শ্রীরাম বলেন, রাবণ কি ভাবিছ বসে।
মরণ নিকট তোর যুদ্ধ দেহ এসে।।
এত বলি দিলা রাম ধনুকে টঙ্কার।
শ্রীরাম রাবণে যুদ্ধ বাজে আরবার।।
হইল বিষম যুদ্ধ না যায় গণন।
মহাকোপে বাণবৃষ্টি করিছে রাবণ।।
মাতলি সারথি বাণে হইল অস্থির।
বাণে বাণে নিবারণ কৈলা রঘুবীর।।
শূন্যপথে থাকিয়া অমরগণ দেখে।
মৃত্যুবাণ রঘুনাথ যুড়িলা ধনুকে।।
হংসাকৃতি বাণের যে মুখের আকার।
বাণ দেখি দেবগণের লাগে চমৎকার।।
কনক রচিত বাণ ভুবন প্রকাশে।
বাণের মুখেতে অগ্নি রহে গুপ্তবেশে।।
পশুপতি বৈসেন বাণের মাঝখানে।
চালনা করেন ঊনপঞ্চাশ পবনে।।
ধরাধর ধরাতে বিরাজে নিরন্তর।
অলক্ষিতে যম রহে বাণের উপর।।
বাণের গর্জ্জনে ত্রিভুবনে লাগে ডর।
পর্ব্বত উপাড়ি পড়ে উথলে সাগর।।
কৃষ্ণবর্ণ বাণের সকল অঙ্গজ্যোতি।
তিলেকেতে বিনাশিতে পারে বসুমতী।।
নানা পুষ্পমাল্য দিয়া বাণগোটা সাজি।
মন্ত্র পড়ি রঘুনাথ ব্রহ্মবাণ পূজি।।
মৃত্যু-অস্ত্র ধনুকে যুড়িলা মন্ত্রবলে।
ধূম উঠে বাণমুখে ব্রহ্ম-অগ্নি জ্বলে।।
মহাশব্দ করিয়া সঘনে গর্জ্জে বাণ।
দেখিয়া যে রাবণের উড়িল পরাণ।।
চিনিল রাবণ রাজা দেখি মৃত্যুবাণ।
জানিল যে এই বাণে বাহিরাবে প্রাণ।।
বিশ্বামিত্র স্মরি বাণ ছাড়ে রঘুবীর।
রাবণের বুক বিন্ধি কৈল দুই চির।।
ছটফট্ করে রাজা পড়ি ভূমিতলে।
ব্রহ্মাদি দেবতা দেখে গমন-মণ্ডলে।।
ইন্দ্র চন্দ্র কুবের বরুণ পুরন্দর।
দেবতা তেত্রিশ কোটি হয়ে একাত্তর।।
কাণাকাণি যুক্তি করে যত দেবগণ।
কেহ বলে এইবার মরিল রাবণ।।
হস্ত পদ নাহি নাড়ে মরিল নিশ্চয়।
কেহ বলে রাবণেরে নাহিক প্রত্যয়।।
কতবার মরে বেটা আরবার বাঁচে।
মনে করি কপট ভাবেতে পড়ে আছে।।
কি জানি এবার যদি না মরে রাবণ।
তবে রাবণের হাতে না রবে জীবন।।
অরিভাবে কার্য্য নাহি, না যাব নিকটে।
রাবণের চিতাধূম যাবৎ না উঠে।।
শিবদূত বিষ্ণদূত সবে ফিরে যায়।
বেঁচে আছে বলে কেহ নিকটে না যায়।।
মরেছে রাবণ বলে কেহ কেহ হাসে।
বেঁচে আছে বলে কেহ পলায় তরাসে।।
কেহ বলে রাবণ পড়িল কতবার।
দশ মাথা কাটা গেল না হৈল সংহার।।
রামায়ণে বাল্কীকি লিখিল পূর্ব্বকালে।
মহাশয়ন করিবে রাবণ রণস্থলে।।
রাবণ মরিবে হেন নাহিক পুরাণে।
অতএব না মরিবে ভাবি হেন মনে।।
কোন দেব বলে, রাবণের মৃত্যু আছে।
অমর হইতে বর পায় কার কাছে।।
জানিল কাল্মীকি মুনি পুরাণানাসারে।
রাবণ দুর্জ্জয় হবে বিখ্যাত সংসারে।।
ভয়ে মুনি রাবণের মৃত্যু নাহি লিখে।
কি জানি রাবণ রুষ্ট হয় পাছে দেখে।।
মুনি মনে জানে রাবণ হইবে দুর্জ্জয়।
প্রকাশিয়ে মৃত্যু-লেখা উপযুক্ত নয়।।
রাবণের মৃত্যু মুনি লিখিলা সঙ্কেতে।
এবার মরেছে রাবণ সন্দ নাহি তাতে।।
নির্ণয় করিতে নারে যত দেবগণে।
হেনকালে রঘুনাথ ভাবিলেন মনে।।
আমার পরম ভক্ত রাজা দশানন।
শাপেতে রাক্ষসযোনি হয়েছে এখন।।
শরাঘাতে জরজর পড়ে রণস্থলে।
একবার দরশন দিব এইকালে।।
এখনি মরিবে রাজা নাহিক সন্দেহ।
মৃত্যুকালে দেখা দিয়া মুক্ত করি দেহ।।
লক্ষ্মণেরে পাঠাইয়া জানিব সন্ধান।
সেইরূপ আছে কি হয়েছে দিব্যজ্ঞান।।