১১৬তম অধ্যায়
সমবেত কৌরবসহ সাত্যকির ভীষণ যুদ্ধ
হে মহারাজ! এইরূপে যুদ্ধনিপুণ বীরগণ সংগ্রামে প্রবৃত্ত হইয়া সাত্যকির উপর শরনিকর বর্ষণ করিতে লাগিলেন। তখন মহাবীর দ্রোণাচাৰ্য্য সপ্তসপ্ততি, দুৰ্ম্মর্ষণ দ্বাদশ, দুঃসহ দশ, বিকর্ণ ত্রিংশৎ দুর্মুখ দশ, দুঃশাসন আট ও চিত্রসেন দুই বাণে তাঁহার বামপার্শ্ব ও বক্ষস্থল বিদ্ধ করিলেন। দুর্য্যোধন ও অন্যান্য শূরগণ অসংখ্য শরবর্ষণ করিয়া তাঁহাকে পীড়িত করিতে লাগিলেন। মহাবীর সাত্যকি সেই বীরগণের শরজালে বিদ্ধ হইয়া দ্রোণাচাৰ্য্যকে তিন, দুঃসহকে নয়, বিকর্ণকে পঞ্চবিংশতি, চিত্রসেনকে সাত, দুর্ম্মর্ষণকে দ্বাদশ, বিবিংশতিকে আট, সত্যব্রতকে নয় ও বিজয়কে দশ বাণে বিদ্ধ করিলেন। তৎপরে কলিঙ্গাধিপতি রুক্সাঙ্গদকে কম্পিত করিয়া অবিলম্বে আপনার পুত্র মহারথ দুৰ্য্যোধনের অভিমুখে ধাবমান হইয়া তাঁহাকে অসংখ্য শরে নিতান্ত নিপীড়িত করিতে লাগিলেন। তখন সেই মহাবীরদ্বয়ের তুমুল যুদ্ধ উপস্থিত হইল। তাঁহারা সুতীক্ষ্ণ শরজাল বিস্তার করিয়া পরস্পরকে অদৃশ্য করিলেন। সাত্যকি দুর্য্যোধনের শরাঘাতে রুধিরাপ্লুত হইয়া রসস্রাবী রক্তচন্দন বৃক্ষের ন্যায় শোভা পাইতে লাগিলের। আপনার পুত্রও সাত্যকির শরে বিদ্ধ হইয়া সুবর্ণময় শিরোভূষণভূষিত উচ্ছ্রিত যূপের ন্যায় শোভমান হইলেন।
তখন মহাবীর সাত্যকি ক্ষুরপ্রান্ত্র দ্বারা অবলীলাক্রমে কুরুরাজের শরাসন ছেদন করিয়া তাঁহাকে শরজালে সমাচ্ছন্ন করিয়া ফেলিলেন। রাজা দুৰ্য্যোধন বিপক্ষাস্ত্র নিপীড়িত ও তাঁহার বিজয় লক্ষ্মণ সহ্য করিতে নিতান্ত অসমর্থ হইয়া অন্য হেমপৃষ্ঠ শরাসন গ্রহণপূর্ব্বক শত বাণে সাত্যকিকে বিদ্ধ করিলেন। মহাবীর যুযুধান দুর্য্যোধনের শর প্রহারে ব্যথিত ও ক্রোধান্বিত হইয়া তাঁহাকে অতিশয় আঘাত করিতে লাগিলেন। তখন আপনার অন্যান্য পুত্রগণ নৃপতিকে পীড়িত দেখিয়া বাণবর্ষণ দ্বারা সাত্যকিকে সমাচ্ছন্ন করিলেন। মহা বীর সাত্যকি শরজালে সমাবৃত হইয়া তাঁহাদের প্রত্যেককে প্রথম পাঁচ পাঁচ বাণে বিদ্ধ করিয়া পুনৰ্ব্বার সাত সাত শরে আহত করিতে লাগিলেন। পরিশেষে সত্বরে আট বাণে দুৰ্য্যোধনকে বিদ্ধ করিয়া অম্লান মুখে তাঁহার ভীষণ শরাসন ও মণিময় নাগধ্বজ ছেদন, চারি শরে চারি অশ্বের প্রাণ সংহার ও ক্ষুরপ্রাস্ত্রে সারথিকে নিধনপূর্ব্বক মর্ম্মভেদী শর দ্বারা তাঁহাকে সমাচ্ছন্ন করিলেন। রাজা দুৰ্য্যোধন এইরূপে শৈনেয়ের শরে বিদ্ধ হইয়া পলায়ন পূর্ব্বক ধনুর্ধারী চিত্র সেনের রথে সমারূঢ় হইলেন। দুর্য্যোধনকে রাহুগ্রস্ত নিশাকরের ন্যায় সাত্যকির শরে সমাচ্ছাদিত দেখিয়া সকল লোকেই হাহাকার করিতে লাগিল।
