১০৪তম অধ্যায়
কর্ণপ্রমুখ অষ্ট মহারথসহ অর্জ্জুনের যুদ্ধ
হে মহারাজ! এই রূপে কৌরবগণ সুবর্ণ চিত্রিত, শব্দায়মান, জ্বলন্ত অনল সদৃশ, ব্যাঘ্রচর্ম্মাবৃত রথ দ্বারা দশদিক্ সন্দীপন এবং রুগ্মপৃষ্ঠ দুর্নিরীক্ষ্য ক্রুদ্ধ ভূজগসদৃশ শব্দায়মান কার্ম্মুক গ্রহণ করিয়া মহাবীর অর্জ্জুন ও কৃষ্ণের নিধন বাসনায় সত্বরে তাঁহাদের প্রতি ধাবমান হইলেন। সন্নদ্ধকবচ মহাবীর ভূরিশ্ৰবা, শল, কর্ণ, বৃষসেন, জয়দ্ৰথ, কৃপ, মদ্ররাজ ও রথি শ্রেষ্ঠ অশ্বত্থামা এই আট জন মহারথ বায়ুবেগগামী অশ্ব সংযোজিত, ব্যাঘ্ৰ চৰ্ম্মাচ্ছাদিত, ঘনঘটা গভীর নিম্বন, হেম বিভূষিত রথে আরোহণ করিয়া নিশিত শরনিকর নিক্ষেপ পূর্ব্বক মহাবীর অর্জ্জুনের দশদিক্ সমাচ্ছন্ন করিয়া ফেলিলেন। সৎকুলম্ভূত দ্রুতগামী বিচিত্র অশ্বগণ সেই মহারথগণকে বহনপূর্ব্বক দিক্ সকল উদ্ভাসিত করিয়া অসাধারণ শোভা ধারণ করিল। কৌরব পক্ষীয় প্রধান প্রধান যোধগণ পর্ব্বত, নদী ও অর্ণবসম্ভূত সদ্বংশজ, বেগগামী, অত্যুত্তম তুরঙ্গে আরোহণ পূর্ব্বক আপনার পুত্রের রক্ষাৰ্থ চতুর্দ্দিক হইতে সত্বরে ধনঞ্জয়ের রথের প্রতি ধাবমান হইয়া শঙ্খনাদে সসাগরা ধরিত্রী ও স্বর্গ পরিপুরিত করিতে লাগিলেন। তখন সৰ্ব্বদেবপ্রবর মহাত্মা বাসুদেব ও ধনঞ্জয় পাঞ্চজন্য ও দেবদত্ত শঙ্খ প্ৰধ্মাপিত করিতে আরম্ভ করিলেন। তাঁহাদিগের সেই শঙ্খ শব্দে সমুদায় শব্দ অন্তর্হিত এবং পৃথিবী, অন্তরীক্ষ ও দশ দিক্ পরিপূর্ণ হইয়া গেল।
হে মহারাজ! সেই ভীরু জনের ত্ৰাসজনক ও শূরগণের হর্ষবর্দ্ধন, নিদারুণ শঙ্খ নিনাদ সময়ে ভেরী, মৃদঙ্গ, ঝর্ঝর ও আনক প্রভৃতি বাদিত্রসকল বাদিত হইলে দুৰ্য্যোধন হিতৈষী, সসৈন্যে যুদ্ধার্থ সমুপস্থিত মহাধনুৰ্ধর নানা দিদেশীয় নর পতিরা কৃষ্ণ ও অর্জ্জুনের শঙ্খ নিনাদ সহ্য করিতে অসমর্থ হইয়া রোষভয়ে স্ব স্ব শঙ্খ প্রথাপিত করিতে লাগিলেন। তাঁহাদিগের সেই নির্ঘাত শব্দ সদৃশ শঙ্খনিস্বনে সমুদায় দিঙ্মণ্ডল ও আকাশমণ্ডল প্রতিধ্বনিত হইল। কৌরব