[সোর্স না জানা অজানা গল্প]

১১. আমেরিকায় এসে একজন ভারতীয়

আমেরিকায় এসে একজন ভারতীয় প্রথমেই কী দেখে অবাক হবে? একশো তলা বাড়ি নয়, মাটির নীচ দিয়ে বা মাথার ওপর দিয়ে ট্রেন নয়, ম্যাজিক দরজার সামনে দাঁড়ালে আপনিই দরজা খুলে যায়, তা দেখেও নয়। ওসব তো সে আগেই শুনে গিয়েছিল, বরং যতখানি দেখবে বলে কল্পনা করেছিল, তার চেয়ে অনেক কম দেখবে–বাড়িকে মনে হবে না আকাশ ছোঁয়া, বিদ্যুতের ভূত্যপনাকে মনে হবে না অস্বাভাবিক। কিছুতেই তার চমক লাগবে না, জাগবে না সত্যিকারের বিস্ময়। অত কথা শুনে এসেছে আমেরিকা সম্পর্কে, ভেবেছিল স্বর্গের সমান কোনও একটা দেশ দেখবে, কিন্তু, প্রথম দিন, প্রথম দৃষ্টিপাতে সে হয়তো একটু নিরাশই হবে। নিউ ইয়র্ক শহরের হাডসন নদীর পারে দাঁড়িয়ে সে হয়তো মনে মনে গুনগুন করে বলবে : ইজ দিস ইয়ারো? দিস দা স্ট্রিম অব হুইচ মাই ফ্যানসি চেরিসড? প্রতিমুহূর্তে সে হয়তো অভাবনীয় কিছু দেখার প্রত্যাশা করবে।

প্রথম যেখানে গিয়ে তার ভারতীয় রক্ত ছলকে উঠবে–সে জায়গাটি যে-কোনও ব্যাঙ্ক। যে কোনও মার্কিন বন্ধুকে না নিয়ে একাই এসেছে তার প্রথম চেকটি ভাঙাতে। বিশাল ভবনের মধ্যে ঝলমল করছে আলো, গোল করে ঘেরা কাউন্টারের অধিকাংশ জানালায় বসে আছে সুন্দরী মেয়েরা। কোনও জানালাতেই ভিড় নেই। খানিকটা অস্বস্তিতে ভারতীয়টির বুকের ভিতরে একটু একটু ঘর্মক্ষরণ হবে। তার আইডেনটিটি চাওয়া হলে–অর্থাৎ চেকের ওপর লেখা নামটি যে তারই পিতামাতা-প্রদত্ত, বিশ্ববিদ্যালয় ও সরকার স্বীকৃত-এ কথা সে ঠিক কীভাবে প্রমাণ করবে –মনে মনে তারই একটা মহড়া দিয়ে নেবে। পকেটে হাত বুলিয়ে একবার দেখে নেবে পাসপোর্টটি ঠিক মনে করে এনেছে কি না। তারপর ভরসা করে সে হয়তো সবচেয়ে সুন্দরী মেয়েটির জানালায় গিয়ে দাঁড়াবে চেকটি হাতে নিয়ে।

তারপরই সে পাবে প্রথম বিস্ময়। মেয়েটি চোখ নাচিয়ে এক ঝলক হেসে শুধু দেখে নেবে টাকার অঙ্ক, তারপরই ফরফর করে গুনে ছেলেটার হাতে তুলে দেবে এক গোছা নীল রঙের নোট। যন্ত্রের মতো ছেলেটির মুখ থেকে বেরিয়ে আসা ‘ধন্যবাদের উত্তরে মেয়েটি আবার হেসে বলবে, ‘তুমি স্বাগতম!’ কোনও প্রশ্ন নেই, সন্দেহ নেই, সই মেলানো নেই, অ্যাকেউন্টে টাকা আছে কি না দেখার নেই, চেকটা হাতে তুলে দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে টাকা। যেন ছেলেটি ব্যাঙ্কের খাস বড়বাবুর বড় ছেলে, তাকে কোনও প্রশ্ন করবে, এমন সাহস কার–চেক দিতেই মিষ্টি হাসি ও টাকার গোছার বিনিময় হল। আমাদের ভারতীয়টি হয়তো প্রথম বিস্ময় কাটিয়ে উঠে গোপন আত্মশ্লাঘায় জামার কলার ও টাইয়ের গিঁট নেড়েচেড়ে ঠিক করবে। ভাববে, তার নিজের মুখে স তো ও মহত্ব মাখানো, তা দেখেই অমন বিনা দ্বিধায় তাকে টাকা দিয়ে দেওয়া হল।

