১০৭তম অধ্যায়
ভীষ্মের ভীষণ সমরে পাণ্ডববিমর্ষ
সঞ্জয় কহিলেন, “মহারাজ! অনন্তর মহাবাহু ভীষ্ম ক্রুদ্ধ হইয়া নিশিতসায়কনিকরে পাণ্ডব ও তাঁহাদিগের সেনাগণকে আহত করিতে লাগিলেন। তিনি দ্বাদশশরে ভীমসেনকে, নয়শরে সাত্যকিকে, তিনশরে নকুলকে, সাতশরে সহদেবকে বিদ্ধ করিয়া যুধিষ্ঠিরের বাহুযুগলে ও বক্ষঃস্থলে দ্বাদশশর নিক্ষেপ করিলেন; পরে ধৃষ্টদ্যুম্নকে বিদ্ধ করিয়া সিংহনাদ করিতে লাগিলেন। তখন নকুল দ্বাদশ, সাত্যকি তিন, ধৃষ্টদ্যুম্ন সপ্ততি, ভীমসেন সপ্ত ও যুধিষ্ঠির দ্বাদশশরে ভীষ্মকে প্রতিবিদ্ধ করিলেন। আচাৰ্য্য দ্রোণ যমদণ্ডোপম নিশিত পাঁচশরে সাত্যকি ও ভীমসেনকে আহত করিলেন। যেমন মহাগজ তোদানদণ্ডে বিদ্ধ হয়, সেইরূপ দ্রোণও উঁহাদের তিন-তিন শরে প্রতিবিদ্ধ হইলেন। সৌবীর, কিতব, প্রাচ্য, প্রতীচ্য, উদীচ্য, মালব, অভিষাহ, শূরসেন, শিবি ও বসতিগণ নিশিতশরনিকরাহত ভীষ্মকে পরিত্যাগ করেন নাই। নানাদেশসমাগত অন্যান্য মহীপালগণ বিবিধ আয়ুধহস্তে পাণ্ডবগণের অভিমুখীন হইলেন। পাণ্ডবগণ পিতামহকে বেষ্টন করিলেন।
“চতুর্দ্দিকে রথসমূহে পরিবৃত অপরাজিত ভীষ্ম দাবানলের ন্যায় প্রজ্বলিত হইয়া শত্ৰুগণকে দগ্ধ করিতে লাগিলেন; রথ সেই অগ্নির গৃহ, শরাসন শিখা, অসি, শক্তি ও গদা ইন্ধন এবং শরজাল স্ফূলিঙ্গস্বরূপ হইল। তিনি গৃধ্ৰুপক্ষশোভিত, সুবর্ণপুষ্প, সুতীক্ষ ইষু, কর্ণী, নালীক ও নারাচসমূহে পাণ্ডবসৈন্যগণকে সমাচ্ছন্ন করিয়া নিশিতশরনিকরে রথের ধ্বজাসকল পাতিত করিয়া রথসমুদয় মুণ্ডিত তালফলের ন্যায় করিলেন এবং রথ, গজ ও অশ্বগণকে আরোহিবিহীন করিয়া ফেলিলেন। বজ্ৰনিৰ্ঘোষতুল্য তাঁহার জ্যাতলধ্বনি-শ্রবণে সমুদয় প্রাণী কম্পিত হইয়া উঠিল। হে ভারতশ্রেষ্ঠ! ভীষ্মের শরনিকর ব্যর্থ হইবার নহে; যেসকল শর তাঁহার শরাসন হইতে বির্নিগত হয়, তাহা বিপক্ষের তনুত্রাণে [বর্ম্মে] প্রতিহত হয় না। অনন্তর বেগবান তুরঙ্গমেরা রথিশূন্য রাথসকল আকর্ষণ করিতেছে অবলোকন করিলাম। বিখ্যাত মহারথী, তনুত্যাগে কৃতনিশ্চয়, সমরে অপরাঙ্মুখ, সুবৰ্ণধ্বজ-শোভিত, চতুর্দ্দশসহস্ৰ চেদি, কাশী ও করূষেরা ব্যাদিতবদন কৃতান্তসদৃশ ভীষ্মের সহিত সমাগত হইবামাত্র অশ্বগজসমভিব্যাহারে পরলোকে প্রস্থান করিলেন। এমন শত-শত ও সহস্ৰ-সহস্ৰ ব্যক্তিকে দর্শন করিলাম, যাহাদের মধ্যে কোন কোন ব্যক্তির রথের যূপকাষ্ঠ ও উপকরণ এবং কোন কোন ব্যক্তির চক্রসকল