১০০তম অধ্যায়
জয়াবহ যুদ্ধযাত্রা–যুদ্ধবিষয়ক উপদেশ
যুধিষ্ঠির কহিলেন, “পিতামহ! বিজয়ার্থী ব্যক্তি যেরূপ অল্পমাত্র অধর্ম্মাচরণ করিয়াও ভীরু সৈন্যগণকে সমরে অভিমুখীন করেন, তাহা আমার নিকট কীৰ্ত্তন করুন।”
ভীষ্ম কহিলেন, “ধৰ্ম্মরাজ! সত্য, জীবিতনিরপেক্ষ, শিষ্টাচার ও কৌশলদ্বারাই যুদ্ধধর্ম্ম প্রতিপালিত হইয়া থাকে। এক্ষণে আমি সৰ্ব্বসিদ্ধিপ্রদ কৌশলের বিষয় কীৰ্ত্তন করিতেছি, শ্রবণ কর। উহা অবগত হইলে অনায়াসেই ধর্ম্মার্থবিঘাতক[ধৰ্ম্ম ও অর্থের বিঘ্নকারক] দস্যুগণকে বিনাশ করা যাইতে পারে। সকলেরই সরল ও বক্র এই দুইপ্রকার বুদ্ধি আবশ্যক। লোকে বক্রবুদ্ধিদ্বারা অন্যের অনিষ্ট করিয়া সমাগত বিপদসমুদয় অবগত হইবে। অরাতিগণ রাজ্যমধ্যে ভেদ উৎপাদন করিয়া নরপতির সর্ব্বনাশ করিবার চেষ্টা করে; কিন্তু ভূপতি বক্রবুদ্ধিসম্পন্ন হইলে তাহারা কখনই স্বার্থসাধনে কৃতকাৰ্য্য হইতে পারে না। সংগ্রামার্থী ভূপতিগণ গজচৰ্ম্ম, বৃষ ও অজগরের অস্থি ও কণ্টক, চামর, শাণিত অস্ত্র, পীতলোহিত বৰ্ম্ম, নানাবর্ণে রঞ্জিত ধ্বজ ও পতাকা, ঋষ্টি, তোমর, নিশিত খড়্গ, পরশু, ফলক, চর্ম্ম এবং কৃতনিশ্চয় যোধগণকে [যুদ্ধার্থ উৎসাহী বীরগণকে] সংগ্রহ করিয়া রাখিবেন। চৈত্র অথবা অগ্রহায়ণমাসে যুদ্ধার্থে সেনাসংযোগ করাই উচিত। ঐ সময় পৃথিবী বারিপূর্ণ [রসযুক্ত-স্নিগ্ধ] ও শস্যশালী হয় এবং শীত অথবা গ্রীষ্মের আতিশয্য থাকে না। অতএব ঐ দুই মাসই শত্রুগণকে আক্রমণ করিবার উপযুক্ত সময়। শত্রুগণ ব্যসনাপন্ন হইলে যে-কোন সময়ে হউক না কেন, তাহাদিগকে আক্রমণ করা যুক্তিবহির্ভূত নহে। অভিজ্ঞ কার্য্যদক্ষ চরগণের সুবিদিত স্থলপথ দিয়া যুদ্ধযাত্রা করা উচিত। মৃগের ন্যায় অরণ্যমধ্য দিয়া গমন করা মনুষ্যগণের পক্ষে নিতান্ত কঠিন; অতএব জয়ার্থী ভূপতিগণ সেনাদিগকে উত্তম পথ দিয়া লইয়া যাইবেন। সঙ্কুলসম্ভূত মহাবলপরাক্রান্ত বীরগণকেই সৈন্যগণের অগ্রসর করা কর্ত্তব্য; স্বীয় দুর্গ একদ্বারযুক্ত ও সলিলসম্পন্ন হইলে উহা আশ্রয় করিয়া সমাগত শত্রুগণকে অনায়াসে নিবারণ করা যায়।
