১১৮তম অধ্যায়
শিখণ্ডীকর্ত্তৃক ভীষ্ম-আক্রমণ
সঞ্জয় কহিলেন, “শিখণ্ডী ভীষ্মকে প্রাপ্ত হইয়া তাঁহার বক্ষঃস্থলে নিশিত দশ বাণ আঘাত করিলেন। ভীষ্ম কোপোদ্দীপিত-নয়নে শিখণ্ডীর প্রতি দৃষ্টিপাত করিয়া তাঁহাকে যেন দগ্ধ করিতে লাগিলেন। সকলেই দেখিয়াছে, তিনি তাঁহার স্ত্রীরূপ স্মরণ করিয়া তাঁহাকে আঘাত করিলেন না; কিন্তু শিখণ্ডী তাহা বোধ করিতে সমর্থ হইলেন না। তখন অর্জ্জুন শিখণ্ডীকে কহিলেন, ‘হে শিখণ্ডী! ভীষ্মের প্রতি ধাবমান হও, আর কোন কথার প্রয়োজন নাই; ভীষ্মকে বধ কর। আমি সত্য কহিতেছি, যুধিষ্ঠিরের সৈন্যমধ্যে তোমা ব্যতিরেকে এমন এক ব্যক্তিও নাই যে, ভীষ্মের সহিত প্রতিযুদ্ধ করিতে সমর্থ হয়।” শিখণ্ডী অর্জ্জুনের বাক্য শ্রবণ করিয়া নানাবিধ শরে পিতামহকে আকীর্ণ করিলেন। ভীষ্ম সেইসকল বাণের প্রতি ভূক্ষেপ না করিয়া শরজালে জাতক্ৰোধ [বহু বাণাঘাতবেদনায় উৎপন্ন ক্ৰোধ] নিবারণ ও সৈন্যগণকে পরলোকে প্রেরণ করিতে লাগিলেন। যেমন মেঘসমূহ সূৰ্য্যকে আবৃত করে, সেইরূপ ভুরি ভুরি সেনাপরিবৃত পাণ্ডবগণ ভীষ্মকে পরিবেষ্টিত করিলেন। সমন্তাৎ পরিবৃত ভীষ্ম প্রজ্বলিত দাবদহনের [দাবানলের] ন্যায় শূর [বীর]গণকে দগ্ধ করিতে লাগিলেন।
ভীষ্মরক্ষক দুঃশাসনসহ অর্জ্জুনের যুদ্ধ
“এই যুদ্ধে মহাত্মা দুঃশাসনের অতি অদ্ভুত পৌরুষ অবলোকন করিলাম। তিনি একাকী সংগ্রাম করিয়া অর্জ্জুনপ্রভৃতি সমুদয় পাণ্ডবদিগকে নিবারণপূর্ব্বক পিতামহকে রক্ষা করিতে লাগিলেন; পাণ্ডবগণ তাঁহাকে নিবারণ করিতে সমর্থ হইলেন না। দুঃশাসনের এই দুষ্কর কর্ম্মে সকলেই সন্তোষ লাভ করিলেন। দুঃশাসনের সংগ্রামে পাণ্ডবপক্ষীয় রথিগণ বিরথ হইল এবং মহাধনুৰ্দ্ধর অশ্বারোহী ও মহাবল মাতঙ্গগণ তীক্ষ্মশরে বিদীর্ণ হইয়া ধরাতালে শয়ন করিল। শত শত হস্তী শরাঘাতে কাতর হইয়া দিগদিগন্তে পলায়ন করিল। যেমন হুতাশন ইন্ধন প্রাপ্ত হইলে দীপ্তশিখ হইয়া প্রজুলিত হয়, সেইরূপ দুঃশাসন পাণ্ডবসেনাগণকে প্রাপ্ত হইয়া দগ্ধ করিয়া প্ৰজ্বলিত হইতে লাগিলেন। কৃষ্ণসারথি অর্জ্জুন ব্যতীত পাণ্ডবগণের কোন মহারথই তাঁহাকে জয় করিতে বা তাঁহার সম্মুখীন হইতে সমর্থ হইলেন না। কেবল জয়শীল অর্জ্জুন সকল লোকের সমক্ষে তাঁহাকে পরাজিত করিয়া ভীষ্মের অভিমুখে ধাবমান হইলাম। ভীষ্মবাহুবল রক্ষিত সদমত্ত অপরাজিত দুঃশাসন পুনঃ পুনঃ আশ্বাস প্রাপ্ত হইয়াই যুদ্ধ করিয়াছিলেন। অর্জ্জুন যুদ্ধ করিতে করিতে যারপরনাই শোভা ধারণা করিলেন।
