১১৭. দুৰ্য্যোধন-অভিমন্যুসমর

১১৭তম অধ্যায়

দুৰ্য্যোধন-অভিমন্যুসমর

সঞ্জয় কহিলেন, “হে মহারাজ! পরাক্রান্ত অভিমন্যু ভীষ্মের নিমিত্ত মহতী সেনাপরিবৃত দুর্য্যোধনের সহিত যুদ্ধ করিতে লাগিলেন। দুৰ্য্যোধন ক্রুদ্ধ হইয়া অভিমন্যুর বক্ষঃস্থলে প্রথমে আনতপর্ব্ব নয় শর, পরে তিন শর বিদ্ধ করিলেন; অভিমন্যুও কুপিত হইয়া দুৰ্য্যোধনের রথের প্রতি মৃত্যুর সহোদরার ন্যায় ঘোররূপ শক্তি নিক্ষেপ করিলেন। মহারথ দুৰ্য্যোধন ক্ষুরপ্র-অস্ত্রে সেই ঘোরতর শক্তি দুই খণ্ড করিয়া ফেলিলেন। অভিমন্যু ভীষ্মকে নিধন করিবার নিমিত্ত ও দুৰ্য্যোধন পাণ্ডবকে জয় করিবার নিমিত্ত অতি বিচিত্র ইন্দ্ৰিয়প্রীতিজনক [নয়ন-মনের আনন্দবৰ্দ্ধক], পার্থিবগণের প্রশংসিত ঘোরতর সংগ্রাম করিতে লাগিলেন।

“অশ্বত্থামা রোষাবিষ্ট হইয়া সাত্যকির বক্ষঃস্থলে নারাচ নিক্ষেপ করিলে অমিতবিক্রম সাত্যকি কঙ্কপত্ৰবিশিষ্ট নয়বাণে অশ্বত্থামার সমুদয় মর্ম্মস্থান আহত করিলেন। অশ্বত্থামা পুনরায় সাত্যকির বাহু ও বক্ষঃস্থলে প্ৰথমে নয়, পরে ত্রিশ বাণ নিক্ষেপ করিলে মহাধনুৰ্দ্ধর সাত্যকি অতিমাত্র বিদ্ধ হইয়াও তিনবাণে অশ্বত্থমাকে আহত করিলেন।

পৌরব-ধৃষ্টকেতুর পরস্পর যুদ্ধ

“মহারথ পৌরব মহাধনুৰ্দ্ধর ধৃষ্টকেতুকে শরজালে আচ্ছাদিত করিয়া ক্ষতবিক্ষত করিলে ধৃষ্টকেতুও অতি শীঘ্ৰ ত্রিশবাণে পৌরবকে বিদ্ধ করিলেন। পৌরব ধৃষ্টকেতুর শরাসন ছেদন করিয়া সিংহনাদসহকারে নিশিতশরনিকরে তাঁহাকে আহত করিতে লাগিলেন। ধৃষ্টকেতু অন্য শরাসন গ্রহণ করিয়া ত্রিসপ্ততিশরে পৌরবকে আহত করিলেন। এইরূপে মহাধনুৰ্দ্ধর মহারথ বীরদ্বয় প্রভূত শরবর্ষণে উভয়কে বিদ্ধ করিতে লাগিলেন; উভয়েরই শরাসন ছেদিত হইল, উভয়েরই অশ্বগণ নিহত হইল; পরিশেষে উভয়েই বিরথ হইলেন; যেমন মহাবনে সিংহদ্বয় সিংহীর নিমিত্ত যত্নশীল হয়, সেইরূপ তাঁহারা উভয়ে ক্রুদ্ধ হইয়া গোচমনির্ম্মিত, শতচন্দ্ৰশোভিত, শততারাচিত্রিত চর্ম্ম এবং মহাপ্রভাসম্পন্ন খড়্গ গ্রহণ করিয়া অসিযুদ্ধে প্ৰবৃত্ত হইলেন এবং বিচিত্ৰ মণ্ডল ও বিচিত্ৰ গতিপ্ৰত্যাগতি [সামনে আসা ও পেছিয়ে যাওয়া] প্রদর্শন করিয়া পরস্পর আহ্বানপূর্ব্বক বিচরণ করিতে লাগিলেন। পৌরব ‘থাক থাক’ বলিয়া ধৃষ্টকেতুর ললাটদেশে ও চেদিরাজ ধৃষ্টকেতু পৌরবের জত্রুদেশে খড়্গাঘাত করিলেন। এই রূপে সেই উভয় বীরই পরস্পরের আঘাতে আহত হইয়া নিপতিত হইলেন। অনন্তর আপনার পুত্ৰ জয়ৎসেন পৌরবকে স্বরথে আরোপিত করিয়া সমরভূমি হইতে প্রস্থান করিলেন এবং মহাবলপরাক্রান্ত সহদেব ধৃষ্টকেতুকে লইয়া অপসৃত হইলেন।

