এত ভাবি রঘুনাথ কহেন লক্ষ্মণে।
বলি এক উপদেশ শুন সাবধানে।।
রাজার বংশেতে জন্ম লয়ে দুই ভাই।
চিরদিন বনবাসে ভ্রমিয়া বেড়াই।।
কতদিন বঞ্চিলাম মুনিগণ সনে।
রাজনীতি কিছু না শিখিনু পিতৃস্থানে।।
অরণ্যেতে বধিলাম তাড়কা রাক্ষসী।
বিবাহ করিয়া দোঁহে অযোধ্যাতে আসি।।
অভিপ্রায় ছিল যে শিখিতে রাজনীত।
সে আশা নিরাশা হলো বিধি বিড়ম্বিত।।
পিতৃসত্য পালিতে আসিতে হোল বনে।
বনে বনে চৌদ্দ বর্ষ ফিরি দুইজনে।।
ভল্লুক বানর লয়ে বনে বনে ফিরি।
কে শিখাবে রাজনীতি কোথা শিক্ষা করি।।
অযোধ্যা-নগরে গিয়া পাব রাজ্যভার।
নাহি জানি ধর্ম্মাধর্ম্ম রাজ-ব্যবহার।।
কে শিখাবে রাজধর্ম্ম যাব কার কাছে।
অযোধ্যা-নগরে লোক নিন্দা করে পাছে।।
রাবণ প্রবীণ রাজা মান্য করে সবে।
করেছে অধর্ম্ম-কর্ম্ম রাক্ষস-স্বভাবে।।
রাজকীর্ত্তি কর্ম্মে রাবণ অতীব পণ্ডিত।
রাজনীতি রাবণেরে জিজ্ঞাস কিঞ্চিৎ।।
এখনি যাইবে রাজা দেহ পরিহরি।
জিজ্ঞাসহ নীতিবাক্য গোটা দুই চারি।।
অমূল্য রতন যদি অস্থানেতে রয়।
গ্রহণ করিতে পারে, শাস্ত্রে হেন কয়।।
শ্রীরামের আজ্ঞা পেয়ে লক্ষ্মণ সত্বর।
উপনীত হৈল যথা লঙ্কার ঈশ্বর।।
ব্রহ্ম-অস্ত্রে আকুল লঙ্কার অধিপতি।
লক্ষ্মণে দেখিয়ে করে সকরুণ স্তুতি।।
দশানন বলে শুন ঠাকুর লক্ষ্মণ।
এ সময় মোর মাথে দেহ শ্রীচরণ।।
বহু যুদ্ধ করিলাম হইয়া বিবাদী।
শত শত অপরাধে আমি অপরাধী।।
অপরাধ মার্জ্জনা করহ মহাশয়।
উপস্থিত এই মোর আসন্ন সময়।।
লক্ষ্মণ ঈশ্বর তুমি পরম পণ্ডিত।
পাঠালেন রাম মোরে শুধাইতে নীত।।
লক্ষ্মণের বাক্যে কহে রাজা লঙ্কেশ্বর।
কোন্ নীতি সংসারে রামের অগোচর।।
রাজনীতি আমি বল, কি কব রামেরে।
তবে যদি আজ্ঞা দেন কহিতে আমারে।।
সেবকের মুখে যদি করেন শ্রবণ।
দয়া করি একবার দিন দরশন।।
শক্তিহীন হইয়াছি বাহিরায় প্রাণ।
যাইতে না পারি আমি প্রভু বিদ্যমান।।
দয়া করে যদি রাম আসেন এখানে।
যাহা জানি রাজনীতি নিবেদি চরণে।।
এতেক শুনিয়া তবে ঠাকুর লক্ষ্মণ।
শ্রীরামের অগ্রে আসি সবিশেষ কন।।
রাজনীতি আমারে না কহে দশানন।
বাঞ্ছা আছে তোমারে করিতে দরশন।।
করিয়া অনেক স্তুতি কহিল আমারে।
উঠিতে না পারে রাবণ বিষম প্রহারে।।
স্তুতি বাক্য কহিলেন আমার সাক্ষাতে।
একবার আনিয়া দেখাও রঘুনাথে।।
বুঝি রাবণের মন উঠি শীঘ্রগতি।
রাবণের সাক্ষাতে আইলা রঘুপতি।।
উঠিতে শকতি নাই রাজা দশাননে।
ভক্তিভাবে প্রণাম করিল মনে মনে।।
আঘাতে আকুল অঙ্গ বাক্য নাহি সরে।
বিনয় করিয়া কথা কয় ধীরে ধীরে।।
রামের সর্ব্বাঙ্গ রাজা করে নিরীক্ষণ।
