হনুমানে শ্রীরাম করেন আজ্ঞা দান।
ভরতের সমাচার দেহ হনুমান।।
নন্দীগ্রামে যাইবে ভরতের উদ্দেশে।
কহিবে সকল কথা অশেষ বিশেষে।।
শৃঙ্গবের পুরে তুমি যাবে আগুয়ান।
চণ্ডাল মিতারে মম জানাবে কল্যাণ।।
চণ্ডাল নিমেষে হনু উঠিল গগন।
ভরত-সম্ভাষিতে যায় ত্বরিত গমন।।
মনে মনে চিন্তে বীর পবন-নন্দন।
কোনরূপে গুহের আগে দিব দরশন।।
স্বভাবে চণ্ডাল-জাতি বড়ই চঞ্চল।
বানর দেখিয়া মোরে করিবেক বল।।
ভেটিব মনুষ্যরূপে তার বিদ্যমান।
এই যুক্তি মনে মনে করে হনুমান।।
চক্ষুর নিমেষে গেল শৃঙ্গবের পুরে।
নিজরূপ ত্যজিয়া মনুষ্যরূপ ধরে।।
গজমুখী ঘর সব ছাউনি সব নাড়া।
হনুমান বলে এই চণ্ডালের পাড়া।।
বসিয়াছে গুহক সে আপন দেওয়ানে।
নররূপে হনুমান গেল বিদ্যমানে।।
গুহক-চণ্ডাল তার গলে পুষ্পমাল।
হনুমান বার্ত্তা কহে শুন হে চণ্ডাল।।
শ্রীরাম তোমায় জানাইলেন কল্যাণ।
মিত্র-সম্ভাষণে চল ত্যজহ দেওয়ান।।
হরিষে চণ্ডাল কহে গদগদ ভাষে।
শ্রীরাম লক্ষ্মণ সীতা কতদূরে আছে।।
হনু কহে রাম ছিলা ভরদ্বাজপুরে।
পথে দেখা পাবে তাঁর চলহ সত্বরে।।
শ্রীরাম আইসে দেশে পড়ে গেল সাড়া।
ঝা গুড় গুড় বাদ্য বাজে নাচে চণ্ডাল-পাড়া।।
উভ করি ঝুঁটি বান্ধে টানি পড়ে ধড়া।
নানা অস্ত্রে সাজে জাঠি শেল ও ঝকড়া।।
চতুর্দ্দিকে হাত চুলি বাজায় চামুচি।
উফর ধাফর করি চণ্ডাল ফৌজ নাচি।।
নাচয়ে চণ্ডাল সব আনন্দিত হয়ে।
দেখিয়া আনন্দে নাচে চণ্ডালের মেয়ে।।
গুহ বলে ধনা মনা দাসী যে সকল।
মিত্র সম্ভাষণে লবে শালুকের ফল।।
ওড়া ভরি মৎস্য লবে কৈ আর উৎপল।
পদ্মের মৃণাল লবে আর পাণিফল।।
চলিল গুহের ফৌজ দগড়ে দিয়া শাণ।
সাতকোটি চণ্ডাল চলিল আগুয়ান।।
একেক চণ্ডাল যায় দেখিতে পর্ব্বত।
যুড়িয়া চলিল সাত প্রহরের পথ।।
নানা দ্রব্য গুহক রামের কাছে এড়ে।
রামের ইঙ্গিত পেয়ে বানরেরা নড়ে।।
শ্রীরাম বলেন মিত্র আছহ কুশলে।
গুহ বলে রাম তুই এলি ভালে ভালে।।
শুনিয়া গুহের কথা রামের সন্তোষ।
ভক্তিমাত্র লন রাম নাহি লন দোষ।।
শ্রীরাম গুহের মনস্তুষ্টির কারণ।
রথ হৈতে নামিয়া দিলেন আলিঙ্গন।।
জগতে শ্রীরামের এমন ঠাকুরালি।
চণ্ডালে বানরে আর রাক্ষসে মিতালি।।
