১০৫তম অধ্যায়
সন্ধিপ্ৰস্তাবে নারদের উপদেশ
জনমেজয় কহিলেন, হে ব্ৰহ্মন! ভগবান ব্যাসদেব ও পিতামহ ভীষ্ম অথবা অন্যান্য স্নেহবান সুহৃদগণ কি নিমিত্ত অনার্থে কৃতনিশ্চয়, পরার্থলুব্ধ, অনাৰ্য্যকাৰ্য্যে [সাধুজননিন্দিত] নিরত, মরণে কৃতসঙ্কল্প, জ্ঞাতিবর্গের দুঃখনিদান, বন্ধুগণের শোকবৰ্দ্ধন, সুহৃজনের, ক্লেশদাতা, শত্রুপক্ষের হর্ষজনক বিপথগামী দুৰ্য্যোধনকে নিবারণ করিতেছেন না?
বৈশম্পায়ন কহিলেন, মহারাজ! ভগবান ব্যাসদেব ও ভীষ্ম অনেক উপদেশ প্রদান করিয়াছিলেন এবং মহর্ষি নারদও অনেক কহিয়াছিলেন, তৎসমুদয় শ্রবণ করুন।
নারদ কহিলেন, “হে কুরুনন্দন! হিতকারী সুহৃৎ। যেমন দুর্লভ, সুহৃদের বাক্য শ্রবণ করে, এরূপ ব্যক্তিও সেইরূপ দুর্লভ। সুহৃৎ ও বন্ধুতে অনেক অন্তর; সুহৃৎ প্রত্যুপকারপ্রত্যাশা পরিত্যাগ করিয়া উপকার করেন, কিন্তু বন্ধু প্রত্যুপকারপ্রত্যাশায় উপকার করেন; আর সুহৃৎ সকল স্থানেই অবস্থান করিয়া থাকেন; কিন্তু বন্ধু তাদৃশ্য নহেন; অতএব সুহৃদের বাক্য সর্ব্বতোভাবে শ্রোতব্য [শোনা উচিত]। কোন বিষয়ে নির্ব্বন্ধতিশয় [একান্ত আগ্রহ-অত্যন্ত জেদ] করা কর্ত্তব্য নহে; নির্ব্বন্ধ অতিশয় অনর্থকর। মহর্ষি গালব নির্ব্বন্ধতিশয়নিবন্ধন যেরূপ পরাভবপ্রাপ্ত হইয়াছিলেন, তদ্বিষয়ে একটি ইতিহাস আছে, শ্রবণ করুন।
বশিষ্ঠরূপী ধর্ম্মবিশ্বামিত্ৰ-সংবাদ
“একদা ভগবান ধর্ম্ম তপস্বী বিশ্বামিত্ৰকে পরীক্ষা করিবার নিমিত্ত বশিষ্ঠের বেশ ধারণপূর্ব্বক সাতিশয় ক্ষুধিত হইয়া কৌশিকের [বিশ্বামিত্রের] আশ্রমে প্ৰবেশ করিলেন। বিশ্বামিত্র তাঁহাকে নিরীক্ষণ করিয়া সসম্ভ্রমে যত্নাতিশয়সহকারে পরমান্ন পাক করিতে লাগিলেন; কিন্তু বশিষ্ঠের প্রতি কিছুমাত্ৰ মনোযোগ করিতে পারিলেন না। এই অবসরে বিশিষ্ঠরূপধারী ধর্ম্ম অন্যান্য মুনিগণকর্ত্তৃক দত্ত অন্ন ভোজন করিলে পর মহর্ষি বিশ্বামিত্র পরমান্ন লইয়া তাহার নিকট সমুপস্থিত হইলেন। তখন তিনি বিশ্বামিত্ৰকে কহিলেন, ‘মহর্ষে! আমার ভোজন সম্পূর্ণ হইয়াছে, আপনি ঐ স্থানে দণ্ডায়মান থাকুন।’ ভগবান ধর্ম্ম ইহা বলিয়া প্রস্থান করিলে মহাত্মা বিশ্বামিত্র তদবধি সেই উষ্ণ পরমান্ন মস্তকে রাখিয়া বাহুদ্বয়ে ধারণপূর্ব্বক বায়ুভুক [বায়ুমাত্র ভোজী] হইয়া স্থাণুর ন্যায় নিশ্চেষ্টভাবে সেই স্থানেই দণ্ডায়মান রহিলেন। তখন তাহার শিষ্য তপোধন গালিব গৌরব, বহুমান ও প্রিয়ানুষ্ঠানের নিমিত্ত পরমযত্নসহকারে তাহার শুশ্রীষা করিতে লাগিলেন।
“এইরূপে শত বৎসর পরিপূর্ণ হইলে ভগবান ধর্ম্ম বশিষ্ঠের বেশধারণপূর্ব্বক পুনরায় বিশ্বামিত্রের নিকট ভোজন করিতে আগমন করিলেন এবং দেখিলেন, মহর্ষি বিশ্বামিত্ৰ সেই অন্ন মস্তকে ধারণপূর্ব্বক বায়ুভুক হইয়া সেই স্থানে দণ্ডায়মান আছেন; তাঁহার মস্তকস্থিত অন্নও সেইরূপ উষ্ণ ও নূতন রহিয়াছে। বশিষ্ঠরূপী ধর্ম্ম সেই অন্ন ভক্ষণ করিয়া, ‘আমি পরম পরিতৃপ্ত হইলাম’ বলিয়া তাঁহাকে অভিলষিত বরপ্রদানপূর্ব্বক প্রস্থান করিলেন। বিশ্বামিত্র ধর্মের বাক্যানুসারে তদবধি ক্ষত্ৰিভাববিমুক্ত ও ব্রাহ্মাণত্ব প্রাপ্ত হইলেন।
গালবের গুরুদক্ষিণাদানে বিশ্বামিত্রের আদেশ
“অনন্তর তিনি স্বীয় শিষ্য গালবের ভক্তি ও শুশ্রূষায় প্রীত হইয়া তাঁহাকে কহিলেন, “বৎস! আমি আজ্ঞা করিতেছি, তুমি যথা ইচ্ছা গমন কর।” তখন গালিব মধুরবচনে কহিলেন, ‘মহাত্মন! আপনাকে গুরুদক্ষিণা প্ৰদান করিতে আমার নিতান্ত বাসনা হইয়াছে, অতএব আজ্ঞা করুন, কোন দ্রব্য প্রদান করিব? দক্ষিণা প্ৰদান করিলেই কর্ম্ম সিদ্ধ হয় ও দক্ষিণাদাতা চরমে মুক্তি, স্বৰ্গে যজ্ঞফল ও শান্তিলাভ করিতে পারে। অতএব আপনি আজ্ঞা করুন, কি দক্ষিণা আহরণ করিব?”
“বিশ্বামিত্ৰ গালবের শুশ্রূষায় নিতান্ত বাধিত [সাধ্য-অনুরক্ত] হইয়া বারংবার কহিলেন, “বৎস! আর দক্ষিণা প্ৰদান করিতে হইবে না, যথা ইচ্ছা! গমন কর।” গালব তাহাতে সম্মত না হইয়া পুনঃ পুনঃ দক্ষিণা প্রদানে নির্ব্বন্ধ প্ৰকাশ করিতে লাগিলেন। তখন বিশ্বামিত্ৰ কিঞ্চিৎ ক্ৰোধান্বিত হইয়া কহিলেন, “গালব! তুমি যদি নিতান্তই দক্ষিণা প্ৰদান করিবে, তাহা হইলে অচিরাৎ আমাকে শশধরের ন্যায় শুক্লবৰ্ণ শ্যামৈককর্ণ [যাহার একটি কাণ শ্যামবর্ণ] অষ্টশত অশ্ব প্ৰদান কর।’ ”