“শিখণ্ডী বজ্রসদৃশ আশীবি তুল্য শরজালে ভীষ্মকে বিদ্ধ করিতে লাগিলেন; কিন্তু ভীষ্ম তদ্দ্বারা কিছুমাত্র ব্যথিত না হইয়া হাস্য করিতে করিতে তাপিত ব্যক্তি যেমন বারিধারা গ্ৰহণ করে, তদ্রূপ শিখণ্ডীর শরধারা গ্ৰহণ করিলেন এবং মহাত্মা পাণ্ডবগণের সৈন্যগণকে দগ্ধ করিতে লাগিলেন।
“অনন্তর দুৰ্য্যোধন কহিলেন, “হে সৈন্যগণ! ধনঞ্জয়কে আক্রমণ কর; ধর্ম্মবিৎ ভীষ্ম তোমাদিগকে রক্ষা করিবেন। হে ভূপতিগণ! সমুন্নত সুবৰ্ণময় কালকেতু-সুশোভিত পিতামহ ভীষ্ম ধার্ত্তরাষ্ট্রদিগের সুখ ও ধর্ম্ম রক্ষা করিতেছেন; বিনশ্বর-স্বভাব [মনুষ্যধর্ম্মে মরণশীল] পাণ্ডবগণের কথা দূরে থাকুক, অমরগণও মহাবল মহাত্মা ভীষ্মকে পরাজয় করিতে সমর্থ হয়েন না; অতএব অর্জ্জুনকে প্রাপ্ত হইয়া পলায়ন করিবেন না; আমি আজি আপনাদিগের সমভিব্যাহারী হইয়া যত্নপূর্ব্বক পাণ্ডবগণের সহিত যুদ্ধ করিব।”
অর্জ্জুন যুদ্ধে বিদেহাদি বহু বীরের পতন
“দুৰ্য্যোধনের বাক্যাবসানে সৈন্যগণ ভয় পরিত্যাগ করিয়া পাণ্ডবগণের সহিত ঘোরতর যুদ্ধ করিতে লাগিল। পতঙ্গগণ যেমন হুতাশনের প্রতি ধাবমান হয়, তদ্রূপ মহাবল বিদেহ, কলিঙ্গ, দাশেরক, নিষাদ, সৌবীর, বাহ্লীক, দরদ, প্রতীচ্য, উদীচ্য, মালব, অভিষাহ, শূরসেন, শিবি, বসতি, শাল্ব, শক, ত্রিগর্ত্ত, অম্বষ্ঠ ও কেকয়রাজ রোষাবেশে অর্জ্জুনের অভিমুখে ধাবমান হইলেন। মহাবল ধনঞ্জয় ধ্যানপূর্ব্বক দিব্যাস্ত্রসমুদয় সন্ধান করিয়া হুতাশনের পতঙ্গগণ-দহনের ন্যায় মহাবেগশালী অস্ত্রে ও অস্ত্রসমূহের প্রতাপে সেই সমস্ত মহারথকে দগ্ধ করিলেন। বাণসহস্ৰ-বৰ্ষণ-সময়ে তাঁহার গাণ্ডীব যেন অন্তরীক্ষে উদ্ভাসিত হইতেছে বোধ হইতে লাগিল। হে মহারাজ! কৌরবপক্ষীয় মহারথীগণ তাঁহার শরে নিতান্ত কাতর হইয়া উঠিলেন। তাঁহাদিগের প্রকাণ্ড ধ্বজসকল বিচ্ছিন্ন ও ইতস্ততঃ বিকীর্ণ হইয়া পড়িল; তাঁহারা আর অর্জ্জুনের অভিমুখে অবস্থান করিতে পারিলেন না। ধনঞ্জয়ের শরনিকরে তাড়িত হইয়া রথিগণ রথের সহিত, অশ্বারোহিগণ অশ্বের সহিত ও গজারোহিগণ গজের সহিত ধরাশায়ী হইল। অর্জ্জুনভুজবিমুক্ত নারাচাভিহত, দিগদিগন্তে পলায়মান কৌরবসৈন্যগণে বসুন্ধরা আবৃত হইয়া উঠিল।
দুঃশাসন-পরাজয়—কৃপপ্রভৃতির পলায়ন
