১০৩তম অধ্যায়
দুর্য্যোধনের অভেদ্য কবচ প্রশংসা
হে মহারাজ! রাজা দুৰ্য্যোধন অর্জ্জুনকে এই কথা বলিয়া মৰ্ম্মভেদী তিন শরে তাঁহাকে, চারিশরে তাঁহার চারি তুরঙ্গকে ও দশবাণে কেশবকে বিদ্ধ করিয়া ভল্লাস্ত্র দ্বারা তাঁহার প্রতোদ ছেদন করিয়া ফেলিলেন। তখন মহাবীর ধনঞ্জয় দুর্য্যোধনের উপর বিচিত্র পুঙ্খ শিলাশাণিত চতুর্দ্দশ বাণ নিক্ষেপ করিলেন। অর্জ্জুন নিক্ষিপ্ত শরনিকর দুৰ্য্যোধনের বর্ম্মে লগ্ন হইবামাত্র ব্যর্থ হইয়া ভূতলে নিপতিত হইল। মহাবীর অর্জ্জুন তদ্দর্শনে ক্রুদ্ধ হইয়া পুনরায় চতুর্দ্দশ শরনিক্ষেপ করিলেন। তৎসমুদায়ও দুর্য্যোধনের বর্ম্ম সংস্পর্শে ব্যর্থ হইল। তখন শত্রুতাপন কৃষ্ণ পার্থ নিক্ষিপ্ত অষ্টাবিংশতি বাণ বিফল হইল দেখিয়া তাঁহাকে কহিতে লাগিলেন, হে ভরতশ্রেষ্ঠ! আজি যে ভূধরের গতি সদৃশ অদৃষ্টপূর্ব্ব ঘটনা অবলোকন করিতেছি। কি আশ্চর্য্য! তোমার বাণ সকল ব্যর্থ হইল। আজি কি পূৰ্ব্বাপেক্ষা তোমার গাণ্ডীবের, মুষ্টির বা ভুজদ্বয়ের বলহানি হইয়াছে। আজি কি তোমার সহিত দুৰ্য্যোধনের শেষ সন্দর্শন হইবে? হে অর্জ্জুন! আজি আমি তোমার শরনিকর ব্যর্থ দেখিয়া নিতান্ত বিস্ময়াবিষ্ট হইতেছি। তোমার অতিকলেবর দারক অশনি সদৃশ শর সকল কোন কার্য্যকারকই হইল না! এ কি বিড়ম্বনা! অর্জ্জুন কহিলেন হে মাধব! মহাবীর দ্রোণাচার্য্য দুৰ্য্যোধন শরীরে আমার অস্ত্রের অভেদ্য দারুণ কবচ নিবেশিত করিয়াছেন। কেবল মহাত্মা আচার্য্য ঐ কবচ অবগত আছেন এবং আমি তাঁহার নিকট উহা অবগত হইয়াছি; এতদ্ভিন্ন ত্ৰিলোক মধ্যে আর কেহই এই কবচ বৃত্তান্ত জ্ঞাত নহেন। হে গোবিন্দ! মনুষ্য নিক্ষিপ্ত বাণের কথা দূরে থাকুক; ইন্দ্রের অশনিতেও উহা বিভিন্ন হইবার নহে। হে কেশব! তুমি ত্রিলোকের ভুত, ভবিষ্যৎ ও বর্ত্তমান বৃত্তান্ত অবগত আছ। তুমি এবিষয়টি যেরূপ অবগত আছ এমন আর কেহই নাই; তবে কি নিমিত্ত আমাকে জিজ্ঞাসা করিয়া মুগ্ধ করিতেছ। হে কেশব! দুরাত্মা দুৰ্য্যোধন আচার্য্য দত্ত কবচ ধারণ করিয়া নির্ভয়ে রণস্থলে অবস্থিতি করিতেছে। কিন্তু এই কবচ ধারণ করিয়া কি