সাতকোটি চণ্ডাল দেখিল রামরূপ।
অনায়াসে উত্তীর্ণ হইল ভবকূপ।।
রাম-সম্ভাষণেতে হইল দিব্যজ্ঞান।
সর্ব্বলোক স্বর্গে গেল চড়িয়া বিমান।।
রাম রাম বলিয়া পরাণ যার যার।
চরমে সে স্বর্গে যায় জন্ম নাহি আর।।
নিজরূপে হনুমান উঠিল গগনে।
ভরতের স্থানে যায় ত্বরিত গমনে।।
নানা তীর্থ এড়াইয়া নদী নানা স্থানি।
হইল গোমতী পার পরম সন্ধানী।।
হেঁটে তালগাছ এড়ে ত্রিশত যোজন।
নন্দীগ্রাম উত্তরিল পবন-নন্দন।।
গগন-মণ্ডলে বীর রহে অন্তরীক্ষে।
তথায় থাকিয়া বীর নন্দীগ্রাম দেখে।।
গড়ের প্রাচীর দেখে পর্ব্বতের সার।
হস্তী ঘোড়া দেখে বীর পর্ব্বত আকার।।
সিংহাসনে পাদুকা বেষ্টিত শুভ্র নেতে।
শ্বেত চামরের বায়ু পড়ে চারিভিতে।।
ত্রিযোজনে প্রশস্ত প্রাচীর সুনির্ম্মাণ।
দুর্গ দ্বার শোভা করে বিচিত্র বিধান।।
পৃথিবীতে রাজা লক্ষ অযুত নিযুত।
অষ্টআশী কোটি রাজা দ্বারেতে মজুত।।
বিচিত্র নির্ম্মাণ ঘর বিচিত্র আবাস।
অত্যুচ্চ একেক ঘর লেগেছে আকাশ।।
মরকত স্তম্ভে লাগে মাণিক রতন।
হস্ত ঘোড়া সংখ্যা নাই কে করে গণন।।
ঠাঁই ঠাঁই বিচিত্র সোনার নাট্যশালা।
দেব দৈত্য গন্ধর্ব্ব আদির যত মেলা।।
রত্ন-সিংহাসনোপরি নেতবস্ত্র পাতি।
তদুপরি পাদুকা রাখিয়া ধরে ছাতি।।
ভরত তাহার নীচে কৃষ্ণসার-চর্ম্মে।
বশিষ্ঠ নারদ লৈয়া থাকে রাজকর্ম্মে।।
ভরত সাক্ষাৎ বিষ্ণু স্বয়ং অধিষ্ঠান।
অনুমানে ভরতে চিনিল হনুমান।।
নামিয়া তথায় বীর করিল প্রণাম।
যোড়হাত করি বলে আপনার নাম।।
হনুমান নাম মোর জাতিতে বানর।
সুগ্রীবের পাত্র আমি পবন-কোঙর।।
স্বয়ং বিষ্ণু রঘুনাথ তাঁর আমি দাস।
এই পুণ্যে পাইলাম তোমার সম্ভাষ।।
রঘুবংশে ভরত আপনি নারায়ণ।
তোমা দরশনে হয় পাপ বিমোচন।।
কেকয় রাজার কন্যা তোমার জননী।
দশরথ-ভূপতির মধ্যমা গৃহিনী।।
রাজার মহিষী তিনি রাজার নন্দিনী।
সৌভাগ্য তাঁহার সমা নহে অন্য রাণী।।
করিলা রাজার সেবা প্রধানা মহিষী।
জন্মিলা যাঁহার গর্ভে তুমি পূর্ণশশী।।
বর মাগিলেন তিনি অতি সে অনার্য্য।
শ্রীরামের বনবাস ভরতের রাজ্য।।
সে দুর্নাম গেল তাঁর তোমা পুত্রগুণে।
তোমার চরিত্রে চমৎকার ত্রিভুবনে।।
হস্তী ঘোড়া রথ এড়ি ভূমে বাট বহ।