পরে ক্রমশ তার ভুল ভাঙবে। সুন্দর বা কুৎসিত মুখ যাই হোক–সকলেই বিনা সন্দেহে টাকা তুলতে পারবে ব্যাঙ্ক থেকে–একটা নির্দিষ্ট অঙ্ক পর্যন্ত। আমেরিকাতে ওই রকমই রীতি। চেক কেটে টাকা তোলা অত সহজ বলে আমেরিকাতে চেক-জালিয়াতির সংখ্যা অত্যন্ত কম। নরহত্যা, গুন্ডামি এবং ডাকাতি ওদেশে লেগেই আছে। কিন্তু ছিচকে চুরি নেই! দু-পাঁচ হাজার টাকার চেক জাল করার মতো নোংরা কাজও ওরা করে না। যদি এমন দুর্মতি দৈবাৎ কারুর হয়ও, এক লক্ষে একজন, তার জন্য বাকি নিরানব্বই হাজার ন’শো নিরাব্বইজন সম্মানুষকে বিব্রত করা, সন্দেহ করা, দেরি করিয়ে দেওয়া ওরা অন্যায় মনে করে। একমাত্র কিছুটা সন্দেহ করে তেরো-চোদ্দো বছরের ছেলেমেয়েদের, নির্বোধের মতো জাল-জোচ্চুরি করার ইচ্ছে ওদেরই হতে পারে, তা ছাড়া আমেরিকার টিন-এজার-রা এমনিতেই কিছুটা ভয়ের বস্তু। জালিয়াতি নিরাপত্তার জন্য অনেক ব্যাঙ্ক ইনসিওর করা থাকে কোনও কোনও গোয়েন্দা দপ্তরের কাছে। জাল চেক ধরা পড়লে সেই গোয়েন্দাদের দায়িত্ব অপরাধীকে খুঁজে বার করা, এবং খুব কম ক্ষেত্রেই জালিয়াত জেলের বাইরে থাকে।

ব্যাঙ্কের কার্যাবলির পরিসীমা দেখে ভারতীয়টির বিস্ময় ক্রমশ বৃদ্ধি পাবে। যে-দিন সে নিজের নামে অ্যাকাউন্ট খুলতে গেল সেদিনও আর এক অভিজ্ঞতা। ফর্মে নাম-ঠিকানা টেলিফোন নাম্বার লিখে টাকাগুলো দিল কাউন্টারের জানালার যে-কোনও একটি মেয়ের হাতে। এখানেও আধ মিনিটে কাজ শেষ। পাশেরই একটা মেশিনে ঝকাং ঝক শব্দ করে রসিদ ছাপিয়ে ছেলেটির হাতে তুলে দিয়ে মিষ্টি হেসে মেয়েটি বলল, পরশু এসে তোমার চেকবই নিয়ে যেও, কেমন?

পরশুদিন আবার যেতেই দেখল, কোনও গণ্ডগোল নেই, ওকে দেওয়া হল একটি লাল রঙের (যে-কেউ যে কোনও রং বেছে নিতে পারে) রেক্সিনে বাঁধানো অতি সুদৃশ্য মানিব্যাগের মতো, তার মধ্যে কয়েকখানা চেক বই, প্রত্যেকটি চেকের পাতায় ওর নাম ঠিকানা ছাপানো। হ্যাঁ, ছাপাননা! দুশো ডলারের বেশি টাকার অ্যাকাডন্ট খুললে প্রত্যেকের চেকে আলাদা করে নাম ঠিকানা ছাপিয়ে দেবে ব্যাঙ্ক। আর কোনও পাশ বই, অ্যাকাউন্ট নাম্বার কিচ্ছুর দরকার নেই। মেয়েটির দিকে তাকিয়ে সত্যিই অবাক হয়ে গেল ছেলেটি–চুল এলো করা, মুখে সব সময় মিচকি হাসি, চুইংগাম চিবুচ্ছে সব সময়, মনে হয় যে কাজে মন নেই–ফাঁকি দিয়ে কখন বাড়ি পালাবে–সেইজন্য ব্যস্ত। অথচ প্রতিটি কাজ নির্ভুল এবং ঠিক।

ক্রমশ ছেলেটি আমেরিকার ব্যাঙ্কের কাজকর্মের ধরনধারণ দেখে মুগ্ধ হয়েছে। চেক বই পকেটে নিয়ে ঘোরার দরকার নেই, ব্যাঙ্কের কাউন্টারে রাখা আছে চেক বই–তাতে সই করেও টাকা তোলা যায়। এ ছাড়া প্রত্যেক বড় দোকানে রাখা আছে যে-কোনও বাঙ্কের চেক বই। দোকানে কোনও জিনিস পছন্দ হল, অথচ পকেটে টাকা বা চেক বই নেই, কিন্তু তা বলে জিনিস কেনা আটকায় না। দোকানের চেক বইতে সই করে দিলেই হল শুধু সইটা যদি হিজিবিজি হয়–তবে পুরো নামটা একটু গোটা অক্ষরে ওপরে লিখে দিতে হবে। অনেক ক্ষেত্রে চেকবই একেবারে না হলেও চলে–সাদা কাগজে ব্যাঙ্কের নাম লিখে সই করে দিলেও চেক হিসাবে চলে যাবে, শুধু সঙ্গে একটা দু-সেন্টের স্ট্যাম্প লাগাতে হবে। এক ব্যাঙ্কের টেবিলে একটা ভাঙা মদের খালি বোতল রোজ রাখা থাকে–লোককে দেখাবার জন্য, একজন লোক চেক বই পায়নি, সাদা কাগজও পায়নি, ওই বোতলটার গায়ে নাম সই করে স্ট্যাম্প আটকে ব্যাঙ্কে পাঠিয়েছিল সেও টাকা পেয়েছে।

