১১৫তম অধ্যায়
কৌরব-পাণ্ডবের ঘোর সঙ্কুল যুদ্ধ
সঞ্জয় কহিলেন, “অতিরথ ধনঞ্জয় কৌরবসৈন্যগণকে নিপীড়নপূর্ব্বক সন্নতপর্ব্ব শরজালে মহারথ শল্যকে আচ্ছাদিত করিলেন এবং সুশর্ম্মা, কৃপ, ভগদত্ত, চিত্ৰসেন, বিকৰ্ণ কৃতবর্ম্মা, দুর্ম্মর্ষণ, বিন্দ ও অনুবিন্দকে তিন-তিন বাণে আহত করিলেন। চিত্ৰসেন-রথারূঢ় জয়দ্ৰথ অর্জ্জুন ও ভীমসেনকে শরাঘাত করিতে লাগিলেন। শল্য ও কৃপাচাৰ্য্য ভুরি ভুরি মর্ম্মভেদী শরে ধনঞ্জয়কে বিদ্ধ করিলেন। চিত্ৰসেনপ্রভৃতি আপনার পুত্ৰগণ প্রত্যেকেই ভীম-অর্জ্জুনকে পাঁচ-পাঁচ শর আঘাত করিলেন। রথিশ্রেষ্ঠ ভীমসেন ও ধনঞ্জয় ত্রিগর্ত্তদেশীয় সৈন্যগণকে নিপীড়িত করিতে আরম্ভ করিলে সুশর্ম্মা নয়বাণে ধনঞ্জয়কে বিদ্ধ করিয়া সৈন্যগণের ভয়জনক সিংহনাদ করিলেন। অন্যান্য রথিগণও সুবর্ণপুঙ্খ শরজালে ভীম ও ধনঞ্জয়কে বিদ্ধ করিতে লাগিলেন। যেমন আমিষলিপ্সু মদমত্ত সিংহযুগল গোসমূহের মধ্যে বিচরণ করে, সেইরূপ মহারথ ভীম ও অর্জ্জুন কৌরবপক্ষীয় রথিগণের মধ্যে বিচিত্ৰবেশে ক্রীড়া করিতেছেন, নয়নগোচর হইল। তাঁহারা শূরগণের কামুক, শার ও শত শত মানুষ্যের মস্তক খণ্ড খণ্ড করিয়া ফেলিলেন। শত শত অশ্ব আহত ও নিহত হইল, শত শত গজ ও গজারোহী ধরাশয্যা গ্ৰহণ করিল, শত শত রথী ও অশ্বারোহী স্থানে স্থানে ব্যাপাদিত হইল ও কত শত ব্যক্তি কম্পিত হইতে লাগিল, অবলোকন করিলাম। কালকবলিত অশ্ব, গজ, পদাতি ও ভগ্ন রথসমূহে ধরাতল আচ্ছাদিত হইয়া উঠিল। আমি এই যুদ্ধে ধনঞ্জয়ের অদ্ভুত পরাক্রম অবলোকন করিলাম; তিনি শরনিকরে। সেই সমস্ত বীরগণকে নিবারিত ও আহত করিতে লাগিলেন।
কৌরবসহ অর্জ্জুনের-পাণ্ডবসহ ভীমের যুদ্ধ
“মহাবল দুর্য্যোধন ভীমার্জ্জুনের ঈদৃশ পরাক্রম অবলোকন করিয়া ভীষ্মের রথসমীপে গমন করিলেন; কিন্তু কৃপাচাৰ্য্য, কৃতবর্ম্মা, জয়দ্ৰথ এবং অবন্তিদেশীয় বিন্দ ও অনুবিন্দ তখনও সমর পরিত্যাগ করিলেন না। মহাধনুৰ্দ্ধর ভীমসেন ও মহারথ অর্জ্জুন কৌরবসৈন্যগণকে নির্ভর নিপীড়িত করিলে কৌরবপক্ষীয় ভূমিপালগণ ত্বরান্বিত হইয়া ধনঞ্জয়ের রথে অযুত অযুত ও অর্বুদ অর্বুদ বাণ নিক্ষেপ করিতে লাগিলেন। ধনঞ্জয় শরজালে সেই সমস্ত মহারথকে নিবারণপূর্ব্বক সংহার করিতে আরম্ভ করিলেন। মহারথ শল্য ক্রুদ্ধ হইয়া যেন ক্রীড়া করিতে করিতে সন্নতপর্ব্ব ভল্লসমূহে ধনঞ্জয়ের