রাজা হৈয়া ভাই ভক্ত হেন নহে কেহ।।
ভরত ভূপাল হয়ে নহে রাজ্যভোগী।
মুনি-ব্যবহার কর যেন মহাযোগী।।
যাঁহারে আনিতে গেলে লয়ে রাজ্যখণ্ড।
যাঁহার পাদুকাপরি ধর ছত্রদণ্ড।।
বহুকাল দুঃখী আছ যাঁহার আশ্বাসে।
সেই রাম পাঠাইলেন তোমার উদ্দেশে।।
শুভবার্ত্তা কহে যদি পবন-নন্দন।
উঠিয়া ভরত তারে দেন আলিঙ্গন।।
হনুমানে কোল দিয়া ছাড়িবারে নারে।
মুক্তার গাঁথনি যেন চক্ষে জল ঝরে।।
ভরতের নেত্রজলে হনুমান তিতে।
ভরত প্রসাদ দিতে ভাবিছেন চিতে।।
তিন শত গাভী দিল বাছি ভাল ভাল।
দুই শত গাছ দিল রসাল কাঁটাল।।
অগ্নিবর্ণ স্বর্ণ দিল আশীলক্ষ তোলা।
মণি মুক্ত দিল কত মধ্যে গাঁথা পলা।।
রূপে গুণে কুলে শীলে যাহার বাখান।
এমন এগার শত কন্যা দিল দান।।
কন্যাগণে দেখি হাসে পবন-নন্দন।
পশু আমি কন্যায় কি মোর প্রয়োজন।।
ভরত যে দান দেহ কিছুই না মানি।
রামের মঙ্গল যাহে তাহা আমি গণি।।
এত যদি হনুমান কহিল বচন।
পুনশ্চ ভরত তারে দিলা আলিঙ্গন।।
বহুদিনে শুনিলাম অপূর্ব্ব কাহিনী।
তুমি নহ বানর দেবের মধ্যে গণি।।
ভরত বলেন বীর জিজ্ঞাসি তোমায়।
কি কার্য্যে বানরগণ রামের সহায়।।
কোন্ কোন্ সেনাপতি কি তার বাখান।
দেশে আইলে সবাকার করিব সম্মান।।
এত যদি পূর্ব্ব কথা জিজ্ঞাসে ভরতে।
সর্ব্ব কথা হনুমান লাগিল কহিতে।।
রাজ্য ছাড়ি শ্রীরাম গেলেন পঞ্চবটী।
তথা সূর্পণখার নাসিকা কাণ কাটি।।
মারিলেন তথা খর ত্রিশিরা দূষণ।
মায়ামৃগ ছলে সীতা হরিল রাবণ।।
সুগ্রীবের সহ সখ্য সীতা অন্বেষণ।
বালিরে মারিয়া রাজ্য সুগ্রীবে অর্পণ।।
সমস্ত বানর জড় সুগ্রীব-আদেশে।
সীতা অন্বেষিতে সবে যাই দেশে দেশে।।
একমাস মধ্যে রাজা করিল নিশ্চয়।
অধিক অধিক হৈলে প্রাণের সংশয়।।
পাতালে প্রবেশ করি মহা অন্ধকার।
মরিব বানর-সৈন্য যুক্তি করি সার।।
অন্ধকার পাতালেতে করিনু প্রবেশ।
চাহিয়া পাতাল সপ্ত না পাই উদ্দেশ।।
বিন্ধ্যাচলে সম্পাতির সহ হয় দেখা।
রামনাম বলিতে উঠিল তার পাখা।।
জটায়ুর জ্যেষ্ঠ পুত্র শ্রেষ্ঠ সে সম্পতি।
তার বাক্যে ভরত ডিঙ্গাই সরিৎপতি।।
সাগরের কূলে গেলাম সকল বানর।
একাকী ভরত ডিঙ্গাইলাম সাগর।।
একাকী লঙ্কার মধ্যে করিনু প্রবেশ।