সাক্ষাৎ বিরাটমূর্ত্তি ব্রহ্ম-সনাতন।।
মায়াতে মানবদেহ বিশ্বময় তুমি।
তোমার মহিমা প্রভু কি জানিব আমি।।
অনাথের নাথ তুমি পতিত পাবন।
দয়া করে মস্তকেতে দেহ শ্রীচরণ।।
চিরদিন আমি দাস চরণে তোমার।
শাপেতে রাক্ষসকুলে জনম আমার।।
মহীতলে ভ্রমিতে হয়েছে তিন জন্ম।
আসুরিক বুদ্ধে নাহি জানি ধর্ম্মাধর্ম্ম।।
অপরাধ ক্ষমা কর গোলোকের পতি।
অনাদি পুরুষ তুমি আপনা বিস্মৃতি।।
রাজনীতি তোমারে কি কব রঘুবর।
সংসারেতে যত নীতি তোমার গোচর।।
রাম বলে যে কহিলে সকলি প্রমাণ।
তথাপি শুনিতে হয় আছয়ে বিধান।।
প্রাচীন ভূপতি তুমি অতি বিচক্ষণ।
বাহুবলে জিনেছ সকল ত্রিভুবন।।
ধর্ম্মাধর্ম্ম রাজধর্ম্ম তোমাতে বিদিত।
তব মুখে কিঞ্চিৎ শুনিব রাজনীত।।
দশানন বলে মম সংশয় জীবন।
কহিতে বদনে নাহি নিঃস্বরে বচন।।
যতক্ষণ বাঁচি প্রাণে আছি সচেতন।
কহিব কিঞ্চিৎ নীতি করহ শ্রবণ।।
করিতে উত্তম কর্ম্ম বাঞ্ছা যবে হবে।
আলস্য ত্যজিয়া তাহা তখনি করিবে।।
অলসে রাখিলে কর্ম্ম পুনঃ হওয়া ভার।
কহি শুন রঘুনাথ প্রমাণ তাহার।।
একদিন আসি আমি স্বর্গপুর হৈতে।
যমপুরী দৃষ্ট হৈল থাকি নিজ রথে।।
শূন্য হৈতে দেখিলাম যমের ভবন।
তিন দ্বারে নানা স্থানে আছে সাধুজন।।
দেখিলাম দক্ষিণেতে পাতকীর থানা।
দিবা কিবা রাত্রি কিছু নাহি যায় জানা।।
অন্ধকারে চৌরাশীটা নরকের কুণ্ড।
তাহাতে ডুবায়ে ধরে পাতকীর মুণ্ড।।
পরিত্রাহি ডাকে পাপী বিষম প্রহারে।
না দেয় তুলিতে মাথা যমদূতে মারে।।
তাহা দেখি বড় দয়া হইল মনেতে।
ঘুচাব পাপীর দুঃখ শমনের হাতে।।
পাপীর দুর্গতি আর দেখা নাহি যায়।
এত ভাবি সেই দিন এলেম লঙ্কায়।।
পূরাব নরকুণ্ড নিত্য করি মনে।
আজি কালি করিয়া রহিল বহুদিনে।।
হেলায় রহিল পড়ে না হয় পূরণ।
তার প তব সঙ্গে বাজিল এ রণ।।
কুণ্ড পূরাইতে যবে করিনু মনন।
তখনি পূরালে পূর্ণ হইত সে পণ।।
হেলাতে রাখিনু ফেলে না হইল আর।
মনের সে দুঃখ মনে রহিল আমার।।
আর এক কথা শুন নিবেদন করি।
লবণ-সমুদ্র মাঝে স্বর্ণ-লঙ্কাপুরী।।
একদিন মনেতে হইল এক কথা।
সপ্তটি সমুদ্র সৃষ্টি করেছেন ধাতা।।
দধি দুগ্ধ ঘৃত আদি সমুদ্র থাকিতে।
কেন আছি লবণ-সমুদ্র-সলিলেতে।।
স্বর্গ মর্ত্ত্য পাতাল আমার করতল।
সিঞ্চিয়া ফেলিব লবণ-সমুদ্রের জল।।
ক্ষীরোদ-সমুদ্র এনে রাখিব এখানে।
এই কথা চিরদিন আছে মোর মনে।।
যখন মনেতে হয় মনে করি করি।
অন্য কর্ম্মে থাকি সিন্ধু সিঞ্চিতে পাসরি।।
এইরূপে হেলাতে অনেক দিন গেল।
তদন্তরে তব সঙ্গে সংগ্রাম বাজিল।।
সমুদ্র সিঞ্চন করা না হইল আর।
মনের সে দুঃখ মনে রহিল আমার।।
