গোকর্ণাদি তীর্থে স্নান করি ক্রমে ক্রমে।
প্রভাস-তীর্থেতে যান পৃথিবী পশ্চিমে।।
প্রভাসে আগত পার্থ কুন্তীর কুমার।
দ্বারকায় গোবিন্দ শুনিয়া সমাচার।।
অতিশীঘ্র করিলেন তথায় গমন।
প্রভাসে অর্জ্জুন সহ হইল মিলন।।
আলিঙ্গন করিয়া উভয়ে পরস্পর।
উভয়ের হইল উত্তর প্রত্যুত্তর।।
অর্জ্জুনে লইয়া পরে দেবকী-নন্দন।
রৈবতক নামে গিরি করিল গমন।।
গোবিন্দের আজ্ঞায় তথায় যদুগণ।
রৈবতক-পর্ব্বেতে পূর্ব্বে করেছে গমন।।
অতিশয় মনোহর গিরিবর যত।
নানা ধাতু বিরাজিত, মণি মরকত।।
নানা জাতি বৃক্ষ সর্ব্বফলফুলে শোভে।
নানা জাতি পুষ্প সব আমোদে সৌরভে।।
নানা জাতি পশু খেলে, নানা পক্ষিগণ।
গিরি দেখি সুখী যদুকুল সর্ব্বজন।।
কৃষ্ণের বচনেতে দ্বারকাবাসী সব।
রৈবতক-পর্ব্বতেতে কৈল মহোৎসব।।
বাল বৃদ্ধ যুবা আর নর নারীগণ।
নানা বাদ্য নৃত্যগীত করে অনুক্ষণ।।
নানা নত্নে মণ্ডিত যতেক তরুগণ।
শ্বেত পীত রক্ত নীল বিবিধ বসন।।
শ্বেত কৃষ্ণ চামর রাখিল প্রতি ডালে।
প্রবাল মুকুতা ঝারা বান্ধি ইন্দ্রজালে।।
উগ্রসেন বসুদেব অক্রুর উদ্ধব।
জয়সেন কামদেব সকল বান্ধব।।
বলভদ্র চারুদেষ্ণ সাত্যকি সারণ।
গদ উপগদ যে দারুক প্রদ্যুমন।।
ঝিল্লি উপঝিল্লি যত সপ্তবংশ নারী।
উদ্যান ভ্রমিতে সবে চলে আগুসারি।।
দৈবকী রোহিণী আর ভদ্রা শচী রতি।
ভীষ্মক-নন্দিনী সত্যভাতা জাম্ববতী।।
নগ্নজিতা কালিন্দী লক্ষ্মণা রত্নভূষা।
ভদ্রমিত্রা মিত্রবৃন্দা বাণপুত্রী ঊষা।।
চন্দ্রাবতী ভদ্রাবতী প্রভৃতি কামিনী।
ইত্যাদি কৃষ্ণের ষোল সহস্র রমনী।।
রৈবতক পর্ব্বতে যে করেন বিহার।
হেনকালে উপনীত ইন্দ্রের কুমার।।
অর্জ্জুন আইল বলি শুনি এই কথা।
আগুসারি আনিবারে সবে গেল তথা।।
কৃষ্ণ ধনঞ্জয় আরোহেন এক রথে।
দোঁহে এক মূর্ত্তি, কেহ না পারে চিনিতে।।
দোঁহে ঘন নীলবর্ণ অরুণ অধর।
কিরীট কুণ্ডল হার শোভে পীতাম্বর।।
কেহ বলে কৃষ্ণে পার্থ, পার্থে বলে হরি।
দোঁহামূর্ত্তি দেখিয়া বিস্মিত নরনারী।।
তবে ধনঞ্জয় বীর রথ হৈতে উলি।
লইলেন শ্রীবসুদেবের পদধূলি।।
আলিঙ্গন শিরে চুম্ব বসুদেব দিয়া।
যতেক বৃত্তান্ত জিজ্ঞাসেন বিস্তারিয়া।।
অর্জ্জুন বলিল সব নিজ বিবরণ।
নারদ-নিয়ম হেতু ভ্রমি তীর্থগণ।।
বসুদেব বলেন, থাকহ এ আলয়।
দ্বাদশ যত দিনে পূর্ণ হয়।।
উগ্রসেন বলভদ্র সত্যক সাত্যকী।
একে একে সম্ভাষেন পরম কৌতুকী।।
লইয়া চলিল সবে রৈবতক গিরি।
সম্ভাষিতে আইল যতেক যদুনারী।।
অর্ঘ্য দিয়া কল্যাণ করেন সর্ব্বজন।
পরম আনন্দ সবে শুভ জিজ্ঞাসেন।।
মাতুলানীগণে পার্থ প্রণাম করিয়া।
যথাযোগ্য সম্ভাষ করেন নম্র হৈয়া।।
হেনকালে সুভদ্রা যে বসুদেব-সুতা।
নবীবে যুবতী সর্ব্বরূপা-গুণযুতা।।
বিচিত্র কবরীভার সুচাঁচর চুলে।
মেঘেতে বিদ্যুৎ যেন কুরুবল ফুলে।।
তার গন্ধে মকরন্দ ত্যজি অলিকুলে।
চতুর্দ্দিকে ঝঙ্কারিয়া অনুক্ষণ বুলে।।
দুই গণ্ড কুণ্ডল মণ্ডিত শ্রুতিমূলে।
চন্দ্রজ্যোতি গজমতি শোভে নাসাহুলে।।
বদন নিন্দিত চান্দ, নাসা তিলফুলে।
কটাক্ষ চাহনিতে মুনির মন ভুলে।।
কুচযুগ সম পূগ ঢাকিয়া দুকূল।