অন্তঃপুরে সীতার না পাইনু উদ্দেশ।।
আওয়াসে আওয়াসে ফিরি সীতা নাহি দেখি।
প্রাচীরে বসিয়া কান্দি হয়ে বড় দুঃখী।।
দু-প্রহর রাত্রি গেল তৃতীয় প্রহরে।
সীতারে দেখিনু অশোক কাননে ভিতরে।।
কোথা হৈতে আইলে জিজ্ঞাসেন বৈদেহী।
রামের বৃত্তান্ত যত তাহা আমি কহি।।
রামের অঙ্গরী যে দিলাম নিদর্শন।
অঙ্গুরী পাইয়া সীতা করেন ক্রন্দন।।
দিলেন রামেরে তবে মস্তকের মণি।
কহিলেন জানাইতে রামেরে কাহিনী।।
সে মণি আনিয়া দিলাম রাম বিদ্যমানে।
মণি পেয়ে কান্দিলেন ভাই দুইজনে।।
বানরের সহায়েতে করি সেতুবন্ধ।
মারিলেন শ্রীরাম সবংশে দশস্কন্ধ।।
প্রহস্ত মরিল নীল বানরের তেজে।
নাগপাশে মুক্ত করিলেন পক্ষিরাজে।।
ইন্দ্রজিৎ অতিকায়ে মারেন লক্ষ্মণ।
শ্রীরামের হাতে হত হইল রাবণ।।
শত্রুক্ষয় করিলেন রাম বাহুবলে।
রাম সীতা লক্ষ্মণ আইলেন কুশলে।।
আইলেন সুগ্রীব রাক্ষস বিভীষণ।
পাত্র মিত্র নিয়ে চল রাম সম্ভাষণ।।
ছিলেন শ্রীরাম কল্য ভরদ্বাজ-ঘর।
পথেতে পাইবে দেখা চলহ সত্বর।।
শুভবার্ত্তা কহে যদি বীর হনুমান।
শত্রুঘ্নেরে ভরত করেন সম্বিধান।।
সুদিন হইল ভাই দুঃখ অবশেষ।
বহু দিবসেতে রাম আইলেন দেশ।।
প্রস্তর-প্রতিমা যত আছে স্থানে স্থান।
সুগন্ধি চন্দনে সে সবারে করাও স্নান।।
দেবতার স্থানে বাদ্য বাজাউক বাহীত।
দেহ ধূপ নৈবেদ্য ঘৃতের জ্বাল বাতি।।
ফল ফুল নৈবেদ্য ভরিয়া দেহ ডালা।
সুগন্ধি চন্দনকাষ্ঠে জ্বালহ পাঁজলা।।
উচ্চ নীচ স্থান কর একই সোসর।
পথ পরিষ্কার কর বাছহ কঙ্কর।।
প্রতি পুরে দ্বারে দ্বারে পোঁত বৃক্ষকলা।
গাছে গাছে পতাকা বান্ধহ পুষ্পমালা।।
আলগোছে টাঙ্গা বান্ধ নেতের উয়াড়ে।
পুরনারী দেখে যেন থাকি তার আড়ে।।
রামের চরণ যে করিবে নিরীক্ষণ।
কোটি কোটি জন্ম পাপে হইবে মোচন।।
যা বলিল ভরত করিল শত্রুঘন।
নন্দীগ্রাম হল যেন অমর-ভুবন।।
রামের পাদুকা শিরে করিয়া ভরত।
চলিলেন সামন্ত সহিত শত শত।।
পাদুকার উপরে ধরিল ছত্রদণ্ড।
চামর ঢুলায় তায় আনন্দ অখণ্ড।।
প্রতি পদক্ষেপেতে করেন নমস্কার।
ভরত আনিতে রামে সানন্দ অপার।।
বশিষ্ঠ নারদ চলে কুল-পুরোহিত।
সংসারের লোক চলে হয়ে আনন্দিত।।
আবৃত হইল দোলা নেতের উয়াড়ে।
