ষড়ধিকশততম অধ্যায়
ধৃতরাষ্ট্রের জন্ম
বৈশম্পায়ন কহিলেন, তদনন্তর সত্যবতী ঋতুস্নাতা পুৎত্রবধুকে যথাকালে শয্যায় শয়ন করাইয়া মৃদুস্বরে কহিতে লাগিলেন, ”বৎস ! তোমার এক দেবর আছেন, অদ্য নিশীথসময়ে তিনি তোমার নিকট আগমন করিবেন; অতএব তুমি অপ্রমত্তা হইয়া দেবরের আগমনকাল প্রতিক্ষা কর।” অন্বকা শ্বশ্রূর নিদেশবর্ত্তিনী হইয়া পরমরমনীয় শয্যায় শয়ন করিয়া ভীষ্ম ও অন্যান্য কৌরবদিগকে চিন্তা করিতে লাগিলেন। এই সময়ে ভগবান্ ব্যাস পূর্ব্বকৃত সত্যপ্রতিপালনার্থ প্রথমতঃ অম্বিকার শয়নাগারে প্রবেশ করিলেন। তদীয় বাসভবন প্রদীপ্ত দীপ শিখায় আলোকময় ছিল। অম্বিকা সেই কৃষ্ণবর্ণ মহর্ষির উজ্জ্বল নয়নযুগল, পিঙ্গলবর্ণ জটাভার, বিশাল শ্মশ্রু প্রভৃতি অতি ভয়ঙ্কর আকার নিরীক্ষণে ভীত ও বিস্ময়াবিষ্ট হইয়া নেত্রদ্বয় নিমীলিত করিলেন। ব্যাসদেব মাতার সন্তোষার্থে তাঁহার সহবাস করিলেন। অম্বিকা ভয়ক্রমে দেবরের প্রতি দৃষ্টিপাত করিতে পারিলেন না। অনন্তর দ্বৈপায়নের বহির্গমনসময়ে তাঁহার মাতা জিজ্ঞাসা করিলেন, ”কেমন ইনি গুণবান্ পুৎত্র প্রসব করিবেন? অতীন্দ্রিয়জ্ঞানসম্পন্ন ভগবান্ ব্যাস মাতৃবাক্য শ্রবণ করিয়া কহিলেন, ”ইনি অলৌকিক ধীরশক্তিসম্পন্ন, অযুতনাগেন্দ্র সদৃশ বলবান্, সুবিদ্বান্, মহাবীর্য্য, মহাভাগ পুৎত্র প্রসব করিবেন এবং সেই মহাত্মার একশত পুৎত্র হইবে; কিন্তু তিনি স্বয়ং মাতৃদোষে জন্মান্ধ হইবেন।” সত্যবতী পুৎত্রেব কথা শ্রবণ করিয়া কহিলেন, হে তপোধন! অন্ধ নৃপতি কুরুবংশের অননুরূপ; অতএব আর একটি পুৎত্র প্রদান কর, যাঁহার দ্বারা বংশরক্ষা ও রাজ্যের মঙ্গল হইতে পারে।” ব্যাসদেব ‘তথাস্তু’ বলিয়া স্বস্থানে প্রস্থান করিলেন। অনন্তর অন্বিকা যথাকালে এক অন্ধ পুৎত্র প্রসব করিলেন।
পাণ্ডুর জন্ম
সত্যবতী পুৎত্রবধুর নিকট সমস্ত বৃত্তান্ত অবগত করিয়া পূনর্ব্বার ব্যাসদেবকে আহ্বান করিলেন। তিনি পূর্ব্বর ন্যায় অতি ভয়ঙ্কর মূর্ত্তি ধারণপূর্ব্বক আবির্ভূত হইয়া জননীর নিয়োগক্রমে অম্বালিকার নিকট আগমন করিলেন। রাজমহিষী দ্বৈপায়নের সেই অদৃষ্টপূর্ব্ব ভীষণমূর্ত্তি সন্দর্শনে ভীতা