১১৩তম অধ্যায়
সাত্যকি কর্ত্তৃক বহু কৌরব-বীর বধ
হে মহারাজ! এই রূপে মহাবীর সাত্যকি আপনার সৈন্যের প্রতি গমন করিলে তাঁহার পশ্চাৎ মহারাজ যুধিষ্ঠির সেনাপরিবৃত হইয়া দ্রোণাচার্য্যের রথোদ্দেশে ধাবমান হইলেন। ঐ সময় সমরদুৰ্ম্মদ পাঞ্চাল রাজতনয় এবং রাজা বসুদান ইঁহারা দুই জনে ‘শীঘ্র আগমন কর, প্রহার কর, ধাবমান হও; সমরদুৰ্ম্মদ সাত্যকি যেন অক্লেশে কৌরবসৈন্য মধ্যে প্রবেশ করিতে পারেন’, এই বলিয়া পাণ্ডবসৈন্য মধ্যে চীৎকার করিতে লাগিলেন। তখন মহারথগণ, আজি সমুদায় বীরের সাত্যকির জয়লাভ বিষয়ে যত্নবান্ হইবেন, এই বলিতে বলিতে মহাবেগে কৌরবসৈন্যাভিমুখে ধাবমান হইলেন। কৌরবসৈন্যগণ ও তদ্দর্শনে জয়াভিলাষী হইয়া তাঁহাদিগের অভিমুখে গমন করিতে লাগিল। ঐ সময়ে সাত্যকির রথ সমীপে মহান্ শব্দ সমুত্থিত হইল। দুর্য্যোধনের সৈন্য সকল চতুর্দ্দিক হইতে যুযুধানের প্রতি ধাবমান হইতে লাগিল। তখন মহারথ সাত্যকি সেই সৈন্যদিগকে শতধা ছিন্ন ভিন্ন করিয়া অগ্নিসন্নিভ শরদ্বারা পুনরাবর্তী ধনুর্ধারী সাত জন মহাবীর ও নানা জন পদস্থ অন্যান্য ভূপালগণকে যমালয়ে প্রেরণ করিলেন। তিনি কখন এক বাণে শত ব্যক্তিকে, কখন বা এক শত বাণে এক ব্যক্তিকে বিদ্ধ করিতে লাগিলেন। মহারুদ্র যেরূপ প্রাণিগণকে বিনাশ করেন, সেই রূপ তিনি হস্তী ও হস্তারোহী অশ্ব ও অশ্বারোহী এবং রথ ও রথীদিগকে বিনাশ করিতে আরম্ভ করিলেন। ঐ সময় কৌরব পক্ষীয় কোন সৈনিক পুরুষই সেই শরনিকরবর্ষী সাত্যকির অভিমুখে গমন করিতে সমর্থ হইলেন না। তাঁহারা তৎকর্ত্তৃক মর্দ্দিত ও তাঁহার প্রভাবে মোহিত হইয়া চতুর্দ্দিক তন্ময় অবলোকন করিয়া সমর পরিত্যাগ পূর্ব্বক ভয়ে পলায়ন করিতে লাগিলেন। ভগ্ননীড় রথ, রথচক্র, ছত্র, ধ্বজ, অনুকৰ্ষ, পতাকা, কাঞ্চনময় শিরস্ত্রাণ, করিকর সদৃশ অঙ্গদ যুক্ত চন্দনদিগ্ধ বাহু, ভুজগাকার উরু ও শশধর সদৃশ কুণ্ডলালঙ্কৃত বদন মণ্ডল ছিন্ন ও নিপতিত হওয়াতে সমরভূমি সমাচ্ছন্ন হইল। পর্ব্বতাকার গজ সমুদায় ভূতলশায়ী হইলে বোধ হইতে লাগিল যেন, সমর ভূমি ভূধর সমূহে সমাকীর্ণ হইয়াছে। মুক্তাবলি বিভূষিত সুবর্ণযোক্ত্র ও বিচিত্রাকার বর্ম্ম বিভূষিত অশ্বগণ মহাবাহু সাত্যকি শরে প্রমথিত ও ভূতলশায়ী হইয়া অতি রমণীয় শোভা ধারণ করিল।
ব্যূহপ্রবিষ্ট সপাণ্ডব সাত্যকিসহ দ্রোণযুদ্ধ