ধরা যাক, আমাদের ভারতীয় ছেলেটি এক শনিবার বান্ধবীকে নিয়ে সিনেমা দেখতে যাবে। এদিকে পকেটে পয়সা নেই। কাছে খুচরো টাকাও নেই। আর সিনেমার টিকিটের দাম এত কম যে, ওখানে কেউ চেক কাটে না, কেমন যেন দেখায়। মহামুশকিল, তখন ড্রাইভ-ইন-ব্যাঙ্কও বন্ধ (ড্রাইভ-ইন-ব্যাঙ্ক অতিব্যস্ত লোকদের জন্য। সরু সরু গলির মাথায় একটা করে ঘর। লোকেরা মোটর গাড়ি চেপে এসেই সেই ঘরের সামনে দাঁড়ায়, গাড়ি থেকে নামতেও হয় না, জানলা দিয়ে চেক নিয়ে হাত বাড়িয়ে দিলেই একজন সঙ্গে সঙ্গে টাকা দিয়ে দেয়)! তখন ছেলেটির মাথায় এক বুদ্ধি এল। বান্ধবীকে বলল, তুমি একটু অপেক্ষা করবে? আমি চট করে সংসারের বাজারটা করে আনি। গেল বাজার-দোকান অর্থাৎ সুপার মার্কেটে। বারো ডলারের জিনিস কিনল, আর লিখে। দিল একটা কুড়ি ডলারের চেক। বিনা প্রশ্নে ফিরে পেয়ে গেল আট ডলার।

সহজে কাগজে সই করে টাকা লেনদেন হয় বলেই বোধহয় অধিকাংশ আমেরিকানদের কাছে টাকা পয়সা এমন খোলামকুচি।

ভারতীয় ছেলেটি আমেরিকার ব্যাঙ্কের প্রশংসা করছিল একজন আমেরিকান বন্ধুর কাছে।

–কেন, তোমাদের দেশে কী নিয়ম? তোমার নিজের অ্যাকাউন্টে টাকা তুলতে অসুবিধা হয়?

–আমার দেশে আমার কোনও ব্যাঙ্কে অ্যাকাউন্ট নেই।

-কেন?

–প্রথমত আমার টাকা নেই। দ্বিতীয়ত, আমি ব্যাঙ্ক পছন্দ করি না।

–কেন, অসুবিধে কী?

–আমাদের ব্যাঙ্কে ঢুকলেই নিজেকে আসামি মনে হয়। যেন প্রতিটি লোক আমাকে সন্দেহ করছে। তারপর এক জায়গায় টাকা জমা দিয়ে একটা গোল চাক্তি হাতে নিয়ে বসে থাকতে হয়। সেটাও এক পরম অস্বস্তি। সব সময় মনে হয় চাকতিটি বুঝি হারিয়ে গেল। এদিকে বসে থাকতে থাকতে তোমার সবকটা কড়িকাঠ মুখস্থ হয়ে যাবে, কোন পাখাটা মিনিটে ক’বার ক্রিক ক্রিক শব্দ করছে জানা হয়ে যাবে, ব্যাঙ্কের দেয়ালে ঝোলানো যাবতীয় নিয়ম-কানুন, ক্যালেন্ডারের ছবি মনে গেঁথে যাবে–তখন হয়তো আদালতের পেয়াদার মতো তোমার নামে ডাক পড়তেও পারে। তারপর

–তারপর?

–তারপর হয়তো শুনবে, সই মেলেনি। কিংবা অ্যাকাউন্ট নাম্বার ভুল। তখন দুটো বেজে গেছে, সেদিন আর হবে না। আমি এক ভদ্রলোককে জানি যিনি নিজের অ্যাকাউন্টের টাকা তুলতে গিয়েছিলেন। সই মেলেনি, বারবার সই করেছেন–তবু মেলেনি। তবুও তিনি টাকা তোলার জন্য জোর করায় তাকে পুলিশে দেওয়া হয়।

–তোমাদের দেশে এত লোক, সেই তুলনায় ব্যাঙ্ক নিশ্চয়ই অনেক কম। সুতরাং অনেক সাবধান হতেই হয়!

–তা ঠিক। সেইজন্যই হয়তো, আমাদের ব্যাঙ্কের কর্মচারীরা লোকদের সঙ্গে এমন ব্যবহার করেন যেন নিজের সিন্দুক থেকে টাকা ওদের দান করে ধন্য করছেন। লোকে ধন্যও হয়।

–তোমাদের সব লোকে ব্যাঙ্কে টাকা রাখে?

–না! অনেকে রাখে মাটিতে পুঁতে। অনেক সোনার বাট করে বিছানার নীচে রেখে শোয়।

–চোর ডাকাতের ভয় নেই?

–প্রচুর। সেই সঙ্গে অনিদ্রারোগ। টাকা থাকলেই আমাদের দেশে লোকের থাকবে অনিদ্রার অসুখ!