হেনকালে হনুমান যায় বনে বন।
গুয়া নারিকেল দেখে অতি সুশোভন।।
কোকিলের কুহুবর ভ্রমর ঝঙ্কার।
নানা পক্ষী কলবর লাগে চমৎকার।।
দীঘি সরোবর দেখে সলিল নির্ম্মল।
প্রস্ফুটিত কোকনদ পঙ্কজ উৎপল।।
লঙ্কাপুরীর চারিদিকে বেষ্টিত সাগর।
দেবতার গতি নাহি লঙ্কার ভিতর।।
সোণার প্রাচীর মধ্যে, বাহিরে লোহার।
গগন-মণ্ডলে চূড়া লাগিছে তাহার।।
এইরূপে হনুমান ভ্রমে চতুর্ভিতে।
মনে মনে কত চিন্তা লাগিল করিতে।।
রাবণের প্রতাপ দুর্জ্জয় লঙ্কাপুরে।
বানর কটক তাহে কি করিতে পারে।।
এখানে আসিতে পারে শক্তি আছে কার।
চারি ব্যক্তি বিনা আর সকলি অসার।।
সুগ্রীব আসিতে পারে বীর-অবতার।
যুবরাজ, অঙ্গদ আসিতে পারে আর।।
আসিবার শক্তি ধরে নীল সেনাপতি।
আমিও আসিতে পারি অব্যাহত গতি।।
যেই কার্য্যে আসিয়াছি সীতা দেখি আগে।
শেষেতে করিব কার্য্য যেখানে যে লাগে।।
ভাণ্ডাইব কেমনে দুর্জ্জয় শত্রুগণে।
কেমনে চিনিব আমি রাজা দশাননে।।
বেড়াইব কেমনে কনক লঙ্কাপুরী।
কেমনে চিনিব আমি রামের সুন্দরী।।
রামের প্রেয়সী সীতা কভু নাহি দেখি।
কেমনে চিনিব আমি সীতা চন্দ্রমুখী।।
হাস্য পরিহাস কথা বচন চাতুরী।
সেখানে না থাকিবেন জানকী সুন্দরী।।
সর্ব্বক্ষণ চক্ষে অশ্রু মলিন বসনা।
সেই সে রামের সীতা হয় বিবেচনা।।
সীতারে দেখিতে যদি হয় জানাজানি।
হয় হউক তাহাতে করিব হানাহানি।।
অস্ত গেল ভানুমান বেলা অবসান।
মধ্যগড়ে প্রবশ করিল হনুমান।।
নিশাকর সুপ্রকাশ করিল হনুমান।
ভালমতে হনুমান লঙ্কাকে নেহালে।।
চালের উপরে শোভে সুবর্ণের ধারা।
চারিভিতে শোভা করে মুকুতার ঝারা।।
প্রতি ঘরে ঘরে ধ্বজা পতাকা বিরাজে।
রাজার মন্দির সে সুন্দর সাজে সাজে।।
হনুমান স্বেচ্ছায় বিবিধ মায়া ধরে।
নেউল প্রমাণ হয়ে ভ্রমে ঘরে ঘরে।।
মাণিক কাঞ্চন আর প্রবাল প্রস্তর।
অন্ধাকারে আলো করে লঙ্কা-পুরী-ঘর।।
কাঞ্চন-নির্ম্মিত ঘাট দীঘি ও পুখরী।
আনন্দিত হনুমান দেখি লঙ্কাপুরী।।
পরমা সুন্দরী কন্যা দেখে নানা বেশে।
যুবতীরা নিদ্রা যায় শুয়ে স্বামী পাশে।।
সর্ব্বাঙ্গসুন্দরী নানা রত্ন-বিভূষিতা।
দেখি হনুমান বলে এই দেবী সীতা।।
কুবেশা মলিনা সেই অশ্রুজলে ভাসে।
সেই হবে সীতাদেবী যুক্তি ভাল আসে।।
অতি সুশোভন বিভীষণের আবাস।
দেখে মহাদেবের সে অপূর্ব্ব নিবাস।।
উল্কাজিহ্ব বিদ্যুৎজিহ্ব আর বিদ্যুন্মালী।
শুক সারণের ঘর দেখে মহাবলী।।
কুমার সবার ঘর দেখে সারারাতি।
একে একে দেখে যত লঙ্কার বসতি।।
