১০১তম অধ্যায়
বৃত্ৰাসুরবধ-ধর্ম্মনাশে অসুরমন্ত্রণা
“অনন্তর পুরন্দর বজ্রগ্রহণপূর্ব্বক বৃত্ৰাসুরকে আক্রমণ করিবার নিমিত্ত যাত্ৰা করিলেন ও বলবান দেবগণ দেবরাজের রক্ষাকাৰ্য্যে নিযুক্ত হইলেন। এদিকে বৃত্ৰাসুর স্বৰ্গ-মর্ত্য আবৃত করিয়া রহিয়াছে; মহাকায় কালকেয়গণ শৃঙ্গশালী শৈলরাজের ন্যায় উদ্যতায়ুধ হইয়া তাহার চতুর্দ্দিক রক্ষা করিতেছে হইল। বীরগণ খড়্গোত্তোলন করিয়া আঘাত করিবামাত্র সেই খড়্গ বিপক্ষশরীরে নিপতিত হইয়া ভীষণ শব্দ উৎপাদন করিল এবং বীরগণের সমস্ত মস্তক বৃন্তশ্লথ [বোঁটা হইতে খসিয়া পড়া] তালফলের ন্যায় ধরাতালে পতিত হইতে লাগিল।
“এই তুমুল সংগ্রামসময়ে কালেয়-দানবগণ হেমকবচ পরিধানপূর্ব্বক পরিঘাস্ত্র গ্রহণ করিয়া দাবদগ্ধ পর্ব্বতরাজির ন্যায় দেবগণকে আক্রমণ করিল। বেগবান অসুরেরা সাতিশয় দর্পভরে ধাবমান হইলে দেবগণ তাহাদিগের বেগ সহ্য করিতে অসমর্থ হইয়া ভয়ে ইতস্ততঃ পলায়ন করিতে লাগিলেন। সহস্ৰলোচন দেবগণকে ভয়ে পলায়ন করিতে ও বৃত্ৰাসুরকে বিবৰ্দ্ধমান হইতে অবলোকন করিয়া মূর্চ্ছাপন্ন হইলেন। অনন্তর দেবরাজ ইন্দ্র সুরারি-ভয়ে ভীত হইয়া নারায়ণের শরণাপন্ন হইলে সনাতন দেব বিষ্ণু তাঁহাকে মোহবিষ্টা দৃষ্টিগোচর করিয়া স্বীয় তেজ প্রদানপূর্ব্বক তাহার বলবৰ্দ্ধন করিলেন। নারায়ণ সুররাজ ইন্দ্রকে রক্ষা করিলেন দেখিয়া দেবগণ ও ব্রহ্মর্ষিগণ তখন স্বীয় স্বীয় তেজ ধারণ করিলেন। এইরূপে ত্ৰিদশাধিপতি ইন্দ্ৰ বিষ্ণুকর্ত্তৃক আপ্যায়িত এবং দেব ও ঋষিগণের সহিত একত্র মিলিত হইয়া সমধিক বলবান হইয়া উঠিলেন।
“বৃত্ৰাসুর সুরপতিকে এইরূপ অবলোকন করিয়া ক্ৰোধাভরে অতিভীষণ সিংহনাদ পরিত্যাগ করিলে মহীতল, দিকসকল, অন্তরীক্ষ ও দেবলোক কম্পমান হইতে লাগিল। দেবরাজ তাহার ভীষণ নিনাদশ্রবণে সমভিতপ্ত ও ভয়ে অভিভূত হইয়া তাহাকে বধ করিবার নিমিত্ত সত্বরে কুলিশ [বজ্র] পরিত্যাগ করিলেন। কাঞ্চনমাল্যধারী মহাসুর বৃত্ৰ ইন্দ্ৰপ্ৰযুক্ত কুলিশপাতাভিহত হইয়া ইন্দ্ৰ বৃত্ৰভয়ে এরূপ ভীত হইয়াছিলেন যে, তিনি স্বয়ং বজ্রাঘাত করিয়া তাহার প্রাণসংহার করিয়াছিলেন, ইহা একবারে রোধ করিতে অসমর্থ হইয়া সরোবরে প্রবেশপূর্ব্বক প্রাণরক্ষা করিবার নিমিত্ত পলায়ন করিলেন। তখন দেবগণ বৃত্ৰাসুরকে নিহত নিরীক্ষণ করিয়া আনন্দভরে দেবরাজকে স্তব ও বৃত্ৰবধব্যাকুল অবশিষ্ট দৈত্যকুলকে নির্মূল করিতে আরম্ভ করিলেন।
“অনন্তর নিতান্ত অভিমানী দানবদল দেবগণকর্ত্তৃক একান্ত তাড়িত ও আহত হইয়া ব্যাকুলচিত্তে মীন-মকর-কুম্ভীর-সমাকীর্ণ অগাধ সাগরগর্ভে প্রবেশপূর্ব্বক একত্র মিলিত হইয়া ত্ৰৈলোক্য বিনাশ করিবার নিমিত্ত মন্ত্রণা করিতে লাগিল। তাহারা সকলে নানাবিধ উপায় কল্পনা করিয়া পরিশেষে ইহাই স্থির করিল যে, “তপঃপ্রভাবশালী বিদ্যাসম্পন্ন ব্যক্তিদিগকে প্রথমে বিনষ্ট করাই আমাদিগের কর্ত্তব্য; কারণ, তপস্যাই লোকস্থিতির কারণ; অতএব সকলে তপোবিনাশের নিমিত্ত সত্বর হও। ধরাধামবাসী যে-কোন ব্যক্তি তপশ্চৰ্য্যা বা ধর্ম্মানুষ্ঠান করিবে, অবিলম্বেই তাহাকে বিনষ্ট কর; তাহা হইলেই সমুদয় জগৎ বিনষ্ট হইবে, তাহাতে সন্দেহ নাই।” দানবগণ তরঙ্গদুৰ্গম সাগরদুর্গে বাস করিয়া লোক-বিনাশের নিমিত্ত এইরূপ মন্ত্রণা অবধারণ করিল।”