হে মহারাজ! এই রূপে মহাবাহু সাত্যকি আপনার সৈন্যগণকে নিপাতিত ও বিদ্রাবিত করিয়া তন্মধ্যে প্রবেশপূর্ব্বক যে পথে ধনঞ্জয় প্রবেশ করিয়াছিলেন, সেই পথে গমনোদ্যত হইলেন। দ্রোণাচাৰ্য্য তাঁহাকে নিবারণ করিতে আরম্ভ করিলেন। মহাবীর সাত্যকি দ্রোণ দর্শনে প্রতিনিবৃত্ত হইয়া তাঁহার সহিত যুদ্ধ করিতে লাগিলেন। তখন মহা বীর দ্রোণাচার্য্য মর্ম্মভেদী শাণিত পাঁচ শরে সাত্যকিকে বিদ্ধ করিলেন। মহাবীর যুযুধানও কঙ্কপত্র ভূষিত শিলাশিত সুবর্ণপুঙ্খ সাত বাণে তাঁহাকে বিদ্ধ করিয়া গৰ্জন করিতে লাগিলেন। পরে আচাৰ্য্য ছয় বাণ দ্বারা তাঁহাকে ও তাঁহার সারথিকে নিপীড়িত করিলেন। মহাবীর সাত্যকি দ্রোণের বিক্রম সহ্য করিতে না পারিয়া প্রথমত ক্রমে ক্রমে তাঁহাকে দশ, ছয় ও আট বাণে বিদ্ধ করিয়া সিংহনাদ করিতে লাগিলেন। তৎপরে পুনরায় তাঁহাকে দশ বাণে বিদ্ধ করিয়া চারি শরে অশ্ব, এক শরে ধ্বজ ও এক শরে সারথিকে বিদ্ধ করিলেন। তখন মহাবীর দ্রোণ একবারে পতঙ্গকুল সদৃশ শরজালে তাঁহাকে এবং তাঁহার অশ্ব, রথ, ধ্বজ ও সারথিকে আচ্ছাদিত করিয়া ফেলিলেন। মহাবীর সাত্যকিও তাঁহাকে শরনিকরে সমাচ্ছন্ন করিলেন। তখন দ্রোণাচার্য্য সাত্যকিকে সম্বোধন করিয়া কহিলেন, ‘হে শৈনেয়! তোমার আচার্য্য অর্জ্জুন যেরূপ আজি কাপুরুষের মত আমার সহিত যুদ্ধ করিতে করিতে রণ পরিত্যাগ পূর্ব্বক দক্ষিণ দিকে পলায়ন করিয়াছে, যদি তুমি সেই রূপ পলায়ন না কর, তাহা হইলে আজি তোমাকে জীবিত থাকিতে হইবে না।’ সাত্যকি দ্রোণের বাক্য শ্রবণ করিয়া কহিলেন, ‘হে ব্ৰহ্মন্! আপনার মঙ্গল হউক; আমি আর কাল বিলম্ব করিতে পারি না। আমাকে ধর্ম্মরাজের আদেশানুসারে ধনঞ্জয়ের নিকট গমন করিতে হইবে। শিষ্যেরা সর্ব্বদা আচার্য্যের পদবীতেই পদ নিক্ষেপ করিয়া থাকে; অতএব আমি আপনাকে পরিত্যাগ করিয়া যে স্থানে আমার গুরু অবস্থান করিতেছেন, সত্বরে সেই স্থানে গমন করিব।’
কৌরবসৈন্য পলায়নে কৃতবর্ম্মার অভিযান
হে মহারাজ! মহাবীর শৈনেয় এই বলিয়া সহসা আচাৰ্য্যকে পরিত্যাগ পূর্ব্বক গমন করিতে লাগিলেন এবং সারথিকে কহিলেন, হে সারথে! দ্রোণ আমার নিবারণের নিমিত্ত বিশেষ চেষ্টা করিবেন; অতএব তুমি সাবধানে রণস্থলে গমন কর। এই যে, অবন্তিদেশীয় মহাপ্রভাবশালী সৈন্য অবলোকন করিতেছ, উহার পরেই সূতপুত্র প্রমুখ বহুতর দাক্ষিণাত্য সৈন্য, তাহার পরেই উদ্যতাস্ত্র বাহ্লিকদিগের মহাবল পরাক্রান্ত সৈন্য এবং উহার নিকটেই মহাবীর কর্ণের বল সমুদায় অবস্থান করিতেছে। উহারা পরস্পর ভিন্ন; কিন্তু রণস্থলে পরস্পর পরস্পরের সাহায্যে রক্ষিত হইতেছে। তুমি নিঃশঙ্কচিত্তে অনতি দ্রুতবেগে উহাদিগের মধ্যে অশ্বসঞ্চালন কর।’ মহাবীর সাত্যকি সারথিকে এই কথা বলিতে বলিতে সহসা আচার্য্যকে পরিত্যাগ পূর্ব্বক অসম্ভ্রান্ত চিত্তে কর্ণের সৈন্যাভিমুখে গমন করিতে আরম্ভ করিলে দ্রোণাচাৰ্য্য ক্রোধভরে তাঁহার উপর বহুতর বিশিখ প্রহার করিয়া তাঁহার পশ্চাৎ পশ্চাৎ ধাবমান হইলেন। তখন মহাবীর যুযুধান শাণিত শরনিপাতে কর্ণের সেনাগণকে আহত করিয়া অসীম ভারত সৈন্য মধ্যে প্রবিষ্ট হইলেন। তিনি প্রবেশ করিবামাত্র