সাত্যকিসহ রণে কৃতবর্ম্মার পরাজয়
তখন মহারথ কৃতবর্ম্মা ঐরূপ আৰ্তনাদ শ্রবণ কবিয়া ধনুঃ কম্পন ও অশ্বচালনপূর্ব্বক সারখিকে ভৎসনা করিয়া কহিলেন, ‘হে সূত! সত্বরে অগ্রসর হও।’ অনন্তর মহারথ সাত্যকি কৃতবর্ম্মাকে ব্যাদিতাস্য অন্তকের ন্যায় আগমন করিতে দেখিয়া সারথিকে কহিলেন, ‘সারথে! ঐ দেখ, কৃতবর্ম্মা রথারোহণপূর্ব্বক অস্ত্র-শস্ত্র গ্রহণ করিয়া যুদ্ধার্থ আগমন করিতেছে; তুমি শীঘ্র উহার অভিমুখে রথ চালন কর।’ সারথি আজ্ঞাপ্রাপ্তিমাত্র সুসজ্জিত অশ্ব সমুদায়কে সঞ্চালিত করিয়া কৃতবর্ম্মার সমীপে সমুপস্থিত হইল। অনন্তর সেই প্রজ্বলিত পাবক সদৃশ দুই মহাবীর বলবান্ ব্যাঘ্রদ্বয়ের ন্যায় এক মিলিত হইলেন। সুবর্ণধ্বজশালী মহাবীর কৃতবর্ম্মা সুবর্ণপৃষ্ঠ শরাসন বিধূননপূর্ব্বক শৈনেয়কে ষড়িংশতি, তাঁহার সারথিকে পাঁচ এবং অশ্ব চতুষ্টয়কে চারি বাণে বিদ্ধ করিয়া তাঁহার উপর সুবর্ণপুঙ্খ শরনিকর বর্ষণ করিতে লাগিলেন। তখন শিনিপৌত্র সাত্যকি ধনঞ্জয়ের দর্শন কামনায় ত্বরাযুক্ত হইয়া কৃতবর্ম্মার উপর শাণিত অশীতিশর নিক্ষেপ করিলেন। মহাবীর কৃতবর্ম্মা বলবান্ অরাতির শরপ্রহারে নিতান্ত নিপীড়িত হইয়া ভূমিকম্পকালীন ভূধরের ন্যায় কম্পিত হইতে লাগিলেন। সত্যবিক্রম সাত্যকি ঐ অবসরে ত্ৰিষষ্টি শরে তাঁহার অশ্ব চতুষ্টয় ও সাত শরে সারথিকে বিদ্ধ করিয়া তাঁহার উপর এক সংক্রুদ্ধ পন্নগসদৃশ সুবর্ণপুঙ্খ বিশিখ পরিত্যাগ করিলেন। সেই কালদণ্ড সদৃশ শর কৃতবর্ম্মার জাম্বুদময় বিচিত্র বৰ্ম ছেদন ও কলেবর ভেদ পূর্ব্বক রুধিরাপ্লত হইয়া ভূগর্ভে প্রবিষ্ট হইল। মহাবীর হার্দ্দিক্যও সেই বিষম শরে নিপীড়িত ও শোণিতাক্ত কলেবর হইয়া সশর শরাসন পরিত্যাগ পূর্ব্বক রথোপস্থে নিপতিত হইলেন।
হে মহারাজ! এই রূপে সত্যবিক্রম সাত্যকি সহস্র বাহু কাৰ্ত্তবীর্য্য সদৃশ, অক্ষোভ্য সাগরতুল্য কৃতবর্ম্মাকে নিবারণ করিয়া ইন্দ্র যেরূপ অসুর সেনা অতিক্রম করিয়াছিলেন, তদ্রূপ সসৈন্য সমক্ষে সেই খড়্গ শক্তি শরাসন বিকীর্ণ, গজাশ্ব-রথ-সঙ্কুল, রুধিরাভিষিক্ত কোরবসৈন্য অতিক্রম করিয়া গমন করিতে লাগিলেন। এ দিকে বলবান্ হার্দ্দিক্য সংজ্ঞালাভ করিয়া অন্য শরাসন গ্রহণ পূর্ব্বক সমরে পাণ্ডবগণকে নিবারণ করিতে আরম্ভ করিলেন।”