“যুদ্ধবিদ্যাবিশারদ নানাগুণে সমলঙ্কৃত ব্যক্তিগণ শূন্যপ্রদেশ অপেক্ষা বনের নিকটস্থ ভূমি সৈন্যসংস্থাপনের উপযুক্ত স্থান বলিয়া বোধ করেন। অতএব সেইস্থানে সসৈন্যে অবতরণপূর্ব্বক পদাতিগণকে গোপনে রাখিয়া শত্রুগণ উপস্থিত হইবামাত্র তাহাদের সহিত যুদ্ধ করা বুদ্ধিমানের কর্ত্তব্য। সপ্তর্ষিগণকে [আকাশে উদিত তন্নামক নক্ষত্ৰশ্রেণী] পশ্চাদ্ভাগে অবস্থাপনপূর্ব্বক অচলের ন্যায় স্থিরচিত্তে যুদ্ধ করিলে দুর্জ্জয় শত্রুগণকে পরাজিত করা যায় ও শুত্রু যাহার অনুকূল হয়, তাহার জয়লাভে কিছুমাত্র সংশয় নাই। শুক্র অপেক্ষা সূর্য্যের ও সূৰ্য্য অপেক্ষা বায়ুর অনুকূলতা শ্রেষ্ঠ বলিয়া পরিগণিত হইয়া থাকে। সংগ্রামনিপুণ বীরগণ বারিকর্দ্দমবিবজ্জিত [জলকাদাশূন্য] লোষ্ট্রবিহীন প্রাকারাদিশূন্য প্রদেশকে অশ্বারোহীদিগের, উদক-কাশ[জল ও কেশে] যুক্ত অবন্ধুর [সমতল] প্রদেশকে রথিদিগের, ক্ষুদ্র-বৃক্ষ ও মহাকক্ষ[বৃহৎ গৃহ] সঙ্কুল প্রদেশকে গজারোহীদিগের এবং পর্ব্বত, উপবন ও বেণুবেত্র [বাঁশবেত] সমাকুল বহু দুৰ্গসমন্বিত প্রদেশ পদাতিদিগের সংগ্রামোপযোগী বলিয়া বিবেচনা করেন। সৈন্যমধ্যে পদাতিসংখ্যা অধিক হইলে উহা সুদৃঢ় বলিয়া পরিগণিত হয়।
“নিৰ্ম্মল দিনে রথাশ্ববহুল সৈন্য লইয়া যুদ্ধ করা কর্ত্তব্য। বর্ষাকালে সংগ্রাম করিতে হইলে সৈন্যমধ্যে অধিক পরিমাণে হস্তী ও পদাতি সন্নিবেশিত করিতে হইবে। যে ব্যক্তি দেশকাল বিবেচনা করিয়া এই সকল নিয়মের অনুসারে সুচারুরূপে সৈন্য সংযোজনপূৰ্ব্বক উৎকৃষ্ট তিথিনক্ষত্রে যুদ্ধযাত্রা করেন, তাঁহার সতত জয়লাভ হইয়া থাকে। প্রসুপ্ত, তৃষিত, পরিশ্রান্ত, প্রচলিত, পানভোজনে আসক্ত, নিহত, দৃঢ়তর সমাহত, নিবারিত, বিশ্বস্ত, কাৰ্য্যান্তরব্যাপৃত, তাপিত, বহির্গত, তৃণাদির আহরণকৰ্ত্তা, শিবিরে পলায়মান এবং রাজা বা অমাত্যের পরিচৰ্য্যানিরত অধ্যক্ষদিগকে আঘাত করা নিতান্ত অকৰ্ত্তব্য। যাহারা পরকীয় সৈন্যগণকে ছিন্নভিন্ন ও স্বপক্ষীয় পলায়মান সেনাগণকে সংস্থাপিত করিতে পারে, তাহাদিগকে আপনার সমান আসন, পান, ভোজন ও দ্বিগুণ বেতনপ্রদান এবং উহাদের মধ্যে যে ব্যক্তি দশসৈন্যের অধিপতি, তাহাকে একশত সৈন্যের ও যে ব্যক্তি শতসৈন্যের অধিপতি, তাহাকে সহস্র সৈন্যের আধিপত্যে সংস্থাপন করা অবশ্য কর্ত্তব্য।
“নরপতি প্রধানানুসারে ক্রমে ক্রমে সমুদয় যোদ্ধাকে আহ্বানপূর্ব্বক একত্র করিয়া কহিবেন যে, ‘এক্ষণে জয়লাভার্থ সংগ্রামস্থলে গমন করিয়া পরস্পর কেহ কাহাকে পরিত্যাগ করিব না বলিয়া আমাদিগকে শপথ করিতে হইবে। অতএব আমাদের মধ্যে যাঁহারা ভীরুভাব আছেন অথবা যাঁহারা নিষ্ঠুর কাৰ্য্যের অনুষ্ঠান করিয়া আত্মপক্ষীয় প্রধান ব্যক্তির বধসাধন করিবেন, তাঁহারা এই সময়েই ক্ষান্ত হউন। উহারা যেন সমরাঙ্গনে গমনপূর্ব্বক আত্মীয়ের বিনাশ সমর পরিত্যাগপূর্ব্বক