কৌরব পক্ষীয় সৈনিক পুরুষেরা ভয়ে পলায়ন করিতে লাগিল। মহাবীর কৃতবর্ম্মা তদ্দর্শনে রোষাকুলিত মনে সাত্যকির নিবারণে প্রবৃত্ত হইলেন। তখন মহাবল পরাক্রান্ত সাত্যকি কৃতবর্ম্মাকে ছয় শরে বিদ্ধ করিয়া চারি বাণে তাঁহার চারি অশ্ব বিনাশপূর্ব্বক পুনরায় তাঁহার বক্ষস্থলে নতপৰ্ব্ব ষোড়শ শর নিক্ষেপ করিলেন। মহাবীর কৃতবর্ম্মা সাত্যকির শরনিকরে নিপীড়িত হইয়া ভীষণ ভুজগসন্নিভ বায়ুবেগগামী বৎসদন্ত বাণ শরাসনে সন্ধান পূর্ব্বক আকর্ণ আকর্ষণ করিয়া তাঁহার বক্ষস্থলে নিক্ষেপ করিলে উহা সাত্যকির বৰ্ম্ম ও দেহ ভেদপূর্ব্বক রুধিলিপ্ত হইয়া ধরাতলে প্রবিষ্ট হইল। অনন্তর পরমাস্ত্রবিৎ কৃতবর্ম্মা স্বীয় শরনিকরে সাত্যকির সশর শরাসন ছেদন পূর্ব্বক ক্রোধভরে তাঁহার বক্ষস্থলে সুতীক্ষ্ন দশ বাণ বিদ্ধ করিলেন। বীরশ্রেষ্ঠ সাত্যকি ছিন্ন কাৰ্ম্মুক হইয়া কৃতবর্ম্মার দক্ষিণ করে শক্তি প্রহার করিলেন এবং অবিলম্বে অন্য সুদৃঢ় শরাসন আকর্ষণ করিয়া অসংখ্য শরে তাঁহাকে রথের সহিত সমাচ্ছাদিত করিয়া ভল্লাস্ত্র দ্বারা তাঁহার সারথির মস্তক ছেদন করিয়া ফেলিলেন। কৃতবর্ম্মার অশ্বগণ সারথিবিহীন হইয়া দ্রুতবেগে ধাবমান হইল। তখন ভোজরাজ ব্যস্ত সমস্ত হইয়া স্বয়ং অশ্বরশ্মি গ্রহণপূর্ব্বক শরাসন হস্তে অবস্থান করিতে লাগিলেন। তদ্দর্শনে ভোজসৈন্যেরা তাঁহার ভূয়সী প্রশংসা করিতে আরম্ভ করিল। তিনি মুহুৰ্ত্তকালের মধ্যে শ্রমাপনোদন করিয়া স্বয়ং অশ্ব সঞ্চালন পূর্ব্বক শত্রুগণের ত্ৰাসোৎপাদন করিতে লাগিলেন। তখন মহাবীর সাত্যকি কৃতবৰ্ম্মাকে পরিত্যাগ পূর্ব্বক কাম্বোজ সৈন্য সমীপে গমন করিলে কৃতবর্ম্মাও তৎক্ষণাৎ ভীমের অভিমুখে ধাবমান হইলেন।
হে মহারাজ! এই রূপে মহাবীর যুযুধান ভোজবল হইতে বিনির্গত হইয়া সত্বর কাম্বোজ রাজের সৈন্য মধ্যে প্রবিষ্ট হইলে মহাবল পরাক্রান্ত মহারথগণ তাঁহাকে অবরোধ করিল। তখন তিনি অগ্রসর হইতে সমর্থ হইলেন না। ঐ সময় মহাবীর দ্রোণাচাৰ্য্য সাত্যকির অনুসন্ধান পাইয়া কৃতবর্ম্মার প্রতি স্বীয় সৈন্য রক্ষণের ভারার্পণপূর্ব্বক যুদ্ধ কামনায় তাঁহার প্রতি ধাবমান হইলেন। তখন পাণ্ডব পক্ষীয় প্রধান প্রধান বীরগণ সাত্যকির পশ্চাগামী আচাৰ্য্যকে নিবারণ করিতে লাগিলেন। ঐ সময় ভীমসেন পরিক্ষিত পাঞ্চাল সৈন্যগণ রথী শ্রেষ্ঠ কৃতবর্ম্মার সমীপে সমুপস্থিত হইয়া তৎকর্ত্তৃক নিবারিত ও হতোৎসাহ হইলেন। মহারথ কৃতবর্ম্মা সেই সমরাভিলাষী বীরদিগকে শরনিকরে তাপিত ও তাঁহাদের বাহনগণকে নিতান্ত ক্লান্ত করিলেন; কিন্তু সেই মহাবীরগণ কৃতবর্ম্মাকর্ত্তৃক এই রূপে দৃঢ় সমাহত হইয়াও যশোলাভাভিলাষে সমরে অপরাঙ্মুখ হইয়া ভোজ সৈন্যগণকে পরাজয় করিবার মানসে অবস্থান করিতে লাগিলেন।”