নবাধিকশততম অধ্যায়
ধৃতরাষ্ট্রাদির জন্মে বিবিধ শুভলক্ষণ
বৈশম্পয়ান কহিলেন, ধৃতরাষ্ট্র, পাণ্ডু ও বিদুর এই তিন কুমার জন্মগ্রহণ করিলে কুরুজাঙ্গল, কুরব এবং কুরুক্ষেত্র এই তিনটি জনপদ অতীব সমৃদ্ধসম্পন্ন হইয়া উঠিল। পৃথিবী সরস ও সুস্বাদ শস্যে পরিপুর্ণা হইল; পর্জ্জন্য [মেঘ] যথাকালে জলবর্ষণ করিতে লাগিল; পাদপসকল সুরস ফল-কুসুমে সুশোভিত হইল। গবাশ্বাদি বাহন সকল প্রহৃষ্ট, মৃগযুথ ও পক্ষিগণ সানন্দ, কুসুমমালা সুগন্ধি এবং ফলরাশি রসপূর্ণ হইল; নগর ব্যবসায়ী ও শিল্পিগণে পরিব্যাপ্ত হইল এবং জনপদস্থ সমস্ত লোক মহাবলপরাক্রান্ত, কৃতবিদ্য, সচ্চরিত্র ও পরম সুখী হইল। তৎকালে দস্যু-তস্করের কিছুমাত্র প্রাদুর্ভাব রহিল না; অধর্ম্মাচার লোকের অন্তর হইতে এককালে আন্তর্হিত হইল। প্রজাগণের রীতি, নীতি, সদাচার ও সদ্ব্যবহার সন্দর্শনে সেই সময়কে সত্যযুগ বলিয়া প্রতীয়মান হইত। প্রজামণ্ডলী ধর্ম্মনিরত, যজ্ঞশীল, সত্যপরায়ণ, ব্রতনিষ্ঠ ও পরস্পর প্রণয়পর হইয়া স্বচ্ছন্দে কালাতিপাত করিত। সকল লোকই অভিমানশূন্য, জিতক্রোধ ও লোভবিহীন হইল। দিন দিন তাহাদিগের ধর্ম্মপ্রবৃত্তির শ্রীবৃদ্ধি হইয়া উঠিল। জলপূরিত জলনিধির ন্যায় সেই জনাকীর্ণ নগর মেঘাকার তোরণকলাপ [নানা বর্ণচিত্রিত প্রধান প্রধান দ্বার সমূহ] দ্বারা অনির্ব্বচনীয় শোভমান হইল; শত শত সুরম্য হর্ম্ম্য দ্বারা মহেন্দ্রনগরী অমরাবতীর ন্যায় প্রতীয়মান হইতে লাগিল। বিলাসী নগরবাসী সকল তত্রত্য নদ, নদী, সরোবর প্রভৃতি জলাশয়ে এবং পরমরমণীয় বন, উপবন ও ক্রীড়াশৈলে মনের সুখে বিহার করিয়া বিপুল আনন্দ অনুভব করিতে আরম্ভ করিল। দাক্ষিণাত্য[দক্ষিণদিক্স্থিত] কুরুগণ উদীচ্য [উত্তরদিক্স্থিত] কুরুদিগের সর্ব্বদাই স্পর্দ্ধা করিতেন। সেই সুরম্য জনপদে কেহই কৃপণস্বভাব ছিলেন না; পতিবিহীনা কামিনী নেত্রগোচর হইত না; লোকহিতার্থে স্থানে স্থানে কূপ, বাপী [দীর্ঘিকা-দীঘি] আরাম [ রমনীয় উদ্যান-ফলফুলের সুন্দর বাগান] ও সভাসকল প্রতিষ্ঠিত ছিল; সুসমৃদ্ধ বিপ্রভবন-সকল অবিরত উৎসবময় পরিলক্ষিত হইত; ধর্ম্মাত্মা ভীষ্মের পরিরক্ষিত সেই জনপদের ঐশ্বর্য্য ও রমণীয়তার আর পরিসীমা রহিল না। চৈত ও যূপকাষ্ঠ তত্রস্থ জনগণের যাগশীলতার প্রমাণস্বরূপ লক্ষিত হইত। সেই সকল দেশ অন্যান্য রাজ্যের সাহায্য ব্যতিরেকেও পরিবর্দ্ধিত হইত; ধর্ম্মাত্মা ভীষ্ম তথায় ধর্ম্মচক্র প্রতিষ্ঠিত করিয়াছিলেন; রাজকুমারেরা নিরন্তর সৎকর্মের অনুষ্ঠান করিতেন। পৌর ও জনপদ-সকল তাঁহাদিগের আচরিত প্রণালী অবলম্বন করিবার নিমিত্ত সাতিশয় উৎসুক হইয়াছিলেন। তত্রত্য কুরুপ্রধানদিগের ও নগরবাসিগণের ভবনে ‘দীয়তাং ভুজ্যতাং’ [দান কর−দাও] এই বাক্যই সর্ব্বদা শ্রুতিগোচর হইত; মহাত্মা ভীষ্ম ধৃতরাষ্ট্র, পাণ্ডু এবং মহামতি বিদুর ইহাদিগকে জন্মাবধি পুৎত্রনির্ব্বিশেষে প্রতিপালন করিতেন। তিনি তাঁহাদিগের জাতক্রিয়া প্রভৃতি সমস্ত সংস্কারে সংস্কৃত করিয়াছিলেন; উপযুক্ত শিক্ষকের সন্নিধানে নিযুক্ত করিয়া অধ্যয়ন করাইয়াছিলেন এবং পরিশ্রমে ও ব্যায়াম সুনিপুণ করিয়ছিলেন। রাজতনয়েরা তরুণাবস্থা প্রাপ্ত হইয়া ধনুর্ব্বেদ, গদাযুদ্ধ, অসিচর্ম্ম-প্রয়োগ, গজশিক্ষা, নীতিশাস্ত্র, ইতিহাস, পুরাণ, বেদাঙ্গ প্রভৃতি সমস্ত অধ্যেতব্য বিষয়ে পারদর্শী হইয়া উঠিলেন। তন্মধ্যে পাণ্ডু অদ্বিতীয় ধানুষ্ক [ধনুর্ব্বিদ্যায় নিপুণ] ও ধৃতরাষ্ট্র অসাধারণ বলবান্ ছিলেন। বিধুরের ন্যায় ধার্ম্মিক ত্রিভুবনমধ্যে দৃষ্টিগোচর হইত না। প্রনষ্টপ্রায় শান্তনুবংশ পুনরুদ্ধৃত হইলে সর্ব্বত্র সত্যের সমাদর ও গৌরব-বৃদ্ধি হইল। মহারাজ! তৎকালে সমস্ত বীরপ্রসবিনী রমণীগণের মধ্যে কাশীশ্বরনন্দিনী, দেশের মধ্যে কুরুজাঙ্গল, ধার্ম্মিকের মধ্যে বিদুর এবং নগরের মধ্যে হস্তিনাপুর শ্রেষ্ঠ হইয়া উঠিল। ধৃতরাষ্ট্র জন্মান্ধ ছিলেন, বিদুর পারসব [ব্রাহ্মণ হইতে শূদ্রাগর্ভজাত] সুতরাং পাণ্ডুই সিংহাসনে অধিরূঢ় হইলেন।