ত হইতে যে ভ্রাতৃগণ ও মাতাকে রক্ষা করিয়াছিলে, তাহা কাহারও অবিদিত নাই। আর সুররাজ পুরন্দর যেমন নহুষের হস্ত হইতে শচীকে পরিত্রাণ করিয়াছিলেন, তদ্রূপ তুমি বিরাটনগরে দুরাত্মা কীচকের হস্ত হইতে আমাকে পরিত্রাণ করিয়াছ। হে বীর! তুমি পূর্বে যেমন এই সকল মহকাৰ্য্য সাধন করিয়াছিলে, তদ্রূপ এক্ষণে দুরাত্মা অশ্বত্থামাকে সংহার করিয়া সুস্থশরীর হও।”
হে মহারাজ! পুত্রশোকার্ত্তা পাঞ্চালী এইরূপ বিলাপ করিলে মহাবীর বৃকোদর উহা সহ্য করিতে না পারিয়া কার্মুক-হস্তে কাঞ্চনভূষিত মহারথে আরোহণপূর্ব্বক নকুলকে সারথ্যকার্য্যে নিযুক্ত করিয়া দ্রোণপুত্রের বিনাশবাসনায় সশরশরাসন বিস্ফোরণ করিতে লাগিলেন। তাঁহার অশ্বগণ নকুল কর্ত্তৃক পরিচালিত হইয়া বায়ুবেগে ধাবমান হইল। এইরূপে ভীমপরাক্রম ভীমসেন শিবির হইতে বহির্গত হইয়া দ্রোণপুত্রের রথচক্রচিহ্ন দর্শনপূর্ব্বক সেই চিহ্নের অনুসরণক্রমে তাঁহার অভিমুখে গমন করিতে লাগিলেন।