উভয়পক্ষীয় বীরগণের ভীষণ যুদ্ধ

“চিত্ৰসেন প্রথমে লৌহময় শরজালে, অনন্তর ষষ্টিশরে, পরিশেষে নয়শরে সুশর্ম্মাকে আহত করিলেন। সুশর্ম্মা ক্রুদ্ধ হইয়া প্রথমে নিশিত শতসায়কে, তৎপরে আনতপর্ব্ব ত্ৰিশশরে চিত্ৰসেনকে আঘাত করিলেন; তিনিও তাঁহাকে প্রতিবিদ্ধ করিতে লাগিলেন। অভিমন্যু ভীষ্মের সমরে যশ ও মানবৰ্দ্ধনের অভিলাষে পার্থের নিমিত্ত কোশলরাজ বৃহদ্বলের সহিত যুদ্ধে প্ৰবৃত্ত হইলেন। বৃহদ্বল প্রথমে পাঁচ, তৎপরে সন্নতপর্ব্ব বিংশতিশরে অভিমন্যুকে আঘাত করিলে, অভিমন্যু কিছুমাত্র বিচলিত না হইয়া বৃহদ্বলকে প্রথমে আট বাণ এবং শরাসন ছেদনপূর্ব্বক কঙ্কপত্ৰশোভিত ত্রিংশৎ বাণ আঘাত করিলেন। বৃহদ্বল অন্য কামুক পরিগ্রহ করিয়া অভিমন্যুর প্রতি শরজাল বর্ষণ করিতে লাগিলেন। বলি ও বাসবের যেরূপ যুদ্ধ হইয়াছিল, ভীষ্মের নিমিত্ত চিত্ৰযোধী। জাতক্ৰোধ বৃহদ্বল ও অভিমন্যুর সেইরূপ যুদ্ধ হইতে লাগিল।

“যেমন বজ্রধর ধরাধরগণকে বিদারিত করেন, সেইরূপ ভীমসেন গজসৈন্যগণকে বিদারিত করিতে আরম্ভ করিলেন, পর্ব্বত-পরিমিত মাতঙ্গগণ নিহত হইয়া নিপতিত হইবামাত্র ধরাতল হইতে ঘোরতর শব্দ বহির্গত হইল। সেই ধরাপতিত আলোড়িত অঞ্জনরাশিসদৃশ [ঘন কজ্জলপুঞ্জতুল্য] মাতঙ্গসমূহ ইতস্ততঃ বিকীর্ণ পর্ব্বতসমূহের ন্যায় শোভা ধারণ করিল।

“মহাধনুর্দ্ধর যুধিষ্ঠীর মহতি সেনয় সুরক্ষিত হইয়া মদ্ররাজ শল্যকে ও শল্য ভীষ্মের নিমিত্ত যুধিষ্ঠিরকে নিপীড়িত করিতে লাগিলেন।

“জয়দ্ৰথ বিরাটের প্রতি প্ৰথমে নয় বাণ, অনন্তর ত্রিংশৎ বাণ এবং বিরাট জয়দ্রথের বক্ষঃস্থলে ত্রিংশৎ বাণ নিক্ষেপ করিলেন। বিরাট ও জয়দ্ৰথ উভয়েরই বিচিত্ৰ কামুক, বিচিত্র খড়্গ, বিচিত্র আয়ুধ ও বিচিত্র ধ্বজ, সুতরাং তাঁহারা রণক্ষেত্রে বিচিত্ৰ শোভা ধারণ করিলেন।

“দ্রোণাচার্য্য ধৃষ্টম্যুম্নের সম্মুখীন হইয়া সন্নতপর্ব্ব শরজাল বিস্তারপূর্ব্বক ঘোরতর যুদ্ধ করিতে লাগিলেন। তিনি ধৃষ্টদ্যুম্নের বৃহৎ শরাসন ছেদন করিয়া পঞ্চাশৎবাণে তাঁহাকে বিদ্ধ করিলে ধৃষ্টদ্যুন্ন অন্য ধনু গ্ৰহণ করিয়া দ্রোণাচাৰ্য্যের প্রতি সুবর্ণমণ্ডিত যমদণ্ডোপম গদা নিক্ষেপ করিলেন; দ্রোণাচাৰ্য্য পঞ্চাশৎবাণে সেই গদা প্রতিহত করিলে তাহা চুর্ণীকৃত হইয়া ধরাতলে নিপতিত হইল। গদা ব্যর্থ হইল দেখিয়া ধৃষ্টদ্যুম্ন দ্রোণের প্রতি লৌহময়ী শক্তি নিক্ষেপ করিলেন। দ্রোণাচাৰ্য্য নয়বাণে সেই শক্তি ছেদন করিয়া মহাধনুৰ্দ্ধর ধৃষ্টদ্যুম্নকে নিপীড়িত করিলেন। ধৃষ্টদ্যুম্ন ও ভীষ্মের পরাক্রম অবলোকন করিয়া লোকে বোধ করিতে লাগিল দ্রোণাচাৰ্য্যের এইরূপ ঘোরতর সংগ্রাম হইতে লাগিল।

