১০ম অধ্যায়
গোপবেশধারী সহদেবের বিরাটরাজসভাপ্রবেশ
বৈশম্পায়ন কহিলেন, সহদেবও অনুত্তম গোপবেশ ধারণ ও তাহাদিগের ভাষা অভ্যাস করিয়া বিরাটের নিকট গমন করিলেন। তিনি রাজভবনসমীপবর্তী গোষ্ঠে দণ্ডায়মান ছিলেন। রাজা তাঁহাকে নয়নগোচর করিবামাত্র অতিমাত্র বিষ্ময়াপন্ন হইয়া তাঁহার নিকট লোক প্রেরণ করিলেন। অনন্তর বিরাটরাজ সমাগত প্রদর্শনপূর্ব্বক জিজ্ঞাসা করিলেন, “তাত! আমি পূর্ব্বে তোমাকে কখন দেখি নাই। তুমি কাহার পুত্র, কোথা হইতে আগমন করিলে এবং তোমার অভিপ্রায়ই বা কি, সমুদয় যথার্থকরিয়া বল।”
তখন সহদেব জলদগম্ভীরস্বরে কহিলেন, “মহারাজ! আমি বৈশ্য, আমার নাম অরিষ্টনেমি, আমি কৌরবদিগের গোসংখ্যাকাৰ্য্যে নিযুক্ত ছিলাম। সম্প্রতি রাজসিংহ পাণ্ডবেরা কোথায় গিয়াছেন, কিছুই জানি না, আমিও বিষয়কর্ম্মশূন্য হইয়া জীবনধারণ করিতে নিতান্ত অসমর্থ; অতএব আপনি ক্ষত্ৰিয়শ্রেষ্ঠ, আপনার নিকট থাকিতে অভিলাষ করি; অন্য রাজার নিকট যাইতে আমার ইচ্ছা হয় না।”
বিরাটরাজ কহিলেন, “হে অমিত্রকর্ষণ [অরিমর্দ্দন—শক্রমর্দ্দনকারী]! তুমি যথার্থরূপ আত্মপরিচয় প্রদান কর; তোমার আকৃতিদর্শনে স্পষ্টই প্রতীতি হইতেছে যে, তুমি ব্রাহ্মণ অথবা আসমুদ্রক্ষিতীশক্ষত্ৰিয় হইবে। বৈশ্যের কর্ম্মকরা তোমার উচিত হয় না। তুমি কোন রাজার রাজ্য হইতে আসিয়াছ, কি কি শিল্পকর্ম্ম জান, সর্ব্বদা কিরূপে আমার নিকট বাস করিবে এবং কিরূপ বেতনই বা প্রার্থনা কর?”
সহদেব কহিলেন, “পাণ্ডবজ্যেষ্ঠ যুধিষ্ঠিরের অষ্টশত সহস্ৰ গো অন্যের দশ সহস্র ও অপরের বিংশতি সহস্ৰ ধেনু ছিল। আমি সেই সকল ধেনুর সংখ্যা করিতাম, লোকে আমাকে তন্তিপাল বলিত। আমি দশ যোজনের মধ্যস্থিত গো-সমুদয়ের সংখ্যা করিতে পারি এবং ভূত, ভবিষ্যৎ ও বর্ত্তমান অবগত আছি। আমার মুণরাশি মাহাত্মা কুরুরাজের সুবিদিত ছিল, তিনি আমার প্রতি অতিশয় প্রীত ছিলেন। যে সকল উপায় দ্বারা শীঘ্র গোসংখ্যার বৃদ্ধি হয় এবং তাহাদিগের কোন প্রকার রোগ না জন্মে, তাহা আমার বিদিত। আমি এই সকল জানি। হে মহারাজ! যে সমুদয় ঋষভের [বৃষের] মূত্র আত্মাণ করিলে বন্ধ্যারও গর্ভ হয়, আমি পূজিতলক্ষণ সেই সকল বৃষকেও চিনিতে পারি।”
বিরাটরাজ কহিলেণ, “আমার পশুশালায় নানাজাতীয় অসংখ্য পশু একত্র অবস্থিত রহিয়াছে, তাহাদিগের মধ্যে কাহার কি গুণ, তাহাও প্রকাশিত হয় নাই, আমি তোমার হস্তে সেই সকল পশু ও পশুগণের ভার সমর্পণ করিতেছি, এক্ষণে উহারা তোমার অধীন হইল।”
নরোত্তম সহদেব এইরূপে রাজার নিকট সুপরিচিত হইয়া পরমসুখে তথায় বাস করিতে লাগিলেন। রাজাও তাঁহার অভিলাষানুরূপ বেতন প্ৰদান করিতেন। অন্য লোকে তাহাকে কোনক্রমেই চিনিতে পারে নাই।