“ধনঞ্জয় কৌরব-সৈন্যগণকে ভগ্ন করিয়া দুঃশাসনের উপর ভুরি ভুরি শর নিক্ষেপ করিলেন; যেমন ভুজঙ্গশ্রেণী বল্মীকে বিলীন হয়, সেইসমুদয় শর। দুঃশাসনকে বিদ্ধ করিয়া সেইরূপ ধরাগর্ভে প্রবেশ করিল। এই সময়ে দুঃশাসনের অশ্বগণ ও সারথি অর্জ্জুনের হস্তে নিপাতিত হইল। অনন্তর ধনঞ্জয় বিংশতি বাণে বিবিংশতিকে বিরথ করিয়া সন্নতপর্ব্ব পাঁচবাণে বিদ্ধ করিলেন এবং কৃপ, বিকর্ণ ও শল্যকে বহুসংখ্যক শরে বিদ্ধ করিয়া বিরথ করিলেন। কৃপ, শল্য, দুঃশাসন, বিকর্ণ ও বিবিংশতি পূর্ব্বাহ্ণে এইরূপে বিরথ ও পরাজিত হইয়া পলায়ন করিলে ধনঞ্জয় দিবাকরের রশ্মিবর্ষণের ন্যায় শরজাল বর্ষণপূর্ব্বক অন্যান্য পার্থিবগণকে নিহত করিয়া শোণিতময়ী মহানদী প্রবাহিত করিলেন এবং ধূমসম্পর্কশূন্য মহাহুতাশনের ন্যায় প্রজ্বলিত হইতে লাগিলেন। উভয় পক্ষেই কোন স্থানে রথিগণ গজ, অশ্ব ও রথিগণকে, কোন স্থানে হস্তিগণ রথসমুদয়কে, কোন স্থানে পদাতিগণ অশ্বগণকে নিহত করিয়াছে; গজারোহী, অশ্বারোহী ও রথযোদ্ধৃগণের শরীর ও মস্তক মধ্যভাগে ছিন্ন হইয়া ইতস্ততঃ নিক্ষিপ্ত রহিয়াছে; পতিত, পাতিত, রথনেমিনিকৃত্ত [রথচক্ৰে কর্ত্তিত-রথের চাকায় কাটা] ও মাতঙ্গপ্রোথিত [হস্তীর পায়ের চাপে মৃত্তিকামধ্যে প্রবিষ্ট] কুণ্ডলাদিশোভিত মহারথ রাজপুত্রসমূহে রণক্ষেত্র আচ্ছাদিত হইয়াছে। পদাতি, অশ্ব, অশ্বারোহী, গজ ও রথিগণ চতুর্দ্দিকে ধাবমান হইতেছে; ভগ্নচক্ৰ, ভগ্নযুগ ও ভগ্নধ্বজ রথসমুদয় বিকীর্ণ হইয়া রহিয়াছে; রণস্থল গজ, অশ্ব ও যোদ্ধৃগণের রুধিরে শারদ রক্তাব্জের [শরৎকালীন রক্তপদ্মের] ন্যায় শোভা ধারণ করিয়াছে; কুকুর, কাক, গৃধ্র, বৃক, গোমায়ু ও অন্যান্য বিকৃত [উন্মত্ত] পশু-পক্ষগণ ভক্ষ্য লাভ করিয়া শব্দ করিতেছে; চতুর্দ্দিকে নানাবিধ বিকৃত বায়ু প্রবাহিত হইতেছে; রাক্ষস ও ভূতগণ নয়নপথে আবির্ভূত হইয়া চীৎকার করিতেছে। কাঞ্চনদাম ও মহামূল্য পতাকাসকল সহসা বায়ুভরে কম্পিত হইয়া উঠিতেছে, শত শত শ্বেতচ্ছত্র ও ধ্বজের সহিত মহারথগণ ভূমিতলে পতিত ও ইতস্ততঃ বিক্ষিপ্ত হইয়া রহিয়াছেন, অবলোকন করিলাম।
“অনন্তর ভীষ্ম দিব্য-অস্ত্র নিক্ষেপ করিতে করিতে ধনুৰ্দ্ধরগণের সমক্ষে অর্জ্জুনের প্রতি ধাবমান হইবামাত্র বর্ম্মিতকলেবর শিখণ্ডী তাহাকে আক্রমণ করিলেন। মহাবীর ভীষ্মও তৎক্ষণাৎ সেই অগ্নিসদৃশ অস্ত্ৰ উপসংহার [প্রত্যাহার—সংবরণ] করিলেন। ধনঞ্জয় সেই অবকাশে কৌরব-সৈন্যগণকে সংহার করিতে লাগিলেন।