ও পাণ্ডুবর্ণা হইলেন। সত্যবতী-পুৎত্র অম্বালিকাকে বিষণ্ণা ও বিবর্ণা দেখিয়া কহিলেন, ”ভদ্রে! তুমি আমার বিরূপত্ব সন্দর্শনে পাণ্ডু বর্ণ হইয়াছ, অতএব তোমার পুৎত্রও পাণ্ডুবর্ণ হইবে এবং তাহাত নাম পাণ্ডু হইবে।” মহর্ষি এই কথা বলিয়া বহির্গমন করিতেছেন, ইত্যবসরে সত্যবতী পুৎত্রবৃত্তান্ত জিজ্ঞাসা করিলে ব্যাসদেব কহিলেন, ”পুৎত্রটি পাণ্ডুবর্ণ হইবে এবং তাহার নাম পাণ্ডু হইবে।” ইহা শ্রবণ করিয়া সত্যবতী পুনর্ব্বার অপর সর্ব্বাঙ্গসুন্দর পুৎত্র প্রার্থনা করিলেন। মহর্ষি ‘তথাস্তু ‘ বলিয়া মাতাকে আশ্বাস-প্রদানপূর্ব্বক স্বস্থানে প্রস্থান করিলেন। অম্বালিকা যথাকালে পরমসুন্দর পাণ্ডুবর্ণ এক পূৎত্র প্রসব করিলেন। সেই পাণ্ডুর যুধিষ্ঠিরাদি পাঁচ পুৎত্র জন্মে।
বিদুরের জন্ম
অনন্তর জ্যেষ্ঠা বধুর পুনর্ব্বার ঋতুকালে উপস্থিত হইলে দ্বৈপায়নের সহযোগ করিবার নিমিত্ত সত্যবতী তাঁহাকে আদেশ করিলেন; কিন্তু অম্বিকা ঋষির মূর্ত্তি ও উগ্র গন্ধ চিন্তা করিয়া অত্যন্ত ভীত হইয়া শ্বশ্রূর আজ্ঞায় সম্মত হইলেন না। অনন্তর তিনি অপ্সরোপমা এক দাসীকে স্বীয় অলঙ্কার দ্বারা বিভুষিত করিয়া ঋষির নিকট প্রেরণ করিলেন। দাসী ঋষির নিকটগমন ও তাঁহাকে অভিবাদবপূর্ব্বক তদায় আজ্ঞা প্রাপ্ত হইয়া পরমভক্তি সহকারে তাঁহার শুশ্রূষা করিতে লাগিলেন। মহর্ষি তাঁহার সহযোগে পরম-প্রীত হইয়া গাত্রথ্থানপূর্ব্বক কহিলেন, ”হে শুভে! তুমি দাসত্বশৃঙ্খল হইতে মুক্ত হইবে এবং তোমার গর্ভজাত পুৎত্র অসাধারণ বুদ্ধিমান্ ও পরম-ধার্ম্মিক হইবে।” সেই দাসীগর্ভসম্ভুত দ্বৈপায়নাত্মজ বিদুর নামর বিখ্যাত হইলেন। তিনি ধৃতরাষ্ট্র ও মহাত্মা পাণ্ডুর ভ্রাতা। মহাতপাঃ মাণ্ডব্য মুনির শাপে ধর্ম্মরাজ বিদুররূপী হইয়া শূদ্রার গর্ভে অবতীর্ণ হইয়াছিলেন। মহর্ষি দ্বৈপায়ন স্বীয় প্রলম্ভ [প্রবঞ্চনা ছলনাপূর্ব্বক অন্যের স্থানে নিয়োগ] ও শূদ্রার পুৎত্রজন্ম-বৃত্তান্ত সত্যবতীকে নিবেদন করিয়া ধর্ম্মের নিকট অঋণী হইয়া তৎক্ষণাৎ অন্তর্হিত হইলেন। এইরূপে দ্বৈপায়নের ঔরসে ও বিচিত্রবীর্য্যের ক্ষেত্রে ধৃতরাষ্ট্র, পাণ্ডু এবং বিদুরের জন্ম হয় ।