পক্ষীয় সমুদায় রথী, গজ সেই ভীষণ শব্দে অত্যন্ত উদ্বিগ্ন হইয়া উঠিল। তখন মহাবীর দুৰ্য্যোধন ও সেই আট জন মহারথ জয়দ্রথের রক্ষাৰ্থ অর্জ্জুনকে নিবারণ করিতে লাগিলেন। মহাবীর অশ্বত্থামা বাসুদেবের উপর ত্ৰিসপ্ততি বাণ নিক্ষেপ পূর্ব্বক অর্জ্জুনের উপর তিন এবং তাঁহার ধ্বজ ও অশ্ব সমুদায়ের উপর পাঁচ ভল্ল নিক্ষেপ করিলেন। মহাবীর ধনঞ্জয় কেশবকে শরাহত দেখিয়া রোষকষায়িত লোচনে অশ্বত্থামাকে ছয় শত, কর্ণকে দশ ও বৃষসেনকে তিন শরে বিদ্ধ করিয়া শল্যের মুষ্টিস্থিত সশর শরাসন ছেদন করিয়া ফেলিলেন। মহাবীর শল্য তৎক্ষণাৎ অপর শরাসন গ্রহণ পূর্ব্বক অর্জ্জুনকে বিদ্ধ করিতে লাগিলেন। তখন মহারথ ভূরিশ্রবা সুবর্ণ পুঙ্খ শিলাশিত তিন বাণে, কর্ণ দ্বাত্রিংশৎ বাণে, বৃষসেন সাত বাণে, জয়দ্রথ ত্রিসপ্ততি বাণে, কৃপ দশ বাণে এবং মদ্ররাজ পুনরায় দশ বাণে অর্জ্জুনকে বিদ্ধ করিলেন। তৎপরে অশ্বত্থামা প্রথমতঃ পার্থের উপর ষষ্টি সংখ্যক শর নিক্ষেপ পূর্ব্বক পুনর্ব্বার তাঁহাকে পাঁচ ও বাসুদেবকে বিংশতি শরে বিদ্ধ করিয়া সিংহনাদ করিতে লাগিলেন। তখন কৃষ্ণসারথি অর্জ্জুন ঈষৎ হাস্য করিয়া স্বীয় হস্তলাঘবতা প্রদর্শন পূর্ব্বক সেই সকল বীরগণকে শর নিকরে তাড়িত করিতে আরম্ভ করিলেন। তিনি কর্ণকে দ্বাদশ, বৃষসেনকে তিন, সৌমদত্তিকে তিন, শল্যকে দশ, গোতমকে পঞ্চবিংশতি ও সৈন্ধবকে শত শরে বিদ্ধ করিয়া সত্বরে শল্যের মুষ্টিস্থিত সশর শরাসন ছেদন করিয়া ফেলিলেন। তৎপরে অশ্বত্থামাকে প্রথমত অগ্নিশিখাকার আট বাণ প্রহার করিয়া পুনরায় তাঁহার উপর সপ্ততি শর নিক্ষেপ করিলেন। তখন মহাবীর ভূরিশ্রবা ক্রোধপ্রদীপ্ত হইয়া হৃষীকেশের করস্থিত অশ্বরশ্মি ছেদন পূর্ব্বক অর্জ্জুনের উপর ত্রিসপ্ততি বাণ নিক্ষেপ করিলেন। মহাবীর ধনঞ্জয় তদ্দর্শনে অতিশয় ক্রুদ্ধ হইলেন এবং প্রবল বাত্যা যেমন মেঘমগুল ছিন্ন ভিন্ন করে, তদ্রূপ সেই কৌরব পক্ষীয় বীরগণকে সুতীক্ষ্ণ শরনিকর দ্বারা ছিন্ন ভিন্ন করিতে লাগিলেন।”