ভগ্ন হইয়াছে। ভগ্ন রথ ও বরুথ, ছিন্ন শর, কবচ, পট্টিশ, গদা ও ভিন্দিপাল, ভগ্ন তূণীর, চক্র ও খড়্গ, সকুণ্ডল মুখ, তলত্রাণ, অঙ্গুলিত্রাণ এবং নিপাতিত ধ্বজসমূহে সমরভূমি সমাচ্ছন্ন হইয়া উঠিল। শত-শত ও সহস্ৰ-সহস্ৰ গজ ও অশ্ব আরোহীর সহিত নিহত হইল। মহারথগণ ভীষ্মের বাণে পীড়িত হইয়া পলায়ন করিতে লাগিলেন; পাণ্ডবগণ বহু যত্নসহকারেও তাঁহাদিগকে প্রতিনিবৃত্ত করিতে সমর্থ হইলেন না। মহেন্দ্রসদৃশ মহাবীর ভীষ্মের শরাঘাতে পাণ্ডবসৈন্য এরূপ ভগ্ন হইয়া উঠিল যে, দুইজন একত্রে পলায়ন করিতে পারিল না। রথ, হস্তী, অশ্ব, পদাতি ও ধ্বজসমাকুল পাণ্ডবসেনা অচেতনপ্রায় হইয়া হাহাকার করিতে লাগিল। দৈবদুর্বিপাকবশতঃ পিতা পুত্ৰকে, পুত্র পিতাকে ও সখা প্রিয়সখাকে বিনাশ করিতে আরম্ভ করিল। যুধিষ্ঠিরের অন্যান্য সেনা কবচ পরিত্যাগ করিয়া আলুলায়িতকেশে ধাবমান হইতেছে; রথের যুগন্ধরসকল অযথারূপ সংযুক্ত হইয়াছে এবং রণভূমির সৈন্যগণ আর্ত্তনাদ করিতেছে, নয়নগোচর হইল।
“বাসুদেব সৈন্যগণকে ভগ্ন হইতে দেখিয়া, রথ স্থগিত করিয়া অর্জ্জুনকে কহিলেন, ‘পাৰ্থ! এই তোমার অভিলষিত অবসর উপস্থিত হইয়াছে, মোহাবিষ্ট হইও না। হে বীর! সেই বিরাটনগরে রাজসমাজে সঞ্জয়ের নিকট কহিয়াছিলে যে, ভীষ্ম, দ্রোণ প্রভৃতি ধাৰ্তরাষ্ট্রের সৈনিকগণ আমার সহিত যুদ্ধ করিলে আমি তাহাদিগকে সমূলে নির্মূল করিব; এক্ষণে সেই বাক্য সার্থক কর; ক্ষত্রিয়ধর্ম্ম স্মরণপূর্ব্বক সন্তাপ পরিত্যাগ করিয়া যুদ্ধ কর।
“ধনঞ্জয় বাসুদেবের বাক্য শ্রবণ করিয়া তির্যগ্দৃষ্টি [ঘুরপাক খাইয়া] ও অধোমুখ হইয়া অনিচ্ছাপূর্ব্বক কহিলেন, “হে হৃষীকেশ!! অবধ্যদিগকে বধ করিয়া যদি সেই নরকহেতু রাজ্যগ্রহণ করিতে হইল, তাহা হইলে বনবাসে দুঃখভোগ করার কি প্রয়োজন ছিল? যাহা হউক, অশ্ব চালনা কর; তোমার বাক্য রক্ষা করিতে হইবে; কুরুপিতামহ দুৰ্দ্ধৰ্ষ ভীষ্মকে নিপাতিত করিব।”
“তখন বাসুদেব সূৰ্য্যের ন্যায় দুষ্প্রেক্ষ্য ভীষ্মের সমীপে রজতপ্রভ অশ্বগণকে চালনা করিলেন। যুধিষ্ঠিরের সৈন্যগণ ধনঞ্জয়কে ভীষ্মের সহিত সংগ্রাম করিতে সমুদ্যত দেখিয়া পুনরাবৃত্ত হইল। অনন্তর ভীষ্ম মূহুর্ম্মুহুঃ সিংহনাদ করিয়া শরজালে ধনঞ্জয়ের রথ আচ্ছাদিত করিলেন। ক্ষণমাত্রেই রথ, অশ্ব ও সারথি শরজালে এরূপ আচ্ছন্ন হইল যে, আর কিছুই অবগত হইতে পারা গেল না। নিৰ্ভয়স্বভাব বাসুদেব সত্বর