করা কৰ্তব্য তাহার কিছুই অবগত নহে; কেবল স্ত্রীলোকের ন্যায় গাত্রে ধারণ করিয়া আছে। অতএব তুমি আজি আমার ধনু ও বাহুদ্বয়ের পর্য্যবেক্ষণ করা দুরাত্মা দুর্য্যোধন কবচ রক্ষিত হইলেও আজি উহাকে পরাজিত করিব। আমার গাত্রে যে কবচ রহিয়াছে, ইহা প্রথমত দেবাদিদেব মহাদেব অঙ্গিরাকে প্রদান করিয়াছিলেন। তৎপরে অঙ্গিরা বৃহস্পতিকে ও বৃহস্পতি পুরন্দরকে সমর্পণ করেন। সুরপতি উপহারের সহিত ইহা আমাকে প্রদান করিয়াছেন। যাহা হউক যদি দুৰ্য্যোধনের কবচ দেবসম্ভূত হয়, অথবা ব্রহ্মা স্বয়ং উহা নির্ম্মাণ করিয়া থাকেন, তথাপি আজি দুৰ্ম্মতি দুৰ্য্যোধন উহা দ্বারা রক্ষিত হইতে পারিবে না।”
অর্জ্জুনবাণে কৌরবগণের নিপীড়ন
মহাবীর অর্জ্জুন এইরূপ কহিয়া শর সমুদায় মন্ত্রপূত করিয়া আকর্ষণ করিতে আরম্ভ করিলে অশ্বত্থামা দূর হইতে সৰ্বাস্ত্রনাশক অস্ত্র দ্বারা তৎসমুদায় ছেদন করিয়া ফেলিলেন। তদ্দর্শনে মহাবীর ধনঞ্জয় বিস্ময়াবিষ্ট হইয়া কেশবকে কহিলেন হে জনার্দ্দন! আমি পুনর্ব্বার এ অস্ত্র প্রয়োগ করিতে সমর্থ নহি। এই অস্ত্র আমা কর্ত্তৃক দুই বার প্রযুক্ত হইলে ইহা আমাকে বা আমার সৈন্যণকে বিনাশ করিবে। হে মহারাজ! এইরূপে অর্জ্জুনের বাণ ছিন্ন হইলে মহাবীর দুর্য্যোধন আশীবিষসদৃশ নয় বাণে কৃষ্ণকে, নয় বাণে অর্জ্জুনকে বিদ্ধ করিয়া পুনরায় তাঁহাদিগের উপর শরবর্ষণ করিতে লাগিলেন। কৌরব পক্ষীয়েরা তদ্দর্শনে যারপর নাই আহ্লাদিত হইয়া সিংহনাদ ও বাদিত্র বাদন করিতে আরম্ভ করিলেন। তখন বিপুল বীর্য্যশালী মহাবীর ধনঞ্জয় দুর্য্যোধনের প্রতি রোষাবিষ্ট হইয়া সৃক্কণী লেহন করিতে লাগিলেন, কিন্তু তাঁহার আপাদ মস্তক বৰ্ম্মরক্ষিত নিরীক্ষণ করিয়া তাঁহার গাত্রে শর নিক্ষেপ করিতে সমর্থ হইলেন না। পরিশেষে অন্তক সদৃশ শরনিকরে দুৰ্য্যোধনের শরমুষ্টি, শরাসন, অশ্ব সমুদায় পাষ্ণি ও সারথিকে ছেদন পূর্ব্বক তীক্ষ্ণ বাণদ্বয়ে রথ খণ্ড খণ্ড করিয়া অবিলম্বে তাঁহার হস্ততলদ্বয় বিদ্ধ করিলেন। কৌরব পক্ষীয় ধনুর্দ্ধরেরা পার্থ শরপীড়িত দুৰ্য্যোধনকে অত্যন্ত বিপদগ্রস্ত