সাতশত সতীনে কৌশল্যাদেবী নড়ে।।
ব্রাহ্মণ ক্ষত্রিয় বৈশ্য শূদ্র চারি বর্ণ।
শ্রীরামে দেখিতে লোক চলিল অগণ্য।।
ঊর্দ্ধশ্বাসে ধাইয়া চলিল গর্ভবতী।
লজ্জা ভয় ত্যজে যায় কুলের যুবতী।।
কাণা খোঁড়া শিশু বুড়া লয়ে অন্যজনে।
অন্ধজন চক্ষু পায় শ্রীরাম দর্শনে।।
অনেক ব্রাহ্মণ চলে অনেক ব্রাহ্মণী।
তাহাদের ঘরে নাহি রহে এক প্রাণী।।
অবধূত সন্ন্যাসী চলিল ঊর্দ্ধমুখে।
নপুংসক চলিল যে অন্তঃপুর রাখে।।
গাছে পক্ষী না রহে, না রহি পশু বনে।
স্থাবর জঙ্গম কীট চলিল সঘনে।।
ভূত প্রেত নিশাচর থাকে অন্তরীক্ষে।
রামেরে দেখিতে যায় কেহ নাহি থাকে।।
তের শত বৃহন্দে বাহির হৈল পথে।
ভরত শ্রীরামচন্দ্রে না পান দেখিতে।।
ভরত বলেন হে চঞ্চল হনুমান।
যত কিছু বলিলা হইল সব আন।।
হনুমান বলেন না হও উতরোল।
গোমতীর পারে শুন কটকের রোল।।
ভরদ্বাজ-মুনির বরেতে বিদ্যমান।
শুষ্ক গাছে ফল ফুল সহ এই স্থান।।
ঐ দেখ রথখান আসিছে আকাশে।
ব্রহ্মার সৃজিত রথ বহে রাজহংসে।।
কি কব রথের কথা অপূর্ব্ব কাহিনী।
উহার উপরে সৈন্য সত্তর অক্ষৌহিণী।।
তিন কোটি রাক্ষস সহিত বিভীষণ।
এক কোণে রথের রয়েছে তুষ্ট মন।।
রথখান দেখে সবে ঢাকিছে গগন।
ঢাকিল সূর্য্যের তেজ রথের কিরণ।।
এমত উভয়ে হয় কথোপকথন।
হেনকালে রথ লয়ে আইল পবন।।
ভরতে দেখিয়ো রাম হলেন কাতর।
অস্থিচর্ম্ম সার অতি ক্ষীণ কলেবর।।
চলিয়া আসিতে পথ উখড়িয়া পড়ে।
হনুমান কোলে করি রথে গিয়া চড়ে।।
রথোপরি চারি ভায়ে হইল দরশন।
চতুর্দ্দশ বৎসরান্তে দেন আলিঙ্গন।।
প্রেমপূর্ণ আনন্দে বহিছে অশ্রুধার।
ভরত শ্রীরামেরে করেন নমস্কার।।
জানকীরে প্রণিপাত করেন ভরত।
আশীর্ব্বাদ জানকী করেন শত শত।।
জ্যেষ্ঠ-জ্ঞানে ভরত লক্ষ্মণে নাহি বন্দে।
পরস্পর কোলাকুলি পরম আনন্দে।।
তিনের অনুজ বটে বীর শত্রুঘন।
চারি ভাই একেবারে কৈল আলিঙ্গন।।
এক বিষ্ণু চারি অংশে মায়ার কারণ।
দেবগণ বলে পাছে হয় যে মিলন।।
এক ঠাঁই চারি ভাই হইল মিলন।
আনন্দে অমরে করে পুষ্প বরিষণ।।
শ্রীরাম বশিষ্ঠ গুরু করেন বন্দন।
সবারে বন্দেন রাম কুলের ব্রাহ্মণ।।
পুত্রশোকে কৌশল্যার অস্থিচর্ম্ম-সার।
রাম নাম বিনা তাঁর মুখে নাহি আর।।
