১১২তম অধ্যায়
শাণ্ডিলীর অবজ্ঞায় গরুড়ের পক্ষপতন
নারদ কহিলেন, “অনন্তর গালব ও গরুড় ঋষভপর্ব্বতের শৃঙ্গে অবতীর্ণ হইয়া তপানুষ্ঠানপরায়ণা শাণ্ডিলীনাম্নী ব্রাহ্মণীকে অবলোকন করিলেন এবং তাঁহাকে যথোচিত পূজা করিলে তিনি তাঁহাদিগকে স্বাগত জিজ্ঞাসা করিয়া আসন প্ৰদান করিলেন। তাঁহারা আসনে উপবিষ্ট হইলে তিনি তাঁহাদিগকে বলিমন্ত্রপূত [বলিবৈশ্বাদি অতিথি-পূজাবিধায়ক মন্ত্রে শুদ্ধ] সিদ্ধ অন্ন প্ৰদান করিলেন। তাঁহারা সন্তুষ্টচিত্তে সেই অন্ন ভক্ষণপূর্ব্বক পরিতৃপ্ত হইয়া মোহিতের [গাঢ়ভাবে নিদ্ৰিতের] ন্যায় ভূতলে নিদ্রিত হইলেন। অনন্তর গরুড় গমন করিবার অভিলাষে মুহুর্ত্তমধ্যে প্রবোধিত [জাগরিত] হইয়া দেখিলে, তাঁহার পক্ষসমুদয় পতিত হইয়াছে ও তিনি স্বয়ং মুখচরণবিশিষ্ট মাংসপিণ্ডাকার হইয়া রহিয়াছেন। তখন মহর্ষি গালব তাঁহাকে তদবস্থ নিরীক্ষণ করিয়া বিষণ্ণভাবে জিজ্ঞাসা করিলেন, “হে বিহগরাজ! তুমি কি এই স্থানে আগমন করিয়া এই ফল প্রাপ্ত হইলে? আমাদিগকে কত কাল এই স্থানে বাস করিতে হইবে? তুমি কি মনে মনে কোন ধর্ম্মদূষণ [ধর্ম্মগর্হিত-অধৰ্মযুক্ত] অশুভ বিষয় চিন্তা করিয়াছ? বোধহয়, ইহা তোমার সামান্য ধর্ম্মাতিক্রম [ধৰ্মলঙ্ঘন] নহে।”
“তখন গরুড় কহিলেন, “হে বিপ্ৰ! আমি এই সিদ্ধা ব্ৰাহ্মণীকে প্ৰজাপতিসন্নিধানে লইয়া যাইতে ইচ্ছা করিয়াছিলাম। আমার বাসনা হইয়াছিল যে, এই ব্ৰাহ্মণী ভগবান মহাদেব, সনাতন বিষ্ণু, ধর্ম্ম ও যজ্ঞের সন্নিধানে বাস করেন। যাহা হউক, এক্ষণে আমি ইঁহার নিকট প্ৰণতিপূর্ব্বক প্রার্থনা করিয়া ইঁহাকে প্রীত করি।”
গরুড়ের পুনঃ পক্ষোদগম
“ ‘গরুড় ব্রাহ্মণীকে কহিতে লাগিলেন, “ভগবতি শাণ্ডিলি! আমি অজ্ঞানবশতঃ মনে মনে আপনার অনভিমত কাৰ্য্যানুষ্ঠানের বাসনা করিয়াছিলাম; অতএব আপনি স্বীয় মাহাত্ম্যপ্রভাবে আমার সেই অপরাধ ক্ষমা করুন।’ শাণ্ডিলী শকুন্তের [গরুড়পক্ষীর] অনুনয়ে পরিতুষ্ট হইয়া কহিলেন, “হে সুপর্ণ! তোমার ভয় নাই; তুমি পূর্ব্বের ন্যায় সুন্দরপক্ষযুক্ত হইলে। হে বৎস! আমি নিন্দা সহ্য করিতে পারি না; তুমি আমার নিন্দা করিয়া এই দুৰ্দশাগ্ৰস্ত হইয়াছিলে। যে পাপাত্মা আমার নিন্দা করে, সে পুণ্যলোক হইতে ভ্ৰষ্ট হয়। আমি সমুদয় অশুভলক্ষণবিহীন, অনিন্দিত ও সদাচারসম্পন্ন হইয়াই এই উৎকৃষ্ট সিদ্ধিলাভ করিয়াছি। সদাচারই ধর্ম্ম, ধন ও ঐশ্বৰ্য্যপ্ৰাপ্তির এবং অশুভলক্ষণবিনাশের প্রধান কারণ। সে যাহা হউক, এক্ষণে তুমি স্বেচ্ছানুসারে গমন করিতে পার। স্ত্রীলোক বস্তুতঃ নিন্দনীয় হইলেও কখন তাহার নিন্দা করিও না। আমার বাক্যানুসারে তুমি পূর্ব্বের ন্যায় বলবীৰ্য্য সম্পন্ন হইবে।’ শাণ্ডিলীর বাক্যাবসানে বিনতানন্দন গরুড়ের পক্ষদ্বয় পূর্ব্ববৎ বলসম্পন্ন হইল। তখন তিনি শাণ্ডিলীর অনুজ্ঞা গ্রহণপূর্ব্বক স্বাভিলাষানুসারে নানা স্থান ভ্ৰমণ করিয়া পূর্বোক্তরূপ অশ্ব অন্বেষণ করিতে লাগিলেন; কিন্তু কোথাও কৃতকাৰ্য্য হইতে পারিলেন না।
গালবের পুনঃ বিশ্বামিত্ৰ-সাক্ষাৎকার
“অনন্তর বিশ্বামিত্ৰ গরুড় ও গালবকে পথিমধ্যে সন্দর্শন করিয়া গরুড়ের সমক্ষে গালবকে কহিতে লাগিলেন, ‘হে দ্বিজ! তুমি আমাকে যাহা প্ৰদান করিতে অঙ্গীকার করিয়াছিলে, আমার মতে তৎপ্রদানের সময় সমুপস্থিত হইয়াছে; অথবা তুমি যাহা বিবেচনা কর। তোমার অঙ্গীকারদিবসাবধি যত দিন অতিবাহিত হইল, আমি আরও ততদিন প্রতীক্ষা করিতে সম্মত আছি। অতএব তুমি এক্ষণে স্বকাৰ্য্যসংসাধনে যত্নবান হও।”
“তখন পতগরাজ গরুড় নিতান্ত দীনভাবাপন্ন একান্ত দুঃখিত গালবকে কহিলেন, “হে দ্বিজোত্তম! বিশ্বামিত্ৰ যাহা কহিলেন, তৎসমুদয় শ্রবণ করিয়াছি; অতএব চল, এক্ষণে উভয়ে অশ্বপ্রাপ্তির পরামর্শ করি, গুরুকে অঙ্গীকৃত অর্থ প্রদান না করিয়া নিশ্চিন্ত থাকা কোনক্রমে তোমার বিধেয় নহে।’ ”