হইয়া ধৈৰ্য্যসহকারে ভীষ্মশরাহত অশ্বগণকে চালনা করিতে লাগিলেন। অনন্তর পার্থ জলদনিম্বন দিব্যশরাসন গ্ৰহণ করিয়া নিশিতশরনিকরে ভীষ্মের ধনুচ্ছেদ করিয়া ফেলিলেন। পিতামহ ভীষ্ম নিমেষমধ্যেই অন্য এক বৃহৎ কামুকে গুণযোজনা করিলে ধনঞ্জয় ক্রুদ্ধ হইয়া তাহাও ছেদন করিলেন। ভীষ্ম সাধু মহাবাহো ধনঞ্জয়! সাধু সাধু! বলিয়া তাঁহার লাঘবের প্রশংসা করিয়া পুনর্ব্বার রুচির শরাসন গ্রহণপূর্ব্বক তাঁহার রথের উপর শরনিকর বর্ষণ করিতে লাগিলেন। বাসুদেব মণ্ডল প্রদর্শনপূর্ব্বক ভীষ্মের শরজাল বিফল করিয়া অশ্বপরিচালনে যৎপরোনাস্তি বল প্ৰদৰ্শন করিতে লাগিলেন। বাসুদেব ও ধনঞ্জয় ভীষ্মশরে ক্ষতবিক্ষত হইয়া বিষাণবিক্ষত বৃষভদ্বয়ের ন্যায় শোভা পাইতে লাগিলেন।
পাণ্ডবপরাজয়ে কৃষ্ণের যুদ্ধাৰ্থ অবতরণ
“ধনঞ্জয় মৃদুভাবে যুদ্ধ করিতেছেন আর ভীষ্ম নিরন্তর শরজাল বর্ষণপূর্ব্বক উভয় সেনার মধ্যস্থলে আগমন করিয়া আদিত্যের ন্যায় সন্তাপিত করিতেছেন এবং প্রধান-প্রধান বীরগণকে সংহার করিয়া যেন প্রলয়কাল উপস্থিত করিয়াছেন দেখিয়া, মহাবাহু বাসুদেব সহ্য করিতে সমর্থ হইলেন না; সুতরাং ক্রুদ্ধ হইয়া পার্থের রজতসন্নিভ অশ্বগণকে পরিত্যাগ ও মহারথ হইতে অবতারণাপূর্ব্বক কশাহস্তে সিংহনাদ করিতে করিতে ভীষ্মের প্রতি ধাবমান হইলেন। সেই রোষকষায়িতলোচন অমিতদ্যুতি, মহাযোগী জগদীশ্বরের পদভরে জগতীতল বিদীর্ণ হইতে লাগিল এবং আপনার সৈন্যগণের হৃদয়ে যেন সাতিশয় ভয়সঞ্চার হইয়া উঠিল। বাসুদেব ভীষ্মের প্রতি সমরোদ্যত হইলে কেবল ভীষ্ম হত হইলেন, ভীষ্ম হত হইলেন” এই বাক্যই শ্রবণগোচর হইতে লাগিল। পীতকৌষেয়বসন মরকতকান্তি [মরকতমণিসমুজ্জ্বল] বাসুদেব সিংহনাদসহকারে মাতঙ্গের অভিমুখীন সিংহের ন্যায়৷ ভীষ্মের প্রতি ধাবমান হইয়া বিদ্যুন্মালাবিলসিত জলধরের ন্যায় শোভা ধারণ করিলেন।
“বীরবির ভীষ্ম বাসুদেবকে যুদ্ধে আগমন করিতে অবলোকন করিয়া সসম্ভ্রমে বৃহৎ শরাসন আকর্ষণপূর্ব্বক অভ্রান্তচিত্তে কহিলেন, “হে পুণ্ডরীকক্ষ! হে দেবদেব! তোমাকে নমস্কার; এস, আজি এই মহাযুদ্ধে আমাকে নিপাতিত কর, আমি তোমার হস্তে নিহত হইলে অবশ্যই শ্রেয়োলাভ করিব। আমি ত্ৰৈলোক্যে সম্মানিত হইয়াছি; অদ্য যুদ্ধে তুমি আমাকে যথেচ্ছ প্রহার কর; আমি তোমার দাস।”
অর্জ্জুন অনুরোধে কৃষ্ণের প্রত্যাবর্ত্তন