পলায়ন করেন। বীরপুরুষেরা আত্মপক্ষীয় সৈন্যগণকে রক্ষা করিয়া পরিশেষে বিপক্ষগণকে বিনাশ করিয়া থাকেন। রণে পলায়ন করিলে অর্থনাশ, মৃত্যু ও ঘোরতর অপযশ হইয়া থাকে। আমাদিগের শত্রুপক্ষীয়েরাই যেন আমাদের কর্ত্তৃক আক্রান্ত ও ভগ্নদন্তোষ্ঠ [দন্ত ও ওষ্ঠ ভগ্ন] হইয়া ঐ সমস্ত বিপদে নিপতিত হয়। যাহারা সমরে পরাঙ্মুখ হয়, সেই নরাধমগণ কেবল মনুষ্যের সংখ্যাবর্ধক মাত্র, উহারা কোন লোকেই মঙ্গললাভে সমর্থ হয় না। জয়শীল অমিত্রগণ সানন্দচিত্তে মণ্ডলাকারে পলায়িত ব্যক্তির অনুসরণ করে। বিপক্ষগণ সমরাঙ্গনে গমনপূৰ্ব্বক যাহার যশঃশশাঙ্কে কলঙ্ক আরোপিত করে, আমার মতে তাহার দুঃখ মৃত্যুযন্ত্রণা অপেক্ষাও অসহ্য। জয়লাভ ধর্ম্ম ও সুখের মূলস্বরূপ। ভীরু ব্যক্তি বিপক্ষকর্ত্তৃক সমাহত বা মৃত্যুগ্রস্ত হইতে ভীত হয়; কিন্তু বীরপুরুষেরা সুস্থচিত্তে বিপক্ষের প্রহার সহ্য ও প্রাণপরিত্যাগ করেন। অতএব আমরা জীবিতনিরপেক্ষ হইয়া সংগ্রামে গমনপূৰ্ব্বক হয় জয়লাভ, না হয় বিপক্ষের হস্তে প্রাণপরিত্যাগ করিয়া সদগতি লাভ করিব।
“হে ধৰ্ম্মরাজ। নির্ভীক্চত্ত বীরপুরুষ এইরূপে সৈন্যগণকে উৎসাহ প্রদান করিয়া অরাতিসৈন্যে অবগাহন করিবেন। যুদ্ধকালে খড়্গচর্ম্মধারী পদাতি সৈন্যগণকে অগ্রভাগে ও শকটারোহী সেনাগণকে পশ্চাদ্ভাগে অবস্থানপূৰ্ব্বক মধ্যস্থলে অন্যান্য বীরগণকে সন্নিবেশিত করা কর্ত্তব্য। ঐ সময় যাঁহারা অগ্রবর্তী থাকিবেন, তাঁহারা শত্রুবিনাশের নিমিত্ত পদাতিগণের রক্ষা করিবেন। বলবান্ মনস্বী ব্যক্তিরা সর্বাগ্রে যুদ্ধে প্রবৃত্ত হইলে অন্যান্য সৈন্যগণ পশ্চাৎ পশ্চাৎ গমন করিয়া তাঁহাদিগের রক্ষাবিধানে যত্নবান হইবে। ভীরুদিগের উৎসাহবর্দ্ধনার্থ যত্নসহকারে তাহাদিগের সমীপে অবস্থান করা বীরগণের অবশ্য কর্ত্তব্য। সেনাপতি সমরপ্রবৃত্ত অল্পসংখ্যক সৈন্যগণকে চতুর্দিকে বিস্তার করিয়া যুদ্ধ করিবেন। অধিকসংখ্যক সৈন্যের সহিত অল্পসংখ্যক সৈন্যের যুদ্ধ উপস্থিত হইলে সূচীমুখব্যূহ নির্ম্মাণ করা আবশ্যক। ঘোরতর সংগ্রাম উপস্থিত হইলে সেনাপতি শত্রুপক্ষেরা পলায়ন করিতেছে বলিয়া সৈন্যগণের বাহু আকর্ষণপূর্ব্বক চীৎকার করিবেন। আর মহাবলপরাক্রান্ত বীরগণ ‘আমাদিগের মিত্ৰবল উপস্থিত হইয়াছে, তোমরা নির্ভীকচিত্তে প্রহার কর’ বলিয়া সৈন্যগণের উৎসাহবন্ধন এবং শঙ্খ, বেণু, শৃঙ্গ, ভেরী, মৃদঙ্গ ও পণব প্রভৃতি বিবিধ বাদ্যধ্বনিসহকারে সিংহনাদ পরিত্যাগে প্রবৃত্ত হইবেন।”