অতএব এই কথা শুন রঘুমণি।
মনে হলে শুভকর্ম্ম করিবে তখনি।।
হেলায় রাখিলে কোন কার্য্য নাহি হয়।
আর এক কথা কহি শুন মহাশয়।।
নাগ নর ভূচর খেচর আদি সর্ব্ব।
ভূত প্রেত পিশাচাদি আছয়ে গন্ধর্ব্ব।।
ব্রহ্মার সৃষ্টিতে আছে জীবগণ যত।
যাইতে অমরপুরে সকলে বাঞ্ছিত।।
সকলের শক্তি নহে যাইতে সেথায়।
কেহ কেহ দৈবশক্তি অনুসারে যায়।।
দৈবশক্তিহীন যে বা আছে পৃথিবীতে।
স্বর্গপুরে যাইতে না পারে কদাচিতে।।
মনে মনে সাধ করে যাইতে অমরে।
দৈবশক্তিহীন তারা যাইতে না পারে।।
দেখি দুঃখ তাহাদের ভাবিনু অন্তরে।
কিরূপে যাইতে জীব পারে স্বর্গপুরে।।
অনায়াসে যাইতে পার সবে দেবলোকে।
নির্ম্মাব স্বর্গের পথ বিশ্বকর্ম্মে ডেকে।।
করিব এমন পথ সবে যেন উঠে।
পৃথিবী অবধি স্বর্গে করে দিব পৈঠে।।
থাকিবে অপূর্ব্ব কীর্ত্তি সংসারে পৌরুষ।
ত্রিভুবনে সবে মোর ঘুষিবেক যশ।।
তখনি করিতাম যদি হৈল যবে মনে।
কোন্কালে কার্য্যসিদ্ধি হৈত এতদিনে।।
হেলায় রাখিয়ে হৈল বহুদিন গত।
তার পর তব সঙ্গে যুদ্ধ উপস্থিত।।
অতএব শুভকর্ম্ম শীঘ্র করা ভাল।
হেলায় রাখিয়া সে বাসনা বৃথা হলো।।
শ্রীরাম বলেন, শুন লঙ্কা-অধিপতি।
শুভকর্ম্ম শীঘ্র করা এই সে যুকতি।।
সুকৃতি কর্ম্মের কথা কহিলে বিস্তর।
পাপকর্ম্ম-পক্ষে কিছু কহ আরবার।।
পাপকর্ম্ম হেলা করে রাখা যে জন্যেতে।
বলহ তাহার নীতি আমার সাক্ষাতে।।
শীঘ্র কৈলে পাপকর্ম্ম কি হবে দুর্গতি।
বিস্তার করিয়া কহ সেই রাজনীতি।।
দশানন বলে, তাহা কহিতে বিস্তর।
কত আর বিস্তারিয়ে কব রঘুবর।।
পাপকর্ম্ম অনেক করেছি চিরদিন।
কহিতে না পারি তনু প্রহারেতে ক্ষীণ।।
আছয়ে অনেক কথা আমার মনেতে।
কত কব রঘুনাথ তোমার সাক্ষাতে।।
এক কথা কহি রাম দেখ বিদ্যমান।
সূর্পণখার লক্ষ্মণ কাটিল নাক কাণ।।
সেই এসে উপদেশ কহিল আমারে।
তাহার বুদ্ধেতে আমি সীতা আনি হরে।।
সূর্পণখা কান্দিলেক চরণেতে ধরে।
মন হৈল সীতারে হরিয়া আনিবারে।।
একবার ভাবিলাম আপন মনেতে।
আজি নহে কালি সীতা আনিব পশ্চাতে।।
আবার বিচার করি দেখিলাম ভেবে।
হেলায় রাখিলে পাছে আনা নাহি হবে।।
অতএব শীঘ্রগতি হরে আনি সীতে।
সর্ব্বনাশ হৈল আমার সীতার জন্যেতে।।
এক লক্ষ পুত্র মোর সত্তয়া লক্ষ নাতি।
আপনি মরিলাম শেষে লঙ্কা-অধিপতি।।
যদি সীতা আনিতাম ভেবে চিন্তে মনে।
তবে কেন সবংশে মরিব তব বাণে।।
হেলাতে না হরি সীতা রাখিতাম ফেলে।
তবে মোর সংহার না হৈত কোনকালে।।
যাহা জানি কহিলাম কিছু নীতি-কথা।
কহিতে কহিতে জিহ্বায় আইল জড়তা।।
শ্রীচরণ-দৃষ্টি করি প্রাণত্যাগ কৈল।
জয় শব্দ হেনকালে সুরপুরে হৈল।।