মধ্যদেশ মৃগ-ঈশ নহে সমতুল।।
জঘন সর ঘন নর্ত্তক অতুলে।
হেরি মুগ্ধ হয় কাম চরণ অঙ্গুলে।।
নিতম্ব কুঞ্জরকুম্ভ জিনিয়া বিপুল।
জাতী যূথী হার পরে মালতী বকুল।।
তারে দেখি পার্থ জিজ্ঞাসেন গোবিন্দেরে।
কেবা এ সুন্দরী সখা সবাকার পরে।।
অবিবাহিতা কন্যা যে লয় মোর মনে।
শুনিয়া বলিল তবে শ্রীমধুসূদনে।।
বসুদেব-সুতা হয় আমার ভগিনী।
সারণের সহোদরা সুভদ্রা নামিনী।।
বিবাহ না হয়, নাহি মিলে যোগ্য বর।
শুনিয়া লজ্জিত অতি পার্থ ধনুর্দ্ধর।।
অর্জ্জুনেরে হেরি ভদ্রা বিমোহিত হৈলা।
চলিতে না চলে পদ, ভূমেতে বসিলা।।
সত্যভামা বলেন, না আস ভদ্রা কেনে।
সবে বলে একক বসিলা কি কারণে।।
সুভদ্রা বলিল, দেবী ধরি মোরে লহ।
কণ্টক ফুটিল পায় বাহির করহ।।
শুনি সত্যভামা ধরি তুলিলেন হাতে।
নাহিক কণ্টকাঘাত দেখেন পদেতে।।
সত্যভামা বলেন, কি হেতু ভাঁড়াইলা।
নাহিক কণ্টকাঘাত, কেন ব পড়িলা।।
নিভৃতে সুভদ্রা কহে, কি কহিব সখি।
যে কণ্টক ফুটিল কোথায় পাবে দেখি।।
অর্জ্জুনের মোহন চাহনী তীক্ষ্ণশর।
আজি অঙ্গ আমার করিল জর জর।।
দেখ মোর অঙ্গ-তাপ ঘন কম্পমান।
ছটফট করে তনু, বাহিরায় প্রাণ।।
ছাড় সত্যভামা, আমি না পারি যাইতে।
এত বলি অর্জ্জুনেরে লাগিল দেখিতে।।
সত্যভামা বলে, ভদ্রা খাইলি দেখিতে।।
সত্যভামা বলে, ভদ্রা খাইলি কি লাজ।
রাখিলি কলঙ্ক নিষ্কলঙ্ক কুল-মাঝ।।
পিতা বসুদেব, ভাই রাম নারায়ণ।
তিনলোক মধ্যে যাঁরে পূজে সর্ব্বজন।।
ইহা সবাকার লজ্জা করিতে চাহিস্।
দেখিয়া পুরুষে প্রাণ ধরিতে নারিস্।।
অন্য কি অনূঢ়া কন্যা নাহি রাজকুলে।
পরপুরুষ দেখিয়া কাহার মন ভুলে।।
তোমা হৈতে নির্লজ্জ না হয় অন্যজনে।
ধৈর্য্য ধর, চল ঘরে, পাছে কেহ শুনে।।
সত্যভামা সখীর নিষ্ঠুর বাক্য শুনি।
সকরুণে কহে ভদ্রা, চক্ষে বহে পানি।।
ধিক্ ধিক্ ব্যর্থ জন্ম নারীর ভূতলে।
পর-বশে দহে তনু বিরহ অনলে।।
সত্যভামা বলে, কি নিন্দিস্ কামিনী।
নারীরূপে দেখ ক্ষিতি সংসারধারিণী।।
নারী হৈতে হৈল পূর্ব্বে সৃষ্টির সৃজন।
শক্তিরূপে রক্ষা করে সবার জীবন।।
নারী নাম প্রথমেতে মঙ্গল কারণ।
লক্ষ্মী আগে বলয়ে, পশ্চাতে নারায়ণ।।
শঙ্কর ছাড়িয়া আগে ভবানীর নাম।
রাম সীতা নাহি বলে, বলে সীতা-রাম।।
গৃহিণী থাকিলে লোকে বলে তারে গৃহী।
সংসারে দেখহ নারী বিনা কেহ নাহি।।
স্ত্রী হইতে হয় ভদ্রা সবার উৎপত্তি।
স্ত্রী বিনা করিতে বংশ কাহার শকতি।।
সুভদ্রা বলেন, সত্য কহিলা সকল।
কিন্তু সে পুরুষ বিনা জীবন বিফল।।
সত্যভামা বলেন, না হও উতরোল।
বিয়া দিব স্থির হও শুন মম রোল।।
উত্তম বংশজ, হৈবে বলিষ্ঠি পণ্ডিত।
পরম সুন্দর হৈবে তব মনোনীত।।
ভদ্রা কহে, যত কহ নাহি করি জ্ঞান।
এখনি ত্যজিব প্রাণ তোমা বিদ্যমান।।
কৌরব-বংশীয় যে পাণ্ডব বলবান।
বিনা ধনঞ্জয় আমি নাহি দেখি আন।।
আজি যদি ধনঞ্জয়ে আমারে না দিবে।
নিশ্চয় আমার বধ তোমারে লাগিবে।।
সত্যভামা বলে, দেবী, চল এইক্ষণ।
রজনীতে পার্থ সহ করাব মিলন।।
সত্যভামা-মুখে শুনি বচন সরস।
চলিল সুভদ্রা চিত্তে হইয়া হরষ।।