দেখিয়া তাঁহার রক্ষাৰ্থ সহস্র সহস্র রথ, গজ, বাজী ও রোষাবিষ্ট পদাতি সমূহ সমভিব্যাহারে আগমন ও ধনঞ্জয়কে বেষ্টন করিয়া তাঁহার উপর বাণ বর্ষণ করিতে লাগিলেন। এইরূপে মহা বীর অর্জ্জুন ও গোবিন্দ সেই মহাবীরগণের অস্ত্রজালে ও জনসমূহে পরিবৃত হইলে কেহই আর তাঁহাদের রথ বা তাঁহাদিগকে অবলোকনে সমর্থ হইল না। তখন মহাবীর অর্জ্জুন নিশিত অস্ত্র দ্বারা সেই সৈন্য সমুদায় আহত করিতে আরম্ভ করিলেন। শত শত রথী ও মাতঙ্গ বিকলাঙ্গ হইয়া সমর ভূমিতে শয়ন করিতে লাগিল। তদ্দর্শনে হতাবশিষ্ট অর্জ্জুন শর তাড়িত সৈন্যগণ চতুর্দ্দিকে এক ক্রোশ ভূমি অবরোধ করিয়া তাঁহার উপর শরবর্ষণ করিয়া তাঁহার রথের গতি রোধ করিল। তখন বৃষ্ণিবীর কৃষ্ণ অর্জ্জুনকে কহিলেন, “হে ধনঞ্জয়! তুমি ধনু বিস্ফারিত কর, আমি শঙ্খধ্বনি করিতে আরম্ভ করি। মহাবীর অর্জ্জুন বাসুদেবের বাক্যানুসারে গাণ্ডীব ধনু বিস্ফারিত করিয়া শরাঘাতে রিপুগণকে নিপাতিত করিতে আরম্ভ করিলেন। ধূলিধূসরিত পক্ষপটল কেশব ঘর্ম্মাক্ত বদনে পাঞ্চজন্য বাদন করিতে লাগিলেন। বাসুদেবের শঙ্খনাদ ও অর্জ্জুনের গাণ্ডীব নিস্বনে কৌরব পক্ষীয় কি বলবান কি দুর্ব্বল সকলেই ভূতলে নিপতিত হইল। তখন অর্জ্জুনের রথ সেই সেনাজাল হইতে বিমুক্ত হইয়া বায়ু প্রেরিত মেঘের ন্যায় শোভা পাইতে লাগিল।
ঐ সময় সিন্ধুরাজের রক্ষক মহাধনুর্দ্ধর বীরপুরুষেরা সহসা পার্থকে নিরীক্ষণ করিয়া অনুচরগণ সমভিব্যাহারে বাণ শব্দ, শঙ্খনিস্বন ও ভীষণ সিংহনাদ করিয়া বসুন্ধরা কম্পিত করিতে আরম্ভ করিলেন। বাসুদেব ও ধনঞ্জয় কৌরবগণের সেই ভয়ঙ্কর শব্দ শ্রবণ করিয়া শঙ্খ বাদন করিতে লাগিলেন। তাঁহাদের সেই শঙ্খ শব্দে ভূধর, অর্ণব ও দ্বীপসমবেত সমুদায় ভূতল পাতালতল এবং দশদি পরিপূর্ণ হইয়া গেল। কুরু পাণ্ডব সৈন্যমধ্যে সেই শব্দের প্রতিধ্বনি হইতে লাগিল। তখন কৌরব পক্ষীয় সমুদায় মহারথগণ কৃষ্ণ ও ধনঞ্জয়কে নিরীক্ষণ করিয়া প্রথমত অতিশয় ভীত হইলেন কিন্তু তৎপরেই ক্রোধে অধীর হইয়া সত্বরে তাঁহাদিগের অভিমুখে গমন করিলেন। তদ্দর্শনে সকলেই চমৎকৃত হইল।