সুমিত্রার নেত্রে বারি ঝরে ঝর ঝর।
সর্ব্বদা কান্দিছে বলি রাম রঘুবর।।
হেনকালে সীতা সহ শ্রীরাম লক্ষ্মণ।
রথ হইতে নামি এল জননী-সদন।।
মাতা বিমাতার রাম করেন প্রণাম।
আশীর্ব্বাদ করে চিরজীবী হও রাম।।
অন্ধের নয়ন যেন হয় পুনর্ব্বার।
সেইরূপ আনন্দ সতিনী দুজনার।।
পুলকে পূর্ণিত হয়ে কান্দে দুই রাণী।
দুইজনে প্রণমিল সীতা ঠাকুরাণী।।
কান্দেন সুমিত্রা রাণী সীতা লয়ে কোলে।
তিন জনে তিতিলেন নয়নের জলে।।
সুমিত্রার আগে রাম যোড়হাতে কন।
এই লহ মাতা তব প্রাণের লক্ষ্মণ।।
বনেতে গমন আমি কৈনু যেইকালে।
হাতে হাতে লক্ষণেরে সঁপে দিয়েছিলে।।
প্রাণের দোসর মম লক্ষ্মণ যে ভাই।
লক্ষ্মণের গুণে আমি দুঃখ নাহি পাই।।
পিতৃসত্য পালিয়া আইনু দেশে ফিরে।
তোমার লক্ষ্মণে এনে দিলাম তোমারে।।
সুমিত্রা কহেন রাম কত কহ আর।
আমার লক্ষ্মণ নহে জানিহ তোমার।।
এক কথা রাম আমি জিজ্ঞাসি তোমাকে।
কেন এ শেলের চিহ্ন লক্ষ্মণের বুকে।।
শ্রীরাম বলেন, মাতা করি নিবেদন।
লঙ্কাপুরী মধ্যে হয়েছিল মহারণ।।
রাবণের পুত্র ইন্দ্রজিৎ নাম ধরে।
মহাধনুর্দ্ধর সেই ভুবন ভিতরে।।
তাহারে লক্ষ্মণেরে শক্তি প্রহারিল।
সেই শক্তি লক্ষ্মণের বুকেতে বাজিল।।
অচেতন হয়ে ভাই পড়ে রণস্থলে।
হইয়া ব্যাকু আমি করিলাম কোলে।।
হনুমান ঔষধ আনিল তদন্তর।
লক্ষ্মণেরে প্রাণদান দিল বীরবর।।
অতএব সেই চিহ্ন শক্তির প্রহার।
সে সব কহিতে দুঃখ বাড়য়ে অপার।।
সুমিত্রা বলেন রাম শুনহ বচন।
শেলচিহ্নোপরে কেন না দিলে চরণ।।
যে পদ স্পর্শনে স্বর্ণ হৈল কাষ্ঠতরি।
বুকে লক্ষ্মণের কেন নাহি দিলে হরি।।
লক্ষ্মণের বর্ণে স্বর্ণ হইত মিলন।
তবে শেলচিহ্ন না থাকিত কদাচন।।
হেঁটমুখে রহে রাম হইয়া লজ্জিত।
ভরত পাদুকা আনি যোগায় ত্বরিত।।
সম্মুখেতে রাখিল পাদুকা দুই পাট।
রথ ত্যজি রঘুনাথ ভূমে বহে বাট।।
ভরত বলেন গোঁসাই করি নিবেদন।
মহাব্রত করেছিলাম পাদুকা সেবন।।
ব্রত সাঙ্গ হৈল মম তোমা আগমনে।
বারেক পাদুকা দেও ও রাঙ্গা চরণে।।
প্রজাগণ মাথা নোঙায় পাদুকা দেখিয়ে।
পাদুকা দিলেন পায়ে হরিষত হয়ে।।
রাজ্যখণ্ডে যান রাম পরম হরিষে।
লঙ্কাকাণ্ডে গাহিল পণ্ডিত কৃত্তিবাসে।।