বক্ষঃস্থলে আঘাত করিলেন। ধনঞ্জয় পাঁচবাণে শল্যের শরাসন ও হস্তাবাপ [হস্তাচ্ছাদন-দস্তানা] ছেদন করিয়া তীক্ষ্ন সায়কসমূহে তাঁহার মর্ম্মে দৃঢ়তর আঘাত করিলেন। শল্য রোষাবিষ্ট হইয়া অন্য ভারসহ শরাসন গ্রহণপূর্ব্বক অর্জ্জুনের উপর তিন, বাসুদেবের পাঁচ এবং ভীমসেনের বাহুযুগলে ও বক্ষঃস্থলে নয় বাণ আঘাত করিলেন। অনন্তর যে স্থানে মহারথ ধনঞ্জয় ও ভীমসেন কৌরবগণের মহাসেনা সংহার করিতেছিলেন, দ্রোণাচাৰ্য্য ও মগধরাজ জয়ৎসেন দুৰ্য্যোধনের ইঙ্গিত অনুসারে তথায় আগমন করিলেন। জয়ৎসেন ভীমায়ুধ [ভীষণ অস্ত্ৰসম্পন্ন] ভীমসেনকে নিশিত আটসায়কে বিদ্ধ করিলে ভীমসেন প্ৰথমে দশ, পরে পাঁচবাণে জয়ৎসেনকে বিদ্ধ করিয়া ভল্লাস্ত্ৰে তাঁহার সারথিকে রথনীড় [রথ প্রকোষ্ঠসারথির বসিবার স্থান] হইতে নিপাতিত করিলেন; জয়ৎসেনের অশ্বগণ উদভ্ৰান্ত ও ইতস্ততঃ ধাবমান হইয়া সৈন্যগণের সমক্ষে তাহাকে তথা হইতে অপসারিত করিল। তখন দ্রোণাচাৰ্য্য রন্ধ প্রাপ্ত হইয়া আটবাণে ভীমসেনকে বিদ্ধ করিলে ভীমসেন পঞ্চষষ্টিভল্লে পিতৃতুল্য গুরু দ্রোণাচাৰ্য্যকে বিদ্ধ করিলেন। এদিকে সমীরণ যেমন মহামেঘসকলকে ছিন্নভিন্ন করে, ধনঞ্জয় ভুরি ভুরি আয়স[লৌহনির্ম্মিত]বাণে সুশর্ম্মাকে বিদ্ধ করিয়া তাঁহার সৈন্যগণকে সেইরূপ ছিন্নভিন্ন করিতে লাগিলেন।
“অনন্তর ভীষ্ম, রাজা দুৰ্য্যোধন ও কোশলরাজ বৃহদ্বল রোষাবিষ্ট হইয়া ভীম ও অর্জ্জুনের সম্মুখবর্ত্তী হইলেন। এদিকে পাণ্ডবগণ ও ধৃষ্টদ্যুম্ন ব্যাদিতবদন অন্তকসদৃশ ভীষ্মের প্রতি ধাবমান হইলেন। শিখণ্ডী মহারথ ভীষ্মকে প্রাপ্ত হইয়া নিৰ্ভয়ে ও সন্তুষ্টচিত্তে তাঁহাকে আক্রমণ করিলেন। এইরূপে যুধিষ্ঠিরপ্রভৃতি পাণ্ডবগণ ও সৃঞ্জয়গণ শিখণ্ডীকে এবং কৌরবগণ ভীষ্মকে অগ্রসর করিয়া পরস্পর যুদ্ধ করিতে লাগিলেন। ভীষ্মের জয়লাভ বাসনায় পাণ্ডবগণের সহিত কৌরবগণের ভয়াবহ যুদ্ধ আরম্ভ হইল। কৌরবগণ সমরূপ দ্যূতক্ৰীড়া আরম্ভ করিয়া জয়লাভের নিমিত্ত ভীষ্মকে পণ করিলেন। ধৃষ্টদ্যুম্ন সৈন্যগণকে আদেশ করিলেন, “হে মহারথগণ! নিৰ্ভয় হইয়া শান্তনুতনয়কে আক্রমণ কর।” সৈন্যগণ সেনাপতির বাক্যে সত্বর হইয়া প্ৰাণপণে ভীষ্মকে আক্রমণ করিল। মহাসাগর যেমন নিপতিত তীরভূমি গ্ৰাস করে, মহারথ ভীষ্ম সেইরূপ আগচ্ছমান [সম্মুখে আগত] পাণ্ডবসৈন্যগণকে গ্ৰাস [নিহত] করিলেন।”