“এদিকে মহাবাহু ধনঞ্জয় কৃষ্ণের পশ্চাতে ধাবমান হইয়া তাঁহার বাহুযুগল ধারণ করিলেন। রাজীবলোচন কৃষ্ণ অর্জ্জুনকর্ত্তৃক পরিগৃহীত হইলেও তাঁহাকে লইয়াই বেগে গমন করিতে লাগিলেন; কিন্তু দশপদ গমন করিলে পর মহাবল অর্জ্জুন হস্তদ্বারা চরণদ্বয় আবেষ্টনপূর্ব্বক অতিকষ্টে তাঁহাকে নিবৃত্ত করিলেন। তাঁহার নয়নদ্বয় রোষে আকুলিত হইয়াছে; তিনি আশীবিষের ন্যায় নিশ্বাস বিসর্জ্জন করিতেছেন। তখন অর্জ্জুন প্ৰণয়পূর্ব্বক তাঁহাকে কহিলেন, “হে মহাবাহো! নিবৃত্ত হও; তুমি পূর্ব্বে কহিয়াছিলে যে, আমি যুদ্ধ করিব না, এক্ষণে সেই বাক্য মিথ্যা করা উচিত নহে; তাহা হইলে লোকে তোমাকে মিথ্যাবাদী কহিবে। আমার উপরেই সকল ভার সমৰ্পিত আছে; আমিই পিতামহকে বিনাশ করিব; শস্ত্র, সত্য ও সুকৃত্যদ্বারা শপথ করিতেছি যে, আমি শক্ৰগণকে নিঃশেষিত করিব; দুর্জ্জয় মহারথ ভীষ্মকে অদ্যই প্ৰলয়কালীন অসম্পূর্ণ শশধরের ন্যায় নিপাতিত করিব, তুমি তাহা অবলোকন করিবে।”
“মাধব মহাত্মা অর্জ্জুনের বাক্য শ্রবণানস্তর কোন কথা না কহিয়া সক্রোধচিত্তে পুনরায় রথারোহণ করিলেন। এইরূপে কেশব ও অর্জ্জুন রথারূঢ় হইলে, যেমন জলধর বারিধারায় ধরাধারকে আচ্ছন্ন করে, ভীষ্মও সেইরূপ পুনর্ব্বার শরনিকরে তাঁহাদিগকে সমাচ্ছন্ন করিলেন। যেমন আদিত্য বসন্তকালে কিরণজালদ্বারা তেজহরণ করেন, সেইরূপ তিনি যোধগণের প্রাণহরণ করিতে লাগিলেন। পাণ্ডবেরা যেমন কুরুসৈন্যগণকে ভগ্ন করিয়াছিলেন, তিনিও সেইরূপ পাণ্ডবসৈন্যগণকে ভগ্ন করিতে লাগিলেন। এইরূপে পলায়িত, নিরুৎসাহ, দুর্ম্মনায়মান শত-শত ও সহস্ৰ-সহস্ৰ পাণ্ডবসেনা ভীষ্মকর্ত্তৃক আহত হইয়া নভোমণ্ডলমধ্যগত মরীচিমালীর ন্যায় স্বতেজে সমুজ্জ্বলিত, অপ্ৰতিম, অলৌকিকবিক্ৰম, দুষ্কর্যকর্ম্মা ভীষ্মকে নিরীক্ষণ করিতে সমর্থ হইল না। পাণ্ডবগণ ভয়বিহ্বল হইয়া তাঁহাকে দর্শন করিতে লাগিলেন। পাণ্ডবগণের পলায়মান সৈন্যগণ পঙ্ক পতিত গোসমূহের ন্যায়, উৎপীড়িত পিপীলিকার ন্যায়, বলবানের সংগ্রামে দুর্ব্বলের ন্যায় অশরণ হইয়া উঠিল; দুর্জ্জয় মহারথ ভীষ্মের প্রতি দৃষ্টিপাত করিতে সমর্থ হইল না। তিনি শররূপ ময়ুখদ্বারা সূৰ্য্যের ন্যায় নরেন্দ্রগণকে উত্তাপিত করিতে লাগিলেন। পিতামহ ভীষ্ম এইরূপে পাণ্ডবসেনা বিমর্দ্দিত করিতেছেন, এমন সময় সহস্ররশ্মি অস্তমিত হইলেন। সৈন্যগণ সাতিশয় শ্রমকাতর হইয়াছিল; সুতরাং তাহাদিগের মন অবহারের নিমিত্ত উৎসুক হইয়া উঠিল।”