কোন স্থানে সীতার না পাইয়া উদ্দেশ।
রাজ-অন্তঃপুরে বীর করিল প্রবেশ।।
রাজার দ্বারেতে দেখে দ্বারা সারি সারি।
দুর্জ্জয় রাক্ষস সব নানা অস্ত্রধারী।।
দেখিল পুস্পক রথ বিচিত্র নির্ম্মাণ।
তদুপরি লাফ দিয়া উঠে হনুমান।।
সেই রথে সারথি যে দেবতা পবন।
পিতা পুত্রে উভয়েতে হইল মিলন।।
পুত্রে সম্ভাষিয়া পিতা গেল নিজ স্থান।
রাবণের ঘরে প্রবেশিল হনুমান।।
রাবণ শুইয়া আছে রত্নময় খাটে।
ঘর আলো করিতেছে দশটা মুকুটে।।
রাজদেহে আভরণ দেখিল প্রচুর।
দীপ্ত করি মেঘ যেন পড়িল চিকুর।।
নিদ্রা যায় রাবণ মৃঙ্গার-অবসাদে।
কস্তূরী কুঙ্কুমে রাজা লোভে মৃগমদে।।
চারিভিতে দেবকন্যা মধ্যেতে রাবণ।
আকাশের চন্দ্র বিড়ি যেন তারাগণ।।
শোভে এক ঠাঁই নব রমণীর গলা।
একসূত্রে গাঁথা যেন পারিজাত মালা।।
খোল করতাল কারো বীণা বাঁশী কোলে।
অচেতন নিদ্রায় লোটায় ভূমিতলে।।
মানুষী গন্ধর্ব্বী দেবী দানবী রাক্ষসী।
রাবণের ঘরে আছে পরমা রূপসী।।
নীলবর্ণ রাবণ সে পীতবস্ত্রধারী।
নবজলের যেন বিদ্যুৎ সঞ্চারি।।
রাবণের কোলে দেখে পরমা সুন্দরী।
ময়দানবের কন্যা রাণী মন্দোদরী।।
সোহাগে আগুলি সেই রত্নে বিভূষিতা।
তারে দেখি ভাবে বীর এই বুঝি সীতা।।
রামগুণে পুরুষ নাহিক ত্রিভুবনে।
রাবণে ভজিবে সীতা নাহি লয় মনে।।
দশরথ পুত্রবধূ জনক-ঝিয়ারী।
ভজিবেন রাবণেরে মনে নাহি করি।।
একে একে সকলে করিল নিরীক্ষণ।
সীতার লক্ষণ নাহি দেখে এক জন।।
কুড়ি চক্ষু মুদিত নিদ্রিত লঙ্কেশ্বর।
নিরখিয়া হনুমান পাইলেক ডর।।
অন্তঃপুরে সীতার না পাইয়া উদ্দেশ।
আর ঘরে গিয়া হনু করিল প্রবেশ।।
যে ঘরে রাবণ রাজা করে মধুপান।
সেই ঘরে প্রবেশ করিল হনুমান।।
ভক্ষ্য ঘরে প্রবেশিয়া দেখে নানা ভক্ষ্য।
মনুষ্য পশুর মাংস দেখে লক্ষ লক্ষ।।
সেখানে সীতার না পাইল দরশন।
প্রাচীরে বসিয়া ভাবে পবন-নন্দন।।
সর্ব্ব স্থান দেখিলাম করিয়া বিচার।
ঘরে ঘরে দেখি সব কুৎসিৎ আচার।।
জিতেন্দ্রিয় কপি কারো পানে নাহি মন।
উলঙ্গ উন্মত্ত যত করে নিরীক্ষণ।।
সীতা হেতু অর্দ্ধরাত্রি করি জাগরণ।
অনেক ভ্রমণে নাহি পাই অন্বেষণ।।
বল বুদ্ধি পরাক্রম শ্রীরামে ভকতি।
করিল সকল নষ্ট বিহঙ্গ সম্পাতি।।
তার বাক্য তরিলাম দুস্তর সাগর।
সীতা হেতু ভ্রমিলাম লঙ্কার ভিতর।।
এ লঙ্কা হইতে নাহি করিব গমন।
এই লঙ্কাপুরে আমি ত্যজিব জীবন।।
কান্দিতে কান্দিতে বীর ছাড়িল নিশ্বাস।
রচিল সুন্দরাকাণ্ড কবি কৃত্তিবাস।।