১০৩তম অধ্যায়
মাতলিতনয়ার বিবাহসম্বন্ধ
“অনস্তর নারদ নাগরাজ আৰ্য্যকের সমীপে গমন করিয়া কহিলেন, “হে আৰ্য্যক! ইনি দেবরাজের প্রিয়তম সুহৃৎ; ইহার নাম মাতলি, ইনি শুচি, শীলগুণসম্পন্ন, তেজস্বী, বীৰ্য্যবান, বলবান, দেবরাজের সারথি ও মন্ত্রি। প্রত্যেক সমরেই বাসবপ্রভাবের সহিত ইঁহার প্রভাবের অত্যল্প অন্তর [ভেদ-বিভিন্নতা] দৃষ্ট হইয়া থাকে। ইনি দেবাসুরের যুদ্ধে ইচ্ছামাত্রেই অশ্ব-সহস্ৰ-সংযুক্ত জৈত্ররথ [জয়শীল] প্রদান করেন। দেবরাজ ইহার সাহায্যে, অশ্বের সাহায্যে ও নিজ বাহুবলে শত্ৰুগণকে পরাজয় করিয়াছেন; আর ইহার সাহায্যেই বলাসুরকে সংহার করিয়াছিলেন। অসামান্য রূপলাবণ্য, সত্য, শীল ও নানাগুণসম্পন্ন গুণকেশীনামে ইহার এক কন্যা আছেন। ইনি প্ৰযত্ন সহকারে সমস্ত লোক পর্য্যটন করিয়া পরিশেষে আপনার পৌত্ৰ সুমুখকে সেই কন্যার উপযুক্ত পাত্ৰ বিবেচনা করিতেছেন। যদি আপনার ইচ্ছা হয়, বিলম্ব করিবেন না; শীঘ্রই সেই কন্যা-পরিগ্রহে অনুমতি প্ৰদান করুন। যেমন লক্ষ্মী বিষ্ণুর কুলে, স্বাহা অগ্নির কুলে ও শচী বাসবের কুলে পরিগৃহীত হইয়াছেন, সেইরূপ গুণকেশী আপনার কুলে পরিগৃহীত হউন, আপনি পৌত্রের নিমিত্ত গুণকেশীকে গ্ৰহণ করুন। আপনার পৌত্র পিতৃহীন হইলেও আমরা ইহার গুণ এবং আপনার ও ঐরাবতের বহুমানপ্রযুক্ত ইহাকে বরণ করিতেছি। মাতলি সুমুখের শীল, শৌচ ও দমাদি গুণসমূহ অবলোকন করিয়া স্বয়ং আগমনপূর্ব্বক উহাকে কন্যারত্ন প্ৰদান করিতে সমুদ্যত [সমুদযুক্ত] আছেন; আপনি ইহার সম্মান রক্ষা করুন।”
“নাগরাজ আৰ্য্যকের পুত্ৰ নিধনপ্রাপ্ত হইয়াছেন এবং পৌত্র জীবিত আছেন, এই উভয় কারণে তিনি শোক ও হর্ষ উভয়ই প্রদর্শন করিয়া নারদকে কহিলেন, ‘মহর্ষে! দেবরাজের সখা মাতলির সহিত সম্বন্ধবন্ধন কোন্ ব্যক্তির স্পৃহণীয় নয়? কিন্তু আমি সামান্য কারণপ্রযুক্ত অত্যন্ত চিন্তিত হইতেছি; এই নিমিত্ত আপনার প্রস্তাবে সম্যক সম্মতি প্রদর্শন করিতেছি না; ইহার জন্মদাতা আমার পুত্র বিনতাতনয়ের কবলে নিপতিত হইয়াছে, এই নিমিত্ত আমরা শোকার্ত্ত আছি; বিশেষতঃ, সে গমনকালে কহিয়াছিল, “এক মাসের মধ্যেই সুমুখকে ভক্ষণ করিব”। সে যেরূপ দৃঢ়প্রতিজ্ঞ, তাহাতে নিশ্চয় বোধ হইতেছে যে, অবশ্যই তাহা ঘটিবে। আমি বিনতানন্দনের বচনে একবারে দুঃখসাগরে নিমগ্ন হইয়াছি।”
“তখন মাতলি আৰ্য্যককে সম্বোধন করিয়া কহিলেন, ‘নাগরাজ! এ বিষয়ে আমি এক উপায় উদ্ভাবিত করিয়াছি, শ্রবণ করুন। আমি আপনার পৌত্ৰ সুমুখকে জামাতৃভাবে বরণ করিলাম; ইনি আমাদিগের সমভিব্যাহারে গমন করিয়া ত্ৰিলোকনাথ ইন্দ্রের সহিত সাক্ষাৎ করুন। আমি বিশেষ উপায়দ্বারা ইহাকে আয়ু প্ৰদান করিব এবং পক্ষিরাজ গরুড়কে বাধাপ্ৰদান করিবার নিমিত্ত যত্ন করিব। এক্ষণে কাৰ্য্যসাধনের নিমিত্ত সুমুখ আমার সহিত দেবরাজসমীপে আগমন করুক। হে ভুজঙ্গম! আপনার মঙ্গল হউক।”
সুমুখনাগের মাতলি-কন্যাপরিণয়
“অনন্তর সেই সকল মহাতেজঃ নারদপ্রমুখ ব্যক্তিগণ সুমুখকে সমভিব্যাহারে লইয়া মহাদুৰ্গতি দেবরাজের সহিত সাক্ষাৎ করিলেন; দৈবগত্যা সেই সময়ে ভগবান বিষ্ণু সেই স্থানে অবস্থান করিতেছিলেন। তখন মহর্ষি নারদ মাতলির আনুপূর্ব্বিক সমুদয় বৃত্তান্ত তাঁহাদিগকে নিবেদন করিলেন।
“ভগবান বিষ্ণু তাহা শ্রবণ করিয়া সুররাজ ইন্দ্রকে কহিলেন, “দেবরাজ! আপনি অমৃত প্ৰদান করিয়া সুমুখকে অমরতুল্য করুন। মাতলি, নারদ ও সুমুখ আপনার ইচ্ছায় স্ব স্ব কামনা পরিপূর্ণ করুক।”
কহিলেন, “ভগবন! আপনিই ইহাকে অমৃত দান করুন।”
“বিষ্ণু কহিলেন, “দেবরাজ! আপনি সমস্ত চরাচরের অধীশ্বর; অতএব আপনার অদত্ত বিষয় দান করা কাহার সাধ্য?”
“অনস্তর দেবরাজ পন্নগরাজকে অমৃতপ্রদান না করিয়া পরমায়ু প্ৰদান করিলেন। সুমুখ বরলাভে প্রসন্নমুখ [প্রফুল্লবদন] হইয়া মাতলিকন্যার পাণিগ্রহণপূর্ব্বক গৃহাভিমুখে গমন করিলেন। নারদও আৰ্য্যক কৃতকাৰ্য্য হওয়াতে প্ৰফুল্লচিত্ত হইয়া মহাদ্যুতি [অমিততেজাঃ] দেবরাজের অর্চ্চনাপূর্ব্বক প্রস্থান করিলেন।”