ভীষ্ম-অর্জ্জুন যুদ্ধ-পাণ্ডবপরাজয়

“এদিকে ধনঞ্জয় ভীষ্মকে প্রাপ্ত হইয়া নিশিত শরনিকরে তাঁহাকে নিপীড়িত করিতে করিতে ধাবমান হইলেন; বোধ হইল যেন, এক আরণ্য মত্ত গজ আর এক আরণ্য মত্ত গজের প্রতি ধাবমান হইতেছে। প্রতাপবান ভগদত্ত অর্জ্জুনের প্রতি গমন করিয়া শর বর্ষণপূর্ব্বক তাঁহার গতিরোধ করিলেন। অর্জ্জুন রজতসদৃশ নির্ম্মল তীক্ষ্ণ শরজালে ভগদত্তের হস্তীকে বিদ্ধ করিলেন এবং ‘চল চল, ভীষ্মকে বধ কর’ বলিয়া শিখণ্ডীকে নিয়োগ করিতে লাগিলেন। অনন্তর ভগদত্ত অর্জ্জুনকে পরিত্যাগ করিয়া তরান্বিত হইয়া দ্রুপদের রথের প্রতি গমন করিলেন। অর্জ্জুন শিখণ্ডীকে অগ্রসর করিয়া শীঘ্র ভীষ্মের অভিমুখে ধাবমান হইলেন; অনন্তর যুদ্ধ আরম্ভ হইল। কৌরবপক্ষীয় শৌৰ্য্যশালী যোদ্ধৃগণ চীৎকার করিতে করিতে অতিবেগে অর্জ্জুনের প্রতি ধাবমান হইলে উহা অদ্ভুতের ন্যায় প্রতীয়মান হইতে লাগিল। অর্জ্জুন সমুচিত সময়ে সেই কৌরবপক্ষীয় নানাবিধ সৈন্যগণকে নিপীড়ন করিতে লাগিলেন, বোধ হইল যেন, সমীরণ গগনোদিত মেঘমালাকে ছিন্নভিন্ন করিতেছে। শিখণ্ডী ভীস্মকে প্রাপ্ত হইয়া অব্যগ্রচিত্তে সত্বর ভুরি ভুরি শরে তাঁহাকে আচ্ছাদিত করিলেন। ভীষ্মরূপ অনল রথারূপ অগ্নিগৃহে অবস্থিত, চাপরূপ শিখায় শোভিত, অসি-শক্তিগদারূপ ইন্ধনে সমুজ্জ্বলিত ও শরজালরূপ মহাজ্বালাবিশিষ্ট হইয়া ক্ষত্ৰিয়গণকে দগ্ধ করিতে লাগিল। যেমন হুতাশন সমীরণসহকারে সাতিশয় প্রজ্বলিত হইয়া কক্ষমধ্যে বিচরণ করে, সেইরূপ ভীষ্ম দিব্যসায়কসমূহে প্রজ্বলিত হইয়া পাণ্ডবগণের অনুগত সোমাকদিগকে নিহত, তাঁহাদিগের সৈন্যগণকে প্রতিহত, দিক ও বিদিক সকল প্রতিধ্বনিত, রথি, অশ্ব ও অশ্বারোহিগণকে নিপাতিত, রথসমুদয়কে মুণ্ডিত তালবন সদৃশ এবং কত শত রথ, অশ্ব ও হস্তীকে নির্ম্মানুষ্য করিতে লাগিলেন। সৈনিকগণ বজ্রনির্ঘোষসদৃশ জ্যাতল নির্ঘোষ শ্রবণ করিয়া কম্পিত হইয়া উঠিল। তাঁহার শরাসন-নিক্ষিপ্ত অব্যর্থ শরজাল শক্ৰগণের দেহ ভেদ করিয়া নিপতিত হইতে লাগিল। বেগশীল তুরঙ্গমগণ মনুষ্যহীন রথসমুদয়কে বায়ুবেগে আকর্ষণ করিতেছে, অবলোকন করিলাম। তনুত্যাগে সমুদ্যত, সমরে অপরাঙ্মুখ, সুবৰ্ণধ্বজ, বিখ্যাত মহারথ, অশ্ব, কুঞ্জর ও রথে সমারূঢ় চতুর্দ্দশসহস্ৰ সদ্‌বংশ, চেদি, কাশী ও করূষ সংগ্রামে ব্যাদিতবদন অন্তকসদৃশ ভীষ্মকে প্রাপ্ত হইয়া তদীয় শরাঘাতে প্ৰাণ পরিত্যাগ করিলেন। সোমকগণের মধ্যে এমন একজন মহারথও ছিলেন না যে, জীবিত অবস্থায় ভীষ্মের সংগ্রাম হইতে প্রত্যাবৃত হয়েন। ফলতঃ ভীষ্মের পরাক্রম অবলোকন করিয়া লোকে বোধ করিতে লাগিল যে, সোমবংশীয় সকল যোদ্ধাই প্ৰেতরাজভবনে গমন করিয়াছেন। অধিক কি, কৃষ্ণসারথি অর্জ্জুন ও মহাতেজঃ শিখণ্ডী ব্যতীত কেহই ভীষ্মের